বুদ্ধদা আদর্শ কমিউনিস্ট ছিলেন
Buddhadeb Bhattacharya: ব্যক্তিগত ভাবে রাজনীতির পাশাপাশি কবিতাচর্চা, সাহিত্যচর্চা, নাট্যচর্চা, ভালো গান, ভালো চলচ্চিত্র, এমনকী দুনিয়াজোড়া সাহিত্যের খবর রাখতেন। আবার রাজনীতির ক্ষেত্রেও নানান প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতেন,...
রাজ্য-রাজনীতির কার্যত একটা অধ্যায়ে তালা পড়ে গেল। চলে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুধু রাজনীতির অধ্যায়েই যে তালা পড়ল, তা নয়। চলে গেলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বও। বুদ্ধদাকে প্রথম দেখি যুবনেতা হিসেবে। তখন আমরা ছাত্র। কিন্তু তখন থেকেই তাঁর ভাবনা-চিন্তা, কথাবার্তা, বক্তৃতা-লেখনী , তাঁর সংস্কৃতিবোধ, তাঁর পরিমার্জিত রুচি-পরিশীলিত ব্যবহার আমাদের প্রজন্মকে টানত। শুধু তা-ই নয়, আমরা সেসময় নিজেদেরকে ওঁর মতো করে সাজিয়ে তোলারও কম চেষ্টা করিনি। সেটা ষাটের দশকের শেষ কিংবা সত্তরের শুরু। সময়টা উত্তাল। সেসময় যুবনেতা হিসেবে দেখেছি বুদ্ধদাকে। যথেষ্ট কম বয়সেই বামফ্রন্ট সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন তিনি। রাজ্যে সংস্কৃতির চর্চার পরিবেশ তৈরি করা এবং সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের চেষ্টার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে কীভাবে শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং সৃজনশীলতার মধ্যে টেনে নিয়ে আসা যায়, এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কীভাবে উৎসাহ তৈরি করা যায়, সেই চেষ্টা সর্বদা করে গিয়েছেন।
ব্যক্তিগত ভাবে রাজনীতির পাশাপাশি কবিতাচর্চা, সাহিত্যচর্চা, নাট্যচর্চা, ভালো গান, ভালো চলচ্চিত্র, এমনকী দুনিয়াজোড়া সাহিত্যের খবর রাখতেন। আবার রাজনীতির ক্ষেত্রেও নানান প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতেন, প্রশ্নের সম্মুখীন হতে ভালোবাসতেন। নিজে প্রশ্ন করতেন, অন্যের প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতেন সবসময়। নবজাগরণের উত্তরসাধক হিসেবে যে সবকিছুকেই প্রশ্ন করা যায়, কোনও কিছুই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়, এই ভাবনায় বিশ্বাস করতেন খুব। বুদ্ধদার সম্পর্কে যেটা না বললেই নয়, তিনি সর্বোপরি একজন গণতান্ত্রিক ছিলেন, ভাবনায়, চেতনায়। অনেকেই বহু সময় প্রশ্ন করেছেন, কেন প্রশাসক হিসেবে কড়া মনোভাব নিলেন না তিনি? আসলে ওই উগ্রতাটা একেবারেই ছিল না তাঁর মধ্যে। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, হয় কেউ সাম্প্রদায়িক কিংবা অসাম্প্রদায়িক। বুদ্ধদার ক্ষেত্রে বলা যায়, তিনি ছিলেন 'অ্যাগ্রেসিভ সেক্যুলার'। কোনও রকম হীনমন্যতা যেমন ছিল না ওঁর মধ্যে, তেমনই ছিল না কোনও রকম অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস।
আরও পড়ুন: নিঃশব্দে যে যায় লাল পতাকা মুড়ে… বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শিখিয়ে গেলেন বাংলাকে
সবসময় দেখেছি, তাঁর মধ্যে এই একটা বোধটা কাজ করত যে শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত অংশের কাছে সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্র এবং সুযোগ— দুই-ই রয়েছে। কিন্তু যাঁরা আদিবাসী, তফসিলি, রাজবংশী কিংবা সংখ্যালঘু, অথবা যারা পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষ, তাঁদের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো কীভাবে গড়ে তোলা যায়, তাঁদের সংস্কৃতি, তাঁদের ধারা, তাঁদের গান, তাঁদের যে লোকসংস্কৃতি বা লোকশিল্পগুলি, সেগুলি যাতে বিলুপ্ত না হয়ে যায়, সেগুলিকে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবনাচিন্তা করতেন। কীভাবে তাঁদেরকে আরও বেশি করে উৎসাহ দেওয়া যায়, তাঁদের সংস্কৃতির চর্চা করা যায়, তা নিয়ে সদাসচেষ্ট থাকতে দেখেছি তাঁকে।
