ব্যোমকেশের ভূমিকায় অনির্বাণের বিকল্প নেই, প্রমাণ করল 'পিঁজরাপোল'
Byomkesh O Pinjrapol Review: এই গল্পের শেষে যা ঘটে, শরদিন্দু নিজেই বলেন, তা হলিউডের দৃশ্য। এখানে আত্মহননের সেই দৃশ্যকল্প অনেক বেশি শরীরী, বাস্তব।
গ্রিক শব্দ 'প্যানপটেস'। এই নামে এক বহু চোখসম্পন্ন দৈত্য আছে। শব্দার্থ: 'অল-সিইং', 'সব দেখা যাচ্ছে'। আঠারো শতকের শেষভাগে, শিল্প বিপ্লবের পরে, রাশিয়া-ফেরত জেরেমি বেন্থাম খ্রিস্টিয় নৈতিকতার আদলে কারাগারের যে চেহারা ভাবলেন, তার নাম দিলেন, 'প্যানপটিকন'। বন্দিশালা যেন একটি বৃত্তাকার লোহার খাঁচা, খোপে খোপে ভাঙা, এক সুউচ্চ টাওয়ারের ওপর বসে এক সুপ্রিম নজরদার। এই যিনি নজরদারি করছেন, তিনি 'প্যানপটিকন'-এর ম্যানেজার। একেও আবার নজর রাখছে 'পাবলিক'। আইন ও ন্যায়ের কাঠামোর ভেতর মানবিক ছোঁয়াচটুকু আনবে এই পাবলিকের নজরদারিই, বেন্থামের ভাষায় যা 'পাবলিসিটি', আজকের পুঁজিনির্ভর পাবলিসিটির ধারণার সঙ্গে তার বিস্তর তফাত। অবশ্য যে রাশিয়ার আইন ও শাস্তির বহর দেখে বেন্থাম এই ধারণার অবতারণা করলেন, সেই রাশিয়া পালটে গিয়েছিল সোভিয়েতে পৌঁছে। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস অগস্ট বেবেলকে একটি চিঠি লিখেছিলেন উনিশ শতকের শেষে, যাতে বলা হলো, বৈধতার নতুন সংজ্ঞায়ন ঘটবে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। সোভিয়েতে তাই জারদের আইনতন্ত্র বাতিল হলো, আদালতই হলো আইনি সিদ্ধান্তের শেষতম ঠিকানা। আবার বিশ শতকের শেষে মিশেল ফুকো তাঁর 'ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দ্য বার্থ অব প্রিজন'-এ প্যানপটিকনকে দেখলেন রাষ্ট্রীয় নজরদারির সমীকরণে, কারাগার বা বন্দিশালা সেখানে হয়ে উঠল প্রতিষ্ঠান।
বাঙালির সাধের নবজাগৃতি ও বাবুদের রঙিন জীবনে প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিলেন মেকলে, তাঁর নিষ্ঠুর শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে। শুধুই 'এপিস্টেম' বা জ্ঞান আহরণের জন্য পাশ্চাত্য সাহিত্য ধার দেওয়ার মধ্যে আলোকায়নের আভাস ছিল, মেকলে তাকে দাঁড় করালেন উপযোগিতাবাদে। এরপরেও চাকুরিজীবী বাঙালি রামকৃষ্ণর ভক্তিমার্গ ও বঙ্কিমচন্দ্রদের বাঙালির ইতিহাস সন্ধানে ব্রতী হয়ে, প্রগতি ও নারীশিক্ষার পক্ষে সওয়ালের পাশাপাশি ফুলশয্যার আইনের বিরোধিতা করে দিব্য চালাচ্ছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গর আগেপরেই শুরু হলো গোলমাল। তারপর আলিপুর বোমা মামলায় বাঙালির নাড়িনক্ষত্রে