বাজেটে পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি, বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব?
মঙ্গলবার লোকসভায় বাজেটে পেশের গোড়ায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতরমন জানিয়েছেন, আত্মনির্ভর ভারতের লক্ষ্যে দেশের ১৪ টি ক্ষেত্রে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে আগামী ৫ বছরে। 'অমৃতকালে' প্রবেশ করে গিয়েছেন ভাবছেন! সে গুড়ে বালি। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার গঠনের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের বিশাল সংখ্যক যুব সম্প্রদায়ের বেকারত্ব ঘোচানো। কিন্তু এর সঙ্গে বাস্তবের যে কোনো মিল নেই তা বারবার বোঝা গিয়েছে। মোদী জমানায় হুহু করে বেড়েছে বেকারত্বের হার, সে প্রমাণ মিলেছে বহু আন্তর্জাতিক মান্য সংস্থার রিপোর্টে।
মুম্বইয়ের ব্যবসায়িক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি প্রাইভেট লিমিটেডের ( সিএমআইই) সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর ডিসেম্বর মাসে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৭.৯ %। সংখ্যার হিসাবে দেশের পাঁচ কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ এই মুহূর্তে খাতায় কলমে বেকার। এর মধ্যে দেড় কোটির বেশি মানুষ আর কাজের খোঁজ করেন না বাজারে। বাকিরা খুঁজেও বাজারে কাজ জোটাতে ব্যর্থ। শহুরে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৯.৩ % যা নভেম্বর মাসে ছিল ৮.২%। সেখানে গ্রামীণ বেকারত্বের হার ৬.৪% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৩%। দেশের ২৩% মহিলা এই মুহুর্তে কাজ জোটাতে ব্যর্থ। এই সংস্থার ২০১৯ সালের রিপোর্ট বলছে স্নাতকদের জন্য বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৮.৫ %। অর্থাৎ স্নাতক পাশ করা তরুণ-তরুণীদের জন্য চাকরির অভাব রয়েছে ভারতের বাজারে। শহুরে মহিলাদের বেকারত্বের হার ২৬%।
আরও পড়ুন-৬৫০ খুন করেছিলেন! পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলারের গল্প হাড় হিম করে দেবে
রাজ্যের ভিত্তিতে বেকারত্বের হার বিচার করলে গত বছরে হরিয়ানাতে বেকারত্বের হার ছিল ২৮ শতাংশেরও বেশি। রাজস্থানে ২১.০৬%, বিহারে ১৬% ও জম্মু কাশ্মীরে ১৫.৪০%। নোটবন্দি, জিএসটির ঘা সামলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবার আগেই করোনা মহামারী এসে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা কার্যত তছনছ করে দিয়েছে। একশো দিনের কাজ জোটাতে লম্বা লাইনে অপেক্ষারত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পাল্লা দিয়ে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর দেড় কোটিরও বেশি মানুষ একশো দিনের কাজের জন্য আবেদন করেছেন। দ্বিতীয় ঢেউয়েও এই ছবি খুব বদলায়নি।
করোনার প্রকোপে এই মুহুর্তে দেশের সাড়ে ছয় কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছেন। ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে ৬০ লক্ষেরও বেশি ছোট, মাঝারি শিল্পের। ৫৪% মানুষের বার্ষিক আয় কমে গিয়েছে। শুধু মাত্র দেশের ১৪২ জনের আয় ২৩ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৬ লক্ষ কোটি টাকা। সবকা সাথ সবকা বিকাশ কি শুধু দেড়শো জনের মধ্যেই আজ সীমাবদ্ধ! অতিমারী পরবর্তীকালে ছোট মাঝারি শিল্পের স্বাস্থ্যোদ্ধারের কোনো পথ দেখাতে পারেনি নির্মলার এই বাজেট।
করোনা আবহে ২০২০০-২১ অর্থবর্ষে, গ্রামীন কর্মসংস্থান যোজনার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল এক লক্ষ এগারো হাজার কোটি টাকা। পরের বছরে বাজেটে সেই অর্থের পরিমাণ কমিয়ে করা হয় ৭২,০৩৪ কোটি টাকা। পরে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় এই খাতে। এই বছরেও ৭২,০৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। দেশে বেকারত্ব যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখন এই পরিমাণ অর্থ ভস্মে ঘি ঢালার সমান। সুতরাং প্রতিশ্রুতিই একমাত্র হাতিয়ার। পরের বছরও অর্থমন্ত্রী হয়তো বলবেন আপনাদের দুঃখে আমি সহমর্মী।
বেকারত্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ। অথচ অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় স্পষ্ট নয় কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হতে চলেছে। সুতরাং এই আশ্বাস যে দিশাহীন, জোর করে ফোলানো গ্যাসবেলুন, তা বলাই বাহুল্য। তৃণমূলের রাজ্যসভার মুখ্যসচেতক সুখেন্দুশেখর রায় বলছেন, "স্বাধীনতার পর এই বাজেট সবচেয়ে বস্তাপচা বাজেট। যে ৬০ লক্ষ নতুন চাকরির কথা বলা হয়েছে, তা আগামী পাঁচ বছরে উৎসাহ ভাতার সঙ্গে যুক্ত।" পি চিদাম্বরম বলছেন, ভারতের গরিব লোকের সঙ্গে এই বাজেট এক নির্মম ঠাট্টা।
সিএমআইয়ের বুলেটিন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সাল থেকে ২০২০-২১ এর মধ্যে ভারতের উৎপাদন বিভাগে কর্মসংস্থান কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। ২০১৬-১৭ সালে এই শাখায় কর্মরত ছিলেন ৫১ মিলিয়ন ভারতীয় যা ২০২০-২১ এ দাঁড়িয়েছে ২৭.৬ মিলিয়নে। অন্য দিকে ২০১৪ সালে মোদী সরকাররের আমলে চালু হওয়া 'মেক ইন ইন্ডিয়া' প্রজেক্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে দেশের উৎপাদন বিভাগে ১০০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরির কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব বলছে তার অর্ধেক লক্ষ মাত্রাও পূরণ হয়নি। সেই সংক্রান্ত কোনো কথাই এদিন উল্লেখ করেননি নির্মলা সীতারমন। ২৫ বছরের পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে এবারের বাজেটে। তাই এখনই সুরাহার কথা ভাবা উচিত নয়।
তবে অমৃতকালে যখন এসেই পড়েছি তাই চিন্তার কারণ নেই। পাঁচ বছরে না হোক পঁচিশ বছরে ৬০ লক্ষ মানুষের কর্মংস্থান হবে ঠিক।তাই বসে চুলে পাক ধরার অপেক্ষা করুক দেশের যুব সম্প্রদায়।