না, এটা যে শুধুই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ছিল, তা নয়। একই ভাবে প্রশাসক হিসেবে রাজ্যের কীভাবে উন্নয়ন হবে, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কীভাবে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য কারিগরী প্রশিক্ষন শিক্ষা, বৃত্তিশিক্ষা, পেশাশিক্ষার উপরে জোর দিতেন। গোটা বিশ্ব ও দেশের শিল্পসম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র আমাদের এখানে শিল্প গড়ে তোলাটাই যে উদ্দেশ্য ছিল এমন নয়। এমনকী শিল্পের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা বা বিনিয়োগ নিয়ে আসাও নয়, সেই সব ক্ষেত্রে যাতে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েরা কাজ করতে পারে, সেই কাজ করার মতো উপযুক্ত দক্ষতা অর্জন করতে পারে তাঁরা, সেগুলিও ছিল বুদ্ধদার যথেষ্ট মাথাব্যথার বিষয়ে। আমি তখন রাজ্যের কারিগরী শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্বে। নিজে দেখেছি কীভাবে তিনি প্রতিনিয়ত উৎসাহ জুগিয়েছেন এই সব দিকগুলিতে । সানশাইন ইন্ডাস্ট্রি, নতুন টেকনোলজি, তার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে সেগুলিতে কাজ করতে পারে, মাথা তুলে পৃথিবীর সামনে দাঁড়াতে পারে, অথচ তাঁদের পা যেন থাকে শক্ত মাটির উপরে, সেই চেষ্টা করে গিয়েছেন সর্বদা। অর্থাৎ তাঁদের যে স্বকীয়তা, বাঙালিয়ানা বা ট্র্যাডিশনাল ওয়ে অব লাইফ রয়েছে, সেই জায়গা থেকে তাঁরা যাতে বিচ্যুত না হয়, সেদিকেও জোর দিতে চাইতেন তিনি।
তাঁর সঙ্গে আমার রাজনীতির সম্পর্ক, সহকর্মীর সম্পর্ক যেমন ছিল, তার বাইরেও একটা ব্যক্তিগত স্তরে পারিবারিক সম্পর্কও তাঁর সঙ্গে আমার ছিল। বুদ্ধদার সঙ্গে একেবারে দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল আমার, এটা বললে বোধহয় এতটুকু অতিশয়োক্তি করা হয় না। শুধু ওঁর সঙ্গে নয়, মীরা ভট্টাচার্য ছিলেন নিজের বৌদির মতোই। সেই ব্যক্তিগত স্তরের সম্পর্ককে অনেকেই রাজনীতির ময়দানে গুলিয়ে ফেলতেন। অনেকেই মনে করতেন, রাজনৈতিক ভাবেও ঘনিষ্ঠ আমরা। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, নীতিগত ভাবে পরস্পরের অবস্থানের প্রতি একটা সম্মান আমাদের দু'জনেরই ছিল। তবে সত্যিই আমি অনেকটা ভালোবাসা, অনেকটা স্নেহ ওঁর কাছ থেকে। তাঁর আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলাম। অনেক ব্যাপারেই আমার উপর নির্ভর করতেন বুদ্ধদা। বহু ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে ঘনিষ্ঠজনের কাছেও প্রশ্ন করে বসেছেন, "সেলিম কী বলছে এ ব্যাপারে? ও যদি বলে থাকে, তাহলে ঠিক আছে।"
আরও পড়ুন: মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি…
সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চলে যাওয়া রাজ্যের, দেশের, সর্বোপরি রাজনীতির ক্ষতি তো বটেই। এরকম নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ চরিত্র সত্যিই আজকের রাজনীতিতে বিরল। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, সেটাই সব সময়ে আচরণের মধ্যেও ধারণ করেছেন। কোনও রকমের হিপোক্রেসি দেখিনি কখনও ওঁর চরিত্রে। স্পষ্টবাদী ছিলেন। ক্ষমতা দেখেছেন, জয়-পরাজয়— উভয়ই দেখেছেন ব্যক্তিগত কেরিয়ারে, তবে কোনও কিছুতেই তেমনভাবে বিচলিত হতে দেখিনি তাঁকে। পাশাপাশি একটা কথা না বললেই নয়, শত ঝড়ঝাপটা, সমালোচনা, বিতর্ক কোনও কিছুর সামনেই আপস করেননি কখনও, এমনকী কোনও কিছুতেই নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করতেও দেখিনি তাঁকে কোনওদিন। পাম অ্যাভিনিউয়ের ওই চারশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটাই ছিল তাঁর আজীবনের ঠিকানা। যেমন সাদামাটা জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন, শেষ জীবন পর্যন্ত তেমনটাই থেকে গেলেন। একজন আদর্শ কমিউনিস্টের ঠিক যেমন হওয়া উচিত, একেবারে তেমনটাই।