বাঁকবদল এল, অগ্নিযুগের সেই বাঙালি খোদ রবীন্দ্রনাথের মনেও বিস্ময় জাগিয়েছিল। এসবের পর রাজধানী বদলাল। ক্রমে গ্লানি ও ক্লেদের ছাপ লাগল বঙ্গজনের যাপনে। চারের দশকে বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, লেজুড় হলো দেশভাগ, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। এই ইতিহাসের পুনরুচ্চারণ এই কারণেই, চিত্রনাট্যকার প্রতীক দত্ত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চিড়িয়াখানা' নিয়ে 'হইচই'-এর ব্যোমকেশের নবতম, অর্থাৎ অষ্টম সিজনটিকে এনে ফেলেছেন ১৯৫১ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। স্বাধীনতা, দেশবিভাগ ও তার পরবর্তী দাঙ্গার রক্তের দাগ শুকোতে না শুকোতেই গান্ধী হত্যা ঘটেছিল। মাঝে ছিল তেভাগা, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, তেলেঙ্গানা আন্দোলন ইত্যাদি নানাবিধ। তারপর নবগঠিত সংবিধানের দেশে প্রথম ভোট হল। এমন এক পরিস্থিতিতে 'চিড়িয়াখানা'-র গল্পকে প্রতিষ্ঠা করলেন প্রতীক, নাম দিলেন 'ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল' ('ব্যোমকেশ' অবশ্য এই সিরিজটির মূল শিরোনাম)।
শরদিন্দু এই গল্প লিখেছেন বটে ১৯৫৩ সালে, কিন্তু গল্পের শুরুতেই সময়কালের উল্লেখ নির্দিষ্ট- 'দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরের ঘটনা।' অর্থাৎ, স্বাধীনতা আসবে আসবে করছে, এবং ব্যোমকেশের সাহিত্যভুবনে অবশ্য স্বাধীনতা নির্দিষ্ট হবে এই সিরিজের 'ম্যাগনাম ওপাস' 'আদিম রিপু'-র শেষে, প্রভাতের স্বীকারোক্তি ও তার পিতৃপরিচয় উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীন দেশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, দেশভাগেরও আগের এক কলোনির সন্ধান দিয়েছেন শরদিন্দু, যার নাম 'গোলাপ কলোনি'। তাকে কেউ বলে 'চিড়িয়াখানা', কেউ বলে 'পিঁজরাপোল'। অজিত ভাবে, 'এই দুই নামই সার্থক।' প্যানপটিকনের ধারণায় দেখলে, এই পিঁজরাপোল, অর্থাৎ অচল গবাদি পশুর আখড়ার কাঠামোই স্পষ্ট হয়, যেখানে সামাজিক অচল মুদ্রাদের বাস। যেখানে মুস্কিল মিঞা, 'সব দেখছি'- এই চেতাবনি দিয়ে যায় একবার। মনে পড়ে যাবে 'প্যানপটেস' বা 'অল সিইং'। তখনও সংবিধান তৈরি হয়নি, দেশজ আইন হয়নি, সেসময় হয় যারা গর্হিত কাজ বা অপরাধ করেছে নয়তো যাদের প্রতিকূলতা আছে শারীরিক, তাদের নিজের ফুলকলোনিতে জায়গা দেয় এক জজসাহেব, নিশানাথ।
আরও পড়ুন- কেন বারবার ব্যোমকেশই জিতে যায়? ফেলুদা-কিরীটির থেকে কোথায় এগিয়ে সে!
