প্রকাণ্ড ডানা, অপার্থিব সৌন্দর্য! মহাকাশে কীভাবে লুকিয়ে দানবাকৃতি মহাজাগতিক প্রজাপতি?
Butterfly Nebula: তারাদের মৃত্যু যে এত রঙিন হয়, তা না দেখলে আন্দাজ করা শক্ত।
দুপুরে বা বিকেলে বাগানে প্রজাপতির আনাগোনা দেখতে পছন্দ করেন না, এরকম বেরসিক লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। প্রজাপতির ডানায় তো রং বেরঙের খেলা। আচ্ছা, আমরা যে প্রজাপতিদের দেখি, তাদের ডানার দৈর্ঘ্য কত বলুন তো? ওই মেরেকেটে ১০ সেন্টিমিটার। ডানাগুলো যদি দৈর্ঘ্যে আরও একটু বড় হতো, তাহলে কী মজাই না হতো! আরও রঙ, আরও সৌন্দর্য! কেন এমন হলো না? খুব একটা হতাশ হওয়ার অবশ্য কারণ নেই। এই একই ধরনের প্রজাপতি মহাশূন্যেও দেখা যায়। তাদের ডানা বিশাল বড়, প্রায় তিন আলোকবর্ষের সমান বা তার চেয়েও হয়তো বড়। আমাদের থেকে এই প্রজাপতিরা প্রায় ৩ হাজার ৩৯২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। বিজ্ঞানীমহলে তা অবশ্য NGC 6302 নামে পরিচিত। মহাশূন্যের প্রজাপতি! এমনও আবার হয় নাকি? হ্যাঁ! হয়, এদের পোশাকি নাম 'বাটারফ্লাই নেবুলা' অর্থাৎ 'প্রজাপতি নীহারিকা'। ২০০৯ এবং ২০২০ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের অত্যাধুনিক ক্যামেরায় ধরা পড়েছে সেইসব মনোরম দৃশ্য। এই 'প্রজাপতি নীহারিকার’ সৌন্দর্যে বিভোর মহাকাশপ্রেমীরা।
নেবুলা কী? ল্যাটিন শব্দ ‘নেবুলা’-র অর্থ ‘কুয়াশা' বা 'মেঘ’। বিজ্ঞানীমহলে যদিও এরা নীহারিকা নামেই বেশি পরিচিত। সাধারণত ধুলো, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও আয়নিত গ্যাসের আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘকে নীহারিকা বলে। স্বীয় ভাগ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ছাড়াও এর ভিতরে খুবই অল্প পরিমাণে কার্বন, নাইট্রোজেন, সালফার, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন প্রভৃতি উপাদান পাওয়া যায়। মহাশূন্যের এই সমস্ত আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম বা ইন্টার গ্যালাক্টিক মিডিয়ামেই নীহারিকাদের আবাস। সোজা কথায় বললে, তারাদের মাঝের যে ফাঁকা জায়গা, সেখানেই এদের বসতি। প্রজাপতি নীহারিকার বাইরে তেমনই মেঘের আচ্ছাদন রয়েছে, যেখানে রং-বেরঙের খেলা চলছে অবিরত। আর তাতেই সুন্দরতম হয়ে উঠেছে মহাকাশের এই বাসিন্দা। প্রজাপতির মতো দেখতে বলে এদের নাম হয়েছে ‘বাটারফ্লাই নেবুলা’ বা 'প্রজাপতি নীহারিকা'।
আরও পড়ুন- মহাশূন্যে বিলীনও হয়ে যেতে পারেন সুনীতারা! কেন জানেন?
