মাংস মদিরা সহযোগে ‘বর্ধমান স্ট্যু’, আজও যখন তখন ফিরে যাওয়া যায় ঔপনিবেশিক ভারতে
Burdwan Stew: পাখির টুকরো মাংস, ছাগল বা ভেড়ার সেদ্ধ মাংস দিয়েও অনেক সময় এই স্ট্যু তৈরি করা হতো। রান্নার জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল রুপোর সসপ্যান।
বর্ধমান বলতেই সবার প্রথমে আমাদের মনে আসে মিহিদানা আর সীতাভোগের কথা। তাই তো শহরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড়-মাঝারি দোকানগুলিতেও কখনও খরিদ্দারের অভাব হয় না। কিন্তু আজ সেসব থাক, একেবারে ভিন্ন স্বাদের একটি স্ট্যু-এর কথা বলতে চাই, যার নামকরণ করা হয়েছিল শহর বর্ধমানের নাম অনুসারে। এই স্ট্যু মূলত ছিল প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে তৈরি এক আইরিশ খাবার। বর্ধমান স্ট্যুয়ের নামকরণ সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য না জানা গেলেও, এনাবেল লয়েড তাঁর বই, ‘Picnic Crumbs’ এ অনুমান করেছেন, কলকাতা থেকে ৬৭ মাইল দূরে অবস্থিত এই বর্ধমান শহরটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের জেলা সদর। এখানে যে সমস্ত রাজকর্মচারী এবং সৈন্যরা থাকতেন, তাঁদের মধ্যেই প্রথম দিকে এই বর্ধমান স্ট্যুয়ের জনপ্রিয়তা অধিক ছিল। পরবর্তী কালে তাঁরা যখন কাজের সূত্রে কলকাতা কিংবা কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় যান, তাঁদের মাধ্যমেই স্ট্যুটির পরিচিতি ঘটতে থাকে ‘বর্ধমান স্ট্যু’ হিসাবে এবং ক্রমেই তা জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায়।
এই পদটি মূলত ইউরোপিয়ানদের কাছে জনপ্রিয় খাদ্য হয়ে উঠেছিল, অবশ্য স্ট্যুটির জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর্যাপ্ত কারণও ছিল। ভিনদেশের ইউরোপিয়ানদের খাদ্যাভ্যাস ছিল এ দেশীয়দের থেকে একেবারেই আলাদা। স্ট্যু জাতীয় খাবার হওয়ার কারণে তা সহজেই গরম করে নেওয়া যেত। শোনা যায়, সেই সময়ে অনেকেই নাকি সামান্য স্পিরিট ল্যাম্পের আঁচেও তা গরম করে নিতেন। এছাড়াও এই স্ট্যু যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাতেও অতি সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া যেত।
এই স্ট্যু কবে আবিষ্কার হয়েছিল, তার কোনও সঠিক সময় জানা যায় না, তবে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন ঔপনিবেশিক সাহিত্যে এই স্ট্যুয়ের কথা পাওয়া যায়। এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন সোস্যাইটিতে, খাবারের তালিকা থেকে এই স্ট্যুয়ের কথা জানতে পারা যায়। স্যার চার্লস ডি অইলি, একজন ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কর্মচারি এবং কবি, তাঁর কবিতা ‘Tom Raw, The Griffing’ (1928) তে রাইটার্সের এক জাঁকজমকপূর্ণ টিফিন হিসাবে এই খাবারের কথা উল্লেখ করেছেন। অয়াল্টারকে ফার্মিংগার নামে একজন যাজক এবং ঐতিহাসিক ‘Thacker’s Guide to Calcutta’ (1906) বইতে লালবাজারে হারমোনিক হাউসের নানান খাবার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে, এই স্ট্যুয়ের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তিনি আরও জানিয়েছেন, তৎকালীন সময়ে একটি রুপোর পাত্রে এই বর্ধমান স্ট্যু পরিবেশন করা হত। খ্রিস্টান আইসোবেল জন্সটোন, বর্ধমান স্ট্যুর সঙ্গে ‘ইংলিশ ডেভিল’ বা ‘ফ্রেঞ্চ সালমে’ জাতীয় খাবারের তুলনা করেছেন।