'ভূস্বর্গ ভয়ংকর' গল্পে সত্যজিৎ রায় সুশান্ত সোম নামে এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির হত্যাকাণ্ড ঘিরে ঘনিয়ে ওঠা এক রহস্য হাজির করেছিলেন, কাশ্মীরের প্রেক্ষিতে। সত্যজিৎ অতীত জীবনের প্রায়শ্চিত্ত বারবার এনেছেন গল্পে। এই গল্পেও প্রায়শ্চিত্তর আভাস খুবই স্পষ্ট। সেজন্যই তিনি সহকারীদের অনুরোধে যখন ব্যোমকেশের চিত্রনাট্য লিখেছেন, তখন 'চিড়িয়াখানা' বেছে নিয়েছিলেন কিনা বলা কঠিন। যাই হোক, সত্যজিৎ ছবির শুরুতেই নিশানাথের চরিত্রের একটি সংলাপ রেখেছিলেন (সুশীল মজুমদার ছিলেন সেই চরিত্রে), "কী জানেন ব্যোমকেশবাবু, এটাকে আপনি আমার প্রায়শ্চিত্তর একটা অঙ্গ বলে ধরে নিতে পারেন।" 'প্রায়শ্চিত্ত' শব্দটা এখানে নেহাত কায়দায় ঢোকানো নয়, নিশানাথ ছবিতে পরিষ্কার নিজের জজিয়তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। প্রতীকের চিত্রনাট্যে 'হইচই'-এর ব্যোমকেশের নতুন সিজনে নিশানাথ এই দ্বন্দ্বে ভোগে কিনা, বলা মুশকিল। তবে তাঁর সংলাপে এক অন্য খেলা খেলেছেন প্রতীক, স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের প্রথম উদযাপনের মুখে দাঁড়িয়ে সে বলে তার পিঁজরাপোলের বাসিন্দাদের নিয়ে, "আই ডিজার্ভ ডেমোক্রেসি, দে ডোন্ট।" উল্লেখ্য, এই বাক্যের প্রতি সংশয় রাখে ব্যোমকেশ, শেষ এপিসোডের শেষ সংলাপে।
গণতন্ত্র সকলের জন্য নয়, তারও শ্রেণি আছে, সামাজিক বর্গ আছে, একথা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু একথাটা কয়েকজন শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভোগা মানুষ ও একঝাঁক অপরাধীদের নিয়ে যখন বলে নিশানাথ, তখন সে আপনা থেকেই নৈতিক একটি পেডেস্টাল তৈরি করে নেয়। স্বাধীনতার পরের গল্প 'মগ্নমৈনাক' চিত্রিত হয়েছে এই 'ব্যোমকেশ'-এর ষষ্ঠ সিজনে। কিন্তু এই গল্পের সিরিজায়নে খুব বুদ্ধি করে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আগে কয়েকজন সম্ভাব্য বা অসম্ভাব্য ভোটারের ভেদরেখাকে প্রকট করে তোলায়, প্যানপটিকনের এক অন্যতর দার্শনিক ব্যাপ্তি পাওয়া গেল দর্শক হিসেবে। স্বাধীনতার আভাস এখানে ভাষাহীন পানুর আকাশে সবিস্ময়ে বারবার বিমান দেখায় প্রস্ফুট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে ব্যোমকেশ-অজিতের সংলাপে, নিশানাথের সংলাপে। গল্পের শুরুতে শরদিন্দু ব্যোমকেশকে দিয়ে বলিয়েছেন, নিশানাথের মানুষ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এখানে ব্যোমকেশ সরাসরি প্রশ্ন করে নিশানাথকে, মানুষের ওপর তার অশ্রদ্ধা আছে কিনা। নিশানাথ বলে শ্রদ্ধার কারণ সে খুঁজে পায় না। তাই পিঁজরাপোল, অর্থাৎ মানুষ হয়েও যাদের যাপন গৃহপালিত বলদের মতো, তাদের পুষে রাখার ওই প্যানপটিকনে বিশ্বযুদ্ধ-দাঙ্গার পরে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর পাপটা করে বসেছে যে নিশানাথ, এবং