২৫ বছরের সাংসদ! এবারও ম্যাজিক ঘটাতে পারবেন বহরমপুরের 'রবিনহুড' অধীর?

Adhir Chowdhury Lok Sabha Polls 2024: গত ২৫ বছরে এই প্রথম নির্বাচনে অধীর চৌধুরীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী একজন মুসলিম প্রার্থী, ইউসুফ পাঠান

বহরমপুর মানেই অধীর চৌধুরী। একটি লোকসভাকে নিজের নামে পরিচিতি দিতে সময় লেগেছে ২৫ বছর! ৫ বারের সাংসদ তিনি। দেশে-রাজ্যে যা ঝড়ই বয়ে যাক না কেন, যে পালাবদলই হোক না কেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী বহরমপুর আসন ধরে রেখেছেন। এবারের লোকসভা ভোটে তিনি জিতলে ৬ বারের সাংসদ হবেন। ভারতীয় রাজনীতিতে, বিশেষ করে বর্তমান ডামাডোলের বাজারে এ এক অভাবনীয় কৃতিত্ব, তা স্বীকার করতেই হয়। জীবনে প্রথম নির্বাচন লড়েছিলেন ১৯৯১ সালে, নবগ্রাম বিধানসভা আসন থেকে। ১৯৯৬ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে অধীরের বিরুদ্ধে নকশাল যোগের অভিযোগ ওঠে। সেবার জেলে বন্দি থেকে ভোটে লড়েছিলেন অধীর, জিতেওছিলেন। তারপর বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২৫ বছর ধরে বহরমপুর আর অধীর সমার্থক হয়ে উঠেছেন। কোন ম্যাজিকে সম্ভব এমনটা? এবারেও জিতবেন অধীর?

বহরমপুরে অধীর বড় হয়েছেন। তাঁর জন্মভূমি, কর্মভূমি সবটাই বহরমপুর। পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানে বিকেল কেটেছে তাঁর। এখন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতির বয়স ৬৮। বহরমপুরের প্রতিটি চা দোকান এখনও চেনে তাঁকে। ১৯৯৯ সাল থেকে টানা পাঁচবার এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছেন অধীর কিন্তু সাংসদ হিসাবে ষষ্ঠ মেয়াদে বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অধীরের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সেই গুজরাত থেকে তুলে এনেছেন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে৷

আরও পড়ুন- মমতা বনাম অধীর: জোট আটকে দিল পুরনো যুদ্ধ?

গত ২৫ বছরে এই প্রথম নির্বাচনে অধীর চৌধুরীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী একজন মুসলিম প্রার্থী। বহরমপুরের নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের ৫০% এরও বেশি মুসলিম। তৃণমূলের আশা, 'বহরমপুরের রবিনহুড' যে ভোটব্যাঙ্কের উপর নির্ভর করে ২৫ বছর গড় ধরে রেখেছেন তার উল্লেখযোগ্য অংশ নিজের পকেটে আনবেন ইউসুফ পাঠান।

অধীর চৌধুরী শেষ লোকসভা অর্থাৎ ২০১৯ সালