দাহকাজ না কবর, শেষ সৎকারের কাজে কোনটি পরিবেশের জন্য ভালো? খোলসা করলেন বিজ্ঞানীরা

Cremation or Burial which is Eco-Friendly : হিন্দুদের দাহকাজ না মুসলিম-খ্রিস্টানদের কবর – কোনটি পরিবেশের জন্য ভালো? কোনটি পরিবেশের ক্ষতি করে না?

সভ্যতা যত গতি নিয়েছে, পৃথিবীর বুকে একের পর এক ঘটনা ঘটেই গিয়েছে। কখনও যুদ্ধ, মহাকাশ জয়, কখনও আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি, ধর্মীয় লড়াই। তবে যাই হয়ে যাক না কেন, একটা বিষয় এখনও কেউ খণ্ডাতে পারেনি। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’। জন্মের পর মৃত্যু আসে, এই সত্যের বাইরে তো আর কিছু নেই। মহাকাব্যে, পুরাণে, ধর্মীয় গ্রন্থে যতই অমরত্বের কথা লেখা থাক, এখনও বাস্তবে কেউ অমর হননি।

তবে মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ধর্মের বিভিন্ন নিয়ম। একেক ধর্মের কাছে মৃত্যুর পর সৎকার কাজের নিয়মকানুন একেকরকম। হিন্দুরা যেমন চিতায় (প্রযুক্তির ধাক্কায় সেটা এখন বৈদ্যুতিক চুল্লি) মৃতদেহ দাহ করে; তেমনই মুসলিম, খ্রিস্টানরা দেহ কবর দেয়। কেউ কফিনের ভেতর মৃতদেহ রাখে, কেউ আবার এমনিই কফিন ছাড়াই কবর দেয়। এছাড়াও আরও বিভিন্ন ধর্মীয় নিয়মকানুন রয়েছে। সেখানে সৎকারের পদ্ধতিও ভিন্ন। পদ্ধতি আলাদা হতে পারে, কিন্তু রাস্তা আর গন্তব্য সেই একই।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটির ঘর ছাড়িয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, এই সংখ্যাটি আরও বাড়ছে। নগর সভ্যতা আরও ছড়িয়ে পড়ছে, জনঘনত্বও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে নাভিশ্বাস উঠছে; সভ্যতার। সেখানে গবেষকরা বলছেন, মৃত্যুর পর মানুষকে কবর দেওয়ার মতো জায়গাও কমে আসছে। সেইসঙ্গে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতাও দিনকে দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। ধর্মীয় আদবকায়দার বাইরে গিয়ে পরিবেশ ও পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সেই প্রশ্ন করা হচ্ছে। হিন্দুদের দাহকাজ না মুসলিম-খ্রিস্টানদের কবর – কোনটি পরিবেশের জন্য ভালো? কোনটি পরিবেশের ক্ষতি করে না? আর কোন পদ্ধতিতে মৃতদেহ অনেক তাড়াতাড়ি গলে-পচে যাবে?

আরও পড়ুন : মানুষ আসলে কখনই মারা যায় না, মৃত্যু পুরোটাই ভাঁওতা! কেন এমন উদ্ভট দাবি করলেন এই বিজ্ঞানী?

এক এক করে আসা যাক। কেবল হিন্দু ধর্ম নয়, অনেক সংস্কৃতিতেই মৃত্যুর পর দেহ দাহ করার প্রথা রয়েছে। একটা সময় মোটা মোটা কাঠ নিয়ে এসে, চিতা সাজিয়ে সেখানে মৃতদেহ শুইয়ে দাহকাজ করা হতো। এখনও অনেক জায়গায় এমনটা হয়। তবে প্রযুক্তি এসে এই ব্যাপারটিকে খানিক বদলে দিয়েছে। এখন কাঠ নয়; বৈদ্যুতিক চুল্লিই ভরসা। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে একের পর এক বৈদ্যুতিক চুল্লি সেই কাজটিই করে চলেছে প্রতিদিন। তার পেটের ভেতর জন্ম-মৃত্যু, পাপ-পুণ্যের হিসেব হচ্ছে নিয়মিত।

চিতা সাজিয়েই হোক বা বৈদ্যুতিক চুল্লি, বিজ্ঞানীরা বলছেন, দূষণ দুই পদ্ধতিতেই হয়। চিতা সাজিয়ে দাহকাজ করলে মানুষ তো পোড়েই; সঙ্গে পোড়ে ওই কাঠ, কাপড়, ফুল, ঘি সহ অন্যান্য দ্রব্য। তারপর সেই জিনিসগুলো জলে ফেলা হয়। পোড়ানোর ফলে ক্রমাগত বেরোতে থাকে বিষাক্ত কার্বনযুক্ত ধোঁয়া। আর সেটা পরিবেশে মিশে আখেরে বাকিদেরও ক্ষতি করছে। আর জলে সেই অবশিষ্ট অংশ ফেললে সেটাও দূষিত হচ্ছে। বৈদ্যুতিক চুল্লির ক্ষেত্রে এই বিষাক্ত, ক্ষতিকারক গ্যাসের ব্যাপারটা একই থাকছে। প্রতিবছর কয়েক লক্ষ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে স্রেফ দাহকাজের ফলে। আখেরে এতে পরিবেশেরই ক্ষতি হচ্ছে।

এরপর আসা যাক কবর দেওয়ার প্রসঙ্গে। ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে, কফিন কিনে তাতে মৃতদেহ শুইয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় কবর দেওয়া হয়। এর ফলে কফিন বাক্সে থাকা কাঠ আর ধাতু মাটি, জলের সংস্পর্শে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে বিক্রিয়া করে। কফিনের রং থেকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশে যায় মাটিতে। ফলে ওখানকার মাটি দূষিত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে জলও দূষিত হয়ে পড়ে। হয়তো এখানে বায়ুদূষণ হচ্ছে না; কিন্তু দূষণ যে একেবারে বন্ধ নেই, তা একদমই নয়।

আরও পড়ুন : “আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি”, মৃত্যুর একদিন আগেই নিয়তির আঁচ পেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?

প্রথাগত সৎকার কাজের ক্ষেত্রে এমনই বিভিন্ন বাধা সামনে আসে। দাহকাজের ক্ষেত্রে যেমন দূষণ ছড়ালেও তাড়াতাড়ি সৎকার কাজ হয়ে যায়। কিন্তু কফিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একেবারে অন্যরকম। দাফনের ক্ষেত্রে মূল নিয়মই হল, মৃতদেহকে একেবারে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দাও। স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের দেহ পচবে, একটু একটু করে ব্যাকটেরিয়া নিজের কাজ শুরু করবে। একটা সময় পর চামড়া-মাংস গলে গিয়ে কেবল কংকাল পড়ে থাকবে। পরে সেটিও মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।

কিন্তু কফিনের মধ্যে দেহ রেখে কবর দেওয়া হলে এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হতে অনেক সময় লাগে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ মাটিতে কবর দিলে দেহটি কঙ্কালে পরিণত হতে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। পৃথিবীর জনসংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে। কবর দেওয়ার জায়গা কমছে। দাহ করলে দূষণ হবে। ৪০ বছর অপেক্ষা করা তো যাবে না! কারণ, এই সময়টা না পেরোলে সেখানে আর কবরও দেওয়া যাবে না। সেখান থেকেই বিজ্ঞানীদের ভাবনা শুরু। এমন কিছু ভাবতে হবে, যা পরিবেশ দূষণও করবে না; অথচ দ্রুত মৃতদেহকে পচিয়ে কঙ্কাল করে দেবে।

বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, মাটির মধ্যে যদি অনেক মাত্রায় বালি আর পাথর থাকে, তাহলে সাধারণের ঠেকি অনেক দ্রুত গতিতে দেহ কঙ্কাল হয়ে যায়। কেন? সাধারণ মাটির থেকে বালিভর্তি মাটিতে ফাঁকা জায়গা বেশি থাকে। ফলে হাওয়া, অক্সিজেন চলাচলের জায়গা পাওয়া যায়। ফলে ব্যাকটেরিয়াও নিজের কাজ অনেক ভালোভাবে, দ্রুতগতিতে করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বালিমাটিতে কবর দিলে একটি দেহ ১০ বছরেরও কম সময় কঙ্কাল হয়ে যায়!

আরও পড়ুন : মৃত্যুর পরে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলের কী হয়? ‘ডিজিটাল উইল’-এর যে তথ্য অজানাই

এছাড়াও বিজ্ঞানীরা একটি বিকল্প রাস্তার কথাও সামনে এনেছেন। যার নাম ‘এয়েরেটেড টম্ব’। বিগত ২০ বছর ধরে এই ব্যাপারটি ইউরোপের বেশকিছু দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে। সেখানে একটি বিশেষভাবে তৈরি কবরের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে অনেক ভেন্টিলেশন সিস্টেম থাকবে। মানে, আরও বেশি করে যাতে হাওয়া বাতাস চলতে পারে। যত বেশি অক্সিজেন খেলবে, তত তাড়াতাড়ি মৃতদেহের গতি হবে। এই বিশেষ কবরে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ফিল্টার থাকবে, যা পচা গন্ধকে নির্মূল করবে। সেইসঙ্গে দেহ পচতে আরম্ভ করলে যে তরল বের হবে, সেগুলোকে শুষে নেওয়ার জন্য দুটো বিশেষ পাউডার থাকবে। এগুলি সেই দূষিত তরলকে শুষে নেবে। সবথেকে বড় কথা, এটিকে রিসাইকেল করা যাবে। মানে বারবার ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও কোনও অসুবিধা নেই! কিন্তু ধর্মীয় প্রথা সরিয়ে ‘স্মার্ট কবর’-এ দেহ সৎকার কি করবে কেউ? সেটাই এখন প্রশ্ন।

More Articles