তা নিয়ে লজ্জিতও যে নয়, সে সামাজিকভাবে কোণঠাসা কয়েকজন, যাদের সে তার তথাকথিত 'আশ্রম'-এ আশ্রয় দিয়েছে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বেমালুম অস্বীকার করে বসে। আবার দাঙ্গা-পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে বদলে যায় অজিতের সাহিত্যবয়ান। অজিতকে শরদিন্দুর ফিকশনাল চেহারা ভাবায় কোনও অন্যায় ছিল না, বিশেষত, এই গল্পের শুরুতেই অজিত বলে, 'উলল্লাট' সাহিত্যিকরা তাকে 'কলকে' দেয় না, কারণ সে গোয়েন্দাকাহিনি লেখে। শরদিন্দু নিজেও পাঁচকড়ি দে-দীনেন্দ্রকুমারের রহস্য লহরীর পাল্প পেরিয়ে ব্যোমকেশ লিখতে শুরু করে কিঞ্চিৎ বেগ পেয়েছিলেন, তাঁকেও এডগার অ্যালেন পো-র মতো মহান সাহিত্যিকের নাম করে বলতে হয়েছে, 'গোয়েন্দা গল্প' বা 'রহস্য গল্প' লিখে তিনি আদৌ লজ্জিত নন। তাই অজিতকে অঞ্জন দত্তও 'প্রিজনার অব জেন্ডা'-র সূত্র ধরে 'ঝিন্দের বন্দি' লেখার রেফারেন্স দিয়ে শরদিন্দুর আদল দিয়েছেন। কিন্তু এখানে অজিত যখন 'সময়টাই তো উপযুক্ত নয়' বলে সাদাত হাসান মান্টো-র স্মৃতি উসকে দিল, তাতে অজিত শরদিন্দুকে পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছল স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের সময়খণ্ডে। রেডিওতে নির্বাচন ও ভাষা আন্দোলনের খবরের ভাষা এবং প্রয়োগ, দুইই এক্ষেত্রে সময়োপযোগী।
'চিড়িয়াখানা' গল্পের এক মজা ছিল, চরিত্ররা থাকে মোহনপুরে, যা শিয়ালদা স্টেশন থেকে কয়েক মাইল, রেলের লাইনেও পড়ে না, কিন্তু চরিত্রদের সকলেরই যাতায়াত কলকাতায়। পুলিশি ব্যবস্থা আসার পর কলকাতা যে চেহারা নিল, তাকে সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'City of Pigeonholes', পায়রার খোপের শহর। আরেকরকমের নজরদারির প্যানপটিকন বলা চলে। 'গোলাপ কলোনি'-র ফুল নিয়মিত আসে কলকাতায়। বিজয়, নিশানাথের ভাইপো আসে কলকাতায়, সে বনলক্ষ্মীকে খুঁজে পায় সেখানেই। রসিক যায় কলকাতায়, ভুজঙ্গধর চুপিসারে আসে কলকাতায়। এইভাবে কলকাতা হয়ে ওঠে 'বীভৎস মজা'-র সেই ঠিকানা, যা শহর থেকে দূরের পিঁজরাপোলের বাসিন্দাদের টেনে আনে। আর এই টান অপরাধেরও। এরিক হবসবম মার্কসীয় নিরিখে অপরাধীদের 'সোশ্যাল ব্যান্ডিটারি'-র ঝোঁকের কথা বলেছিলেন, 'ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল'-এ স্বাধীন দেশের কয়েকজন অপরাধী বা অপরাধপ্রবণ লোভী মানুষের কলকাতা আসার ঝোঁক অনুচ্চকিত হলেও রয়েছে। ভুজঙ্গধর সরাসরি অপরাধ ও অপরাধীর প্রয়োজন যখন মনে করিয়ে দেয় ব্যোমকেশকে, তখন দস্তয়েভস্কির রাসকোলনিকভ বা কাফকার জোসেফ কে. উঁকি মারতে পারে। ভুজঙ্গধর দাঙ্গার পরেও ধর্ম নিয়ে উৎসাহের কারণ খুঁজে পায় না, ব্রজকে বলে, "আপনাদের সংবিধানে কোনও অ্যামেন্ডমেন্ট নেই, না?" স্বাধীন দেশে সে মান্য বিবিধ 'কোড'কে অস্বীকার করতে চায়। আইন হোক বা সামাজিক রীতিনীতি, কোনওটাতেই তার মান্যতার মন কাজ করে না। পানুগোপালও নিশানাথের যাওয়ার পথে থুতু দেয়, সেই অস্বীকৃতি প্রকট হয়।