আরও পড়ুন- বিপ্লব থেকে গুণ্ডামি, যে পথে এগিয়েছে বাংলার ‘জ্বালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও’ আন্দোলন
স্ট্যু রান্নার উপাদান
এবার জেনে নেওয়া যাক, এককালীন বিখ্যাত এই স্ট্যু রান্না করতে কী কী উপাদান ব্যবহৃত হত। যদিও এই স্ট্যুয়ের নির্দিষ্ট রন্ধন পদ্ধতি বা উপাদান সম্পর্কে কোনও হদিশ মেলেনি, তবুও বর্ধমান স্ট্যুয়ের প্রথমদিকের যে রেসিপি পাওয়া যায় তাতে সাধারণ কিছু উপাদানেরই উল্লেখ রয়েছে, যেমন- কয়েক চামচ মদিরা, আঙ্কোভি এসেন্স, ময়দা, বাটার, পেঁয়াজ এবং গোলমরিচ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা মতো তা নিজের রূপ বদলেছে, কারণ পরের দিকের বর্ণনাগুলিতে আরও কিছু উপাদানের উল্লেখ পাওয়া গেছে। মিসেস ডাল্গার্ন, ১৮২৯ সালে প্রকাশিত ‘The Practice of Cookery’ বইতে আরও বেশ কিছু উপাদানের কথা বলেছেন। তাঁর রেসিপিতে এই স্ট্যুয়ের জন্য পূর্বের উপাদানগুলির সঙ্গে মাশরুম, লেবুর রস, ভিনিগার, হোয়াইট ওয়াইন, মশলা এবং সস ইত্যাদি সংযোজিত হয়েছে। আবার পাখির টুকরো মাংস, ছাগল বা ভেড়ার সেদ্ধ মাংস দিয়েও অনেক সময় এই স্ট্যু তৈরি করা হতো। রান্নার জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল রুপোর সসপ্যান। বলা হত, স্ট্যুয়ের স্বাদ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল রুপোর সসপ্যানের উপরেই। সেই সময় দাঁড়িয়েও বর্ধমান স্ট্যু একটি ফিউশন জাতীয় খাবার হিসাবে মর্যাদা লাভের দাবি রাখে।
রন্ধন পদ্ধতি
প্রথমেই পাখির মাংস সেদ্ধ করে নিতে হত। তারপর সেই সেদ্ধ করা মাংস, টুকরো করে কেটে স্ট্যু’র পাত্রে রাখা হত। তাঁর সঙ্গে মেশানো হত- তিন টেবিল চামচ আঙ্কোভি এসেন্স, তিন টেবিল চামচ মদিরা, জল, ময়দা, মাখন, টুকরো পেঁয়াজ এবং স্বাদের জন্য গোলমরিচ। পেঁয়াজ নরম হয়ে যাওয়া পর্যন্ত হালকা আঁচে তা রান্না করা হত এবং সবশেষে স্ট্যুটি পরিবেশন করা হত লেবুর আচার বা রস সহযোগে। ভেড়া বা ছাগলের মাংস দিয়ে বর্ধমান স্ট্যু বানানোর সময় এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হত।
আরও পড়ুন- রাজার জেদে রোলস রয়েস হলো ময়লা ফেলার গাড়ি! ক্ষমা চেয়েছিলেন সাহেবরা
উনিশ শতকের পরে ইউরোপিয়ানরা আরও ভিন্ন স্বাদের স্ট্যুয়ের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে থাকলে, বর্ধমান স্ট্যু তার নিজের জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং বলা চলে ক্রমে তার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়। আসলে ব্রিটিশ পুরুষ এবং মহিলাদের কাছে ভারত ছিল একটি দূরের দেশ, কেবল দূরের দেশ বললে হয়তো ভুল হবে। ভারতের কোনও কিছুর সঙ্গেই ইউরোপের বিশেষ সাদৃশ্য ছিল না। ইউরোপে থাকাকালীন তাঁরা যে সমস্ত সুবিধাগুলি পেতেন, তা ভারতে ছিল না বললেই চলে আর সেখান থেকেই সম্ভবত জন্মলাভ করেছিল এই বর্ধমান স্ট্যু, যার একদিকে ছিল পশ্চিমের খাদ্যাভ্যাসের ছোঁয়া আবার অন্য দিকে ছিল প্রাচ্যের নানান মশলার সমাহার।
তথ্যসূত্র
১. www.theoldfoodie.com
২. Scroll.in
৩. www.getbengal.com