সাধারণত কোনও নক্ষত্রের জ্বালানি যখন তলানিতে এসে ঠেকে, অর্থাৎ সে অন্তিম সময়ে এসে পৌঁছয়, তখন তার ভিতরের কণাগুলি একে অপরকে প্রবলভাবে টানতে থাকে। ক্রমাগত এ টানের দরুন নক্ষত্রগুলো সংকুচিত হতে হতে একসময় হঠাৎ করে ফেটে যায়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘সুপারনোভা’। সে এক রঙিন ব্যপার! তারাদের মৃত্যু যে এত রঙিন হয়, তা না দেখলে আন্দাজ করা শক্ত। এই বিস্ফোরণের ফলে ধুলো, গ্যাস ও প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, যা চারপাশের গ্যাসীয় পদার্থগুলিকে আয়নিত করে তোলে। সেজন্য সুপারনোভার ফলে বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যের সৃষ্টি হয়। বিস্ফোরণের ফলে উদ্ভুত উপাদানগুলো আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিকর্ষজ সঙ্কোচনের কারণে কাছে আসতে থাকে। এর পোশাকি নাম 'মহাকর্ষীয় সংবন্ধন' বা 'গ্রাভিটেশনাল কোলাপ্স'। এর ফলে ধীরে ধীরে আন্তঃনাক্ষত্রিক উপাদানগুলি জোট বাঁধতে থাকে। একসময়ে গিয়ে সুপারনোভার ধ্বংসস্তূপ থেকেই জন্ম হয় নীহারিকার।
বাটারফ্লাই নেবুলাগুলো মূলত প্ল্যানেটারি নেবুলা ধরনের। আকারের জন্য এদেরকে বাইপোলার বা দ্বিপদী নেবুলাও বলে। সাধারণত দুইটি পাশাপাশি অবস্থিত নক্ষত্রের (অর্থাৎ বাইনারি নক্ষত্রতন্ত্রের ক্ষেত্রে) জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে, এদের কেন্দ্রগুলি একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে বিপরীত দিকে ধাবমান দু'টি স্রোত বা জেট বেরিয়ে আসে। তাদেরকে ঘিরে থাকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাস ও ধূলিকণার মিশ্রণ। তার থেকেই সৃষ্টি হয় প্রজাপতির মতো বর্ণময় মহাজাগতিক ডানা। ১৮৩২ সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ স্যার উইলিয়াম হার্শেল সর্বপ্রথম এই 'বাটারফ্লাই নেবুলা' আবিষ্কার করেন। কেবল সৌন্দর্যের জন্যই নয়, আন্তঃনাক্ষত্রিক বিবর্তনের অজস্র রহস্যের জন্যও এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই চর্চিত মহাজাগতিক বস্তু।
আরও পড়ুন- মহাবিশ্ব মোটা হচ্ছে! এর বয়স কত? যেভাবে মেপেছিলেন এই বিজ্ঞানী
এছাড়াও মহাকাশে হরেক রকমের নীহারিকা দেখতে পাওয়া যায়, যাদেরকে বিভিন্ন ফুল, পোকামাকড়, বা প্রাণীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নামকরণ করা হয়। যেমন, যেসব নীহারিকারা বিড়ালের চোখের মতো দেখতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীমহল তাদের চেনে 'ক্যাটস আই নেবুলা' নামে, আবার একটু প্যাঁচালো কাঁকড়ার মতো দেখতে নেবুলারও হদিশ পাওয়া গেছে, যার নাম বিজ্ঞানীরা রেখেছেন 'ক্র্যাব নেবুলা'। এছাড়াও আছে 'এস্কিমো নীহারিকা', দেখতে গ্রিনল্যান্ডের বরফবাসী এস্কিমোদের মতো। আবার এক টুকরো লেবুর পাতলা স্লাইসের মতো দেখতে নেবুলার নাম 'লেমন স্লাইস নীহারিকা'।
এই মায়াবী মহাজাগতিক বস্তুর পরতে পরতে রহস্য লুকিয়ে আছে, যার সন্ধানে সেই প্রাচীনকালে গ্রিক জ্যোতির্বিদ ক্লডিয়াস টলেমি থেকে আধুনিককালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। গত দশক থেকে এমন হরেক রকমের বর্ণময় ছবি আমাদের উপহার দিয়ে যাচ্ছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এই নিবন্ধটি লিখতে লিখতেই, হাবলের শক্তিশালী ক্যামেরা হয়তো তাক করে আছে আরও একগুচ্ছ মহাকাশ সুন্দরীদের দিকে!