এই অনুচ্ছেদ শুরু করার আগেই স্পষ্ট বলে রাখা দরকার, স্পয়লার অ্যালার্ট বলে যে বিউগলটা দর্শকের উদ্দেশে বাজানো হয়, তা এখানে সজোরে বাজবে। যদিও ব্যোমকেশ বহুপঠিত ও দীর্ঘদিনের বেস্টসেলার, তবুও এক বড় অংশের দর্শক এখনও ব্যোমকেশ না পড়েই ব্যোমকেশ দেখেন, এমন ভাবায় কোনও অন্যায় নেই। সত্যজিৎ আশ্চর্যভাবে যখন এই গল্পের দু'টি খুন দেখিয়েছিলেন, তখন তিনি কলোনির সকলের অ্যালিবাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আর ভুজঙ্গধরকে দেখাননি, তার সেতারের সুর আবহে রেখেছিলেন। 'পিঁজরাপোল'-এ খুনের দৃশ্যায়ন অন্যরকম, কিন্তু একটি ব্যাপারে সত্যজিৎ-অনুসারী। সত্যজিৎ খুনের মোডাস অপারেন্ডি শরদিন্দু থেকে নেননি। শরদিন্দু দু'টি জটিল খুনের পদ্ধতি রেখেছিলেন এই গল্পে, নিশানাথের খুনে পায়ে মোজা পরিয়ে দড়ি টাঙিয়ে ব্লাডপ্রেশার মাথায় উঠিয়ে খুন, দ্বিতীয়ত, পানু, যার 'অ্যাডেনডয়েড'-এর সমস্যা আছে বলে গল্পে উল্লেখ, তার কানের ওষুধে বিষ মিশিয়ে খুন, আর পুরনো একটি খুন, মুরারি দত্তর, সেখানে নিকোটিনের বিষে খুন। নিশানাথ সুনয়নার খোঁজ করে, যে চলচ্চিত্রের প্রাক্তন নায়িকা, সে নাকি এমন মেকআপ করে, তাকে চেনাই যায় না। এই মেকআপের প্রসঙ্গ ছিল দর্শককে ঘাঁটার জন্য, যাকে থ্রিলারের ভাষায় 'রেড হেরিং' বলা চলে, কিন্তু ডাক্তার ভুজঙ্গধর যে 'এমনকী' প্লাস্টিক সার্জারিও জানে, সেকথা প্রথমেই নিশানাথ বলে ব্যোমকেশকে। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এক বাস্তবের ডাক্তারের কথা বলেছিলেন, যে জাল ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসা করত, পরে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে খুন করতে শুরু করে কিছু লোককে, এমন ওষুধ প্রয়োগ করে, যাতে তা স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হয়। কাজেই এমন অপরাধী এবং চিকিৎসার ফাঁকফোকরে পটু ডাক্তার ছিল বটে, কিন্তু নিশানাথের ওই কথা আর খুনের মোডাস অপারেন্ডি মিলিয়ে দুয়ে দুয়ে চার করে ভুজঙ্গধরকে খুনি বলে ধরে নিতেও কোনও অসুবিধা হয় না। সেই কারণেই মোডাস অপারেন্ডি বদলে, নিশানাথের মৃত্যুকে একেবারেই স্বাভাবিক মৃত্যু ও পানুর হত্যাকে পরিষ্কার খুনের চেহারা দেওয়া হয়েছে এখানে বোধহয়। ধারালো যে অস্ত্রে পানু মরে, তা যে সার্জিক্যাল নাইফ, তাও শেষে জানা যায়। আর হুডানিটের মতো কোনও গোলটেবিল বৈঠক নেই, ব্যোমকেশের ছদ্মবেশ আছে বটে, তবে তা নিতান্তই চোখে পড়ার মতো নয়। শুধু অপরাধীদের ব্যোমকেশ অল্প করে জানিয়ে দেয়, সে সত্য জেনে নিয়েছে। বাদবাকি কাউকেই কিছু বলে না। তারপর ব্যোমকেশ বাড়ি ফিরে আসে, অপরাধীরা আত্মহত্যা করে, এই ঘটনা, নির্দ্বিধায় বলা চলে, অনেক বেশি ব্যোমকেশসুলভ। এই গল্পের শেষে যা ঘটে, শরদিন্দু নিজেই বলেন, তা হলিউডের দৃশ্য। এখানে আত্মহননের সেই দৃশ্যকল্প অনেক বেশি শরীরী, বাস্তব।
