বৌদ্ধ ধর্মেই লুকিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর মূল মন্ত্র? কী বলছে গবেষণা
Environment: পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে গেলে সেখানে অনুভূতির দরজা খুলে পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন গৌতম বুদ্ধ।
আমাদের জীবনে আবেগ-অনুভূতির ভূমিকা ঠিক কেমন? প্রকৃতির সঙ্গে আবেগ-অনুভূতির কী সম্পর্ক?ইতিহাস অনুসন্ধান আবেগ দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়?বৌদ্ধ ধর্মমতে প্রকৃতি এবং জীবের আবেগের বিশেষ আদানপ্রদানের বিষয়টি আদপে কীরকম?- এই নিয়েই গবেষণা করছেন জার্মানির বার্লিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টে ড. ফ্রেডেরিক স্কোরার।
ফ্রেডেরিকের বর্তমান গবেষণার বিষয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঔপনিবেশিক সময় মানুষ ও পরিবেশের সম্পর্ক এবং পরিবেশ রক্ষায় বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের ভূমিকা।সম্প্রতি এই বিষয়েই কলকাতার ইন্সটিটিউট অফ ল্যাঙ্গোয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ-এ একটি বক্তৃতা দিয়েছেন এই জার্মান গবেষক। এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণামূলক ও সারস্বত চর্চা-র ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করে চলেছে। এই সংস্থার উদ্যোগে বক্তব্য রেখেছেন ব্রায়ান হ্যাচার, মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, একটি রাইটিং ওয়ার্কশপ করিয়েছেন লিজেল ক্সোয়াব। কলকাতার মতো মেট্রোপলিটন শহর, যেখানে নগরায়নের বিকাশ অব্যাহত সেখানে ফ্রেডরিক স্কোরারের গবেষণা আমাদের পরিবেশ এবং মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে দিশা দেয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ ও পরিবেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বৌদ্ধ ধর্মের জন্মের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। বুদ্ধের জন্ম লুম্বিনী বনের শালগাছের নিচে। আবার বুদ্ধ যেখানে বসে বোধি লাভ করেছেন, সেই বোধিবৃক্ষও বৌদ্ধ ধর্মর ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই গাছ সংরক্ষণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত যত্নশীল। গৌতম বুদ্ধ রাজপ্রাসাদ ত্যাগের পরেও আশ্রয় নিচ্ছেন সেই অরণ্যের কোলেই। সাধনা করছেন অরণ্যের বিভিন্ন গাছের তলায় বসে। এই প্রসঙ্গে ফ্রেডরিক উল্লেখ করেছেন এক মজার ঘটনা। গৌতম বুদ্ধ তখন গভীর অরণ্যে ধ্যানমগ্ন, তখন বুদ্ধের কাছে এক ব্রাক্ষণ ব্যক্তি গিয়ে সাধনার মার্গ জানতে চাইলে বুদ্ধ বলেছিলেন, অরণ্যই সাধনার আদর্শ মার্গ।
আরও পড়ুন: বৈজ্ঞানিক সত্যকে তুচ্ছ করে চিতা ফেরানো শুধুই রাজনৈতিক দেখনদারি
বৌদ্ধ ধর্মর আবেগের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে ফ্রেডেরিক বলছেন, যেহেতু অরণ্য নির্জন, তা অনেক বেশি মনোনিবেশের ক্ষেত্রে সহায়ক। অরণ্যের সেই নির্জনতা যে কোনও সাধকের কাছে একই সঙ্গে ভয়ের এবং দুশ্চিন্তার। গভীর বনে বিপদের যে চিন্তা ও সম্ভাবনা, তা কোথাও গিয়ে মানুষকে জীবনের সঙ্গে অভিযোজিত হতে সাহায্য করে। সাধক বা সন্ন্যাসীর ভেতরে মনঃসংযোগের ভিত্তি তৈরি করে জঙ্গল। বৌদ্ধ ধর্মে মানুষের সঙ্গে অরণ্যের এই সম্পর্ক কোথাও গিয়ে মানুষের আবেগ ও শারীরিক বোধকে উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে। বুদ্ধ বলছেন, ভয়কে জয় করতে হবে। জঙ্গলে যেহেতু যে কোনও মুহূর্তেই বিপদ হতে পারে এবং সেই বিপদের আগাম সম্ভাবনাও সব সময় পাওয়া যায় না, তাই ভয় কে ভয় দিয়েই জয় করার কথা বারবার বলা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বইতে। এখানে মনে রাখা দরকার, কোনওভাবেই ভয় বা একাকিত্বর অনুভূতিকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা নেই। কারণ বুদ্ধের মতে, এই অনুভূতিগুলি সাধনার অন্যতম প্রয়োজনীয় পথ। পরিবেশ তথা প্রকৃতির সঙ্গে এই যে আমাদের মানবজীবনের বিভিন্ন অনুভূতি গভীরভাবে জড়িয়ে, তারই সন্দর্ভ তৈরি করেছেন ফ্রেডেরিক।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভাবনায় শিক্ষার পদ্ধতির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে পরিবেশ ভাবনা। পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে গেলে সেখানে অনুভূতির দরজা খুলে পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন গৌতম বুদ্ধ।
ডক্টর ফ্রেডেরিক স্কোরারের লেখায় উঠে এসেছে আরও এক মজার তথ্য। ১৮৯৬-'৯৭ সালে ভারতে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেখানে প্রথম ত্রাণ বিলির উদ্যোগ নেয় মহাবোধি সোসাইটি। ফ্রেডেরিক-এর মতে, এই যে দুর্ভিক্ষ, এর পিছনেও দায়ী পরিবেশ নিয়ে আমাদের উদাসীনতা। মানুষের চাপ যত বেড়েছে, তত বাস্তুতন্ত্রের ওপর পড়েছে সেই চাপ। যার ফলে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র। বৌদ্ধধর্মে বারবার যে অরণ্যের কোলে সাধনার কথা উঠে এসেছে, তা আসলে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ সাধন করে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে স্বাভাবিক সহাবস্থানকে রক্ষা করার শিক্ষা দেয়। বর্তমানে যে দেশগুলিতে এখনও বৌদ্ধ ধর্ম সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তাদের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাপান ও চিন অন্যতম। বিশেষত, জাপানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ও দর্শনে বৌদ্ধ ধর্মের গভীর প্রভাব রয়েছে। সেখানে ধর্মাচরণের থেকেও বড় হয়ে উঠেছে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা, তাকে সংরক্ষণ ও জ্ঞান আহরণ। আজকের পৃথিবীতে যেভাবে থাবা বসিয়েছে বিশ্বায়ন তাতে 'জল, জঙ্গল, জমিন' বিপন্ন। ফ্রেডেরিক স্কোয়ারের কাজ আমাদের নতুন করে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে শেখায়।