আরও পড়ুন- ‘দরকার হলে সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, কিন্তু সৎভাবে করব’: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
নিশানাথের কালো চশমা, কালো কোট নিঃসন্দেহে সত্যজিতের 'চিড়িয়াখানা'-কে সযত্ন ছুঁয়ে যাওয়া। সত্যজিৎ সংলাপে যতটা মিনিমাল ততটাই স্টাইলাইজড ছিলেন, ভালো লাগল, এক্ষেত্রেও কিঞ্চিৎ তাই ঘটেছে। ব্যোমকেশ নিশানাথকে যখন, "ওর গ্রাম কোথায়?"-এর মতো একটি গোয়েন্দামার্কা প্রশ্ন করার পরেই "আপনাদের শৌচালয়টা কোথায়?" বলে, তখন হালকা হাসির আবহ লেগে থাকে। বিজয়কে সে বলে, "আপনি গেলেও অসুবিধে নেই।" বিজয় বলে, "না গেলেও অসুবিধে নেই তো?" সত্যজিতের ব্যোমকেশে উত্তমকুমারীয় স্টাইলে "শার্লক হোমসও কিন্তু ভায়োলিন বাজাতেন, আমিও বাজাই, গ্রামোফোন"-এর সংলাপে প্রখর বুদ্ধির ছাপ লেগে থাকে। এক্ষেত্রে, "সেতারটা আপনি বাজাচ্ছিলেন না পুরোটাই কল্পনা?" (ভয়াবহ স্পয়লার অ্যালার্ট) চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ, এমনকী, দুই অপরাধীকে যেসব সংলাপ ব্যোমকেশ দেয়, যা লেখার লোভ হলেও দর্শকদের কথা ভেবে লিখছি না, সেগুলি সবকটাই চমৎকার। এখানে অবধারিত আসবে অভিনয় প্রসঙ্গ, তবে সে বিষয়ে পরে আসা যাবে।
এখানে একটি মূল আখ্যানসূত্র বাদ দেওয়া হয়েছে, সচেতনভাবেই। বনলক্ষ্মীর সুনয়না বা নেত্যকালী হিসেবে অতীতটুকু। তাই জন্য এখানে আসেনি রমেন মল্লিক, আসেনি প্লাস্টিক সার্জারির প্রসঙ্গ, আসেনি সিনেমা বা বায়োস্কোপের প্রসঙ্গ, সত্যজিতের 'ভালবাসার তুমি কি জানো' গানের রেফারেন্সের মতোও কিছু নেই, মুরারি দত্ত খুনের প্রসঙ্গ নেই, আসেনি গল্পে উল্লিখিত বনলক্ষ্মীর নকল দাঁতের প্রসঙ্গে 'দন্তরুচি কৌমুদী'-ও। আছে বনলক্ষ্মীর সূচ বোনা, যার রেফারেন্সে অজিতের স্বপ্নে বনলক্ষ্মীর দাঁত না এলেও আসে সূচ হাতে সত্যবতী, যা 'অর্থমনর্থম'-কে সহজেই মনে করাবে। গোলাপ কলোনি এখানে 'রোজি ম্যানসন', তার মধ্যে একটি চমৎকার তাজমহলসুলভ প্রেমের ইতিহাস প্রোথিত। গোলাপের বাগান এখানে পটুয়াটুলি, মাটির ভাঙাগড়ার মধ্যে স্বাধীন দেশের কাঁচা অবস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে খিদে, একেবারে রগরগে, ভণিতাহীন যৌন আভাস। নজর আর পানুর সিডাকশনের দৃশ্য চোখে লেগে থাকে সেই কারণেই, যার আভাস প্রথম দৃশ্যে নজরের কাপড় কাচা ও পানুর মাটি লেপায় ছিল। পানু মারা যাওয়ার পর নজরের কথা না বলা, নতুন একজনের প্রতিস্থাপন সিরিজের গল্পকে আরও গতি দেয়, অন্য মাত্রাও দেয়। গাড়ি এসেছে গরুর গাড়ির জায়গায়, অথচ রসিকের সংলাপ, "এর চেয়ে গরুর গাড়িতে চড়া ভাল।" গল্পকে রেখেও না রাখার এই কায়দাগুলি কেয়াবাতযোগ্য বটে।
অভিনয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আগে বলে রাখা ভালো, মূলত নাটক ও অন্য পর্দার মুখরা এখানে আছেন, যাঁরা তথাকথিত লব্ধপ্রতিষ্ঠ নন কেউই। কিন্তু প্রত্যেকেই মন দিয়ে অভিনয় করেছেন। নিশানাথের চরিত্রে বাবু দত্তরায় রাশভারী, রসিক, গম্ভীর, বিষণ্ণ- সব অনুভূতি চমৎকার ধরেছেন। মনে থেকে যাবে বিজয়ের চরিত্রে সৌমিক মৈত্রর নিচু তারে বাঁধা অভিনয়। রসিকের চরিত্রে সুমন্ত রায়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিছুক্ষণের খণ্ডিত উপস্থিতিতেই তিনি অসাধারণ! অনুষ্কা চক্রবর্তীর বনলক্ষ্মীকে ভাল লাগে। গল্পে নিশানাথ বলে, এই পিঁজরাপোলের সকলেই ভদ্রশ্রেণির, তাই কলঙ্কের অতীত (যা প্রশ্নাতীত নয়) সত্ত্বেও কথায় শিক্ষার ভাব থাকা অসম্ভব লাগেনি মোটেও। মৈত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপা অভিনয়ও উপভোগ্য। মুকুলের চরিত্রে সম্পূর্ণা মণ্ডল দৃঢ় এবং পেলব একইসঙ্গে। নজর কাড়তে বাধ্য নজর বিবির ভূমিকায় দীপান্বিতা সরকারের প্রায় সংলাপহীন সূক্ষ্ম মজার অভিনয়। দুর্বার শর্মা ভুজঙ্গধরের চরিত্রে মাপা, সংযত। বাকিরাও ছন্দপতন ঘটান না। ঋদ্ধিমা ঘোষ আরও পরিণত হয়ে উঠছেন প্রতি সিজনে সত্যবতী হিসেবে, তাঁকে যতটা সাবলীল লাগে, ততটাই তাঁর অভিনয়ের কিছু খুঁটিনাটি ধরা পড়ে। অজিতের ইঙ্গিতে চা চাওয়ার পরের নির্লিপ্তি বা হাসিও তেমন। ভাস্বর চট্টোপাধ্যায় দৃশ্যত মানানসই অজিত, তবে তাঁর অভিনয়ে নিরীহ ভাব কিছুটা চোখে পড়ল। ব্যোমকেশ-অজিতের রসিকতাতেও ততটা ধারালো নন তিনি, সিজন থেকে সিজনে তিনি আরও তীক্ষ্ণ হবেন নিশ্চয়ই।
এবার বলতে হবে ব্যোমকেশরূপী অনির্বাণ ভট্টাচার্যর কথা। এই লেখায় তাঁকে নিয়ে বললে বিপত্তি বাড়তে পারে, কারণ এই পরিসরে তাঁর অভিনয় নিয়ে মুগ্ধতার বিষয়ে বলে স্থান সংকুলান হবে না। আর অভিনয় এমনই গোলমেলে জিনিস, তাকে ভাষায় ব্যাখ্যা করার বিশেষ দক্ষতা লাগে, যা এই মুসাবিদাকারের নেই। শাস্ত্র সরিয়ে যেকথা একটু বুক ঠুকেই বলা যায়, অতীত অতীতই, এখন বাংলায় তিনিই যোগ্যতম ব্যোমকেশ। কারণ? প্রথমটি হল, তাঁর নির্বিকল্প উচ্চারণ। দ্বিতীয়ত, তিনি জানেন, পাঁচের দশকের ভঙ্গিতে কেমন করে কথা বলতে হয়। তৃতীয়ত, ব্যোমকেশের রসবোধ, খামখেয়ালিপনা ও রাগ, তিনটেই তিনি বোঝেন। বিজয় যখন বলে, "কাকার টাকা আমার টাকা, আমি নিয়েছি", তখন "তা বেশ" বলার মধ্যে চমকে দেওয়া রসবোধ। এই সিজনে ব্যোমকেশের পেটখারাপ একটি অনবদ্য সংযোজন। এই গল্পে ব্যোমকেশের চরিত্রকে তা অনন্যতা দিয়েছে। একই সঙ্গে অনির্বাণের অভিনয়ের রংয়ের তাসও হয়ে উঠেছে সেটিই। তিনি চশমা খুলছেন যেভাবে, মুখের মধ্যে কষ্ট ফুটিয়ে তুলছেন যেভাবে, সংলাপে যেমন চাপ সৃষ্টি করছেন, যেভাবে পেটে হাত দিচ্ছেন, তা অভিনয়ের মাস্টারক্লাস। একটু ঝুঁকে পড়ে নম্রস্বরে কোনও কথা বলার মধ্যে তাঁর ধারই অন্যরকম। সিগারেট ধরানোতেও তিনি পুরনো কায়দার অনুসারী। এই সিজনে ব্যোমকেশকে বয়স্ক এবং অসম্ভব রক্তমাংসের দেখিয়েছে, তা তিনি অভিনয়ে ধারণ করেছেন বলেই। চোখে বিস্ময় এবং আড়চোখে সন্দেহ ও কেরদানি, দুইই তাঁর করায়ত্ত, বা নয়নায়ত্ত।
সঙ্গে তাঁর নতুন পালক, এই সিরিজের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর তিনি। অনেকেই সিরিজের ক্রিয়েটর বিষয়টির সঙ্গে ততটা পরিচিত নন, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরও কিছুটা মেঘনাদ। কিন্তু মেঘনাদের নাম তিনি সার্থক করেছেন এই সিজনে, পরিচালক সুদীপ্ত রায়ের নেপথ্যে তাঁর ভূমিকাকে কুর্নিশ জানাতেও হয়। একটি সুতোর টুকরোও এখানে সময়ের সঙ্গে বেমানান নয়। নয়, তার বড় কারণ, ডিটেলিংয়ে ভার কমিয়ে আনা। ভারিক্কি ট্রানজিস্টর নেই, পোস্টার বা পত্রিকার প্রচ্ছদ দেখাতে গিয়ে পিরিয়ডের গুরুচণ্ডালি দোষ নেই, আছে কেবল সময়ের সঙ্গে মিলে যাওয়া ভাবলেশটুকু। পিরিয়ড পিসের ক্ষেত্রে এটি খুবই উপযোগী। ওপেনিং টাইটেল আন্তর্জাতিক যে কোনও নয়ার সিরিজের সঙ্গে মিলে যায়। দোসর হয়েছে সংগীত। সত্যজিৎ সেতারের আবহকে রহস্যময় করে তুলেছিলেন, সংলাপের টোন কমিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক কোনও আসরে শ্রোতা যেমন কথা বলবে আস্তে। কিন্তু পিঁজরাপোলের সেই বিলাসিতা থাকবে কেন? তাই হট্টমেলাতেই সেতার বাজে, মাঝে এরোপ্লেন যায় বিঘ্ন ঘটিয়ে। ভুজঙ্গধর-বনলক্ষ্মীর সাঁট যখন স্পষ্ট হয়, তখন মুকুলের হাসির সঙ্গে সেতারের আওয়াজ লেগে যায়, সেতারবাদন আরও জীবনের কাছাকাছি আসে। নেপাল গুপ্তর অতীতের আবহে কমিক আভাসও বেশ লাগে। 'এ পরবাসে'-র ব্যবহারও উপযুক্ত, বহুদিন বাদে এমন সুচিন্তিত রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার দেখা গেল। এমন সংগীত পরিকল্পনার জন্য শুভদীপ গুহকে কোনও বাহবাতেই বেঁধে ফেলা যাবে না। অয়ন শীলের লেন্স ও অল্প আলোর খেলায় পিঁজরাপোলের গ্লানি ডগমগে হয়ে ওঠে। ভাল লাগে শুভ প্রামাণিকের তালমেলানো সম্পাদনাও।
সুনয়না ওরফে নেত্যকালীর ঘটনা ছিল অতীতের, তাই রহস্যের মাপ গল্পে বড় হয়ে যায়। সেই মাপটা ধরলে খানিক মন্দ হত না। বিকাশ কেন নেই? সে তো ব্যোমকেশের পরবর্তী কিছু গল্পেও ফিরে আসতে পারে, বেকারত্বর কোপে পড়া সেই যুবকের সঙ্গে ব্যোমকেশের রসায়ন বেশ মজবুত ছিল, তা এই চিত্রনাট্যে, এমন সংলাপে নিশ্চয়ই আরও খাপ খুলত।
তবে এসব অভাব-অভিযোগ পেরিয়ে অনুরোধ, এমন অরিজিনাল ব্যোমকেশ হয়ে চলুক। চিত্রনাট্য-নির্দেশনার মণিকাঞ্চনযোগ হোক। ব্যোমকেশের চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য স্থায়ী হয়েই থাকুন, একরকমের চরিত্র অভিনেতাকে কতদিন তৃপ্তি দেবে বলা মুশকিল, কিন্তু ব্যোমকেশ নিয়ে যথেষ্ট হারাকিরির পরে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ব্যোমকেশের চরিত্রায়ণের দুনিয়ায় তাঁর অভিনয়ই এখন খাঞ্জা খাঁ। কোথাও কোনও ফাঁকি নেই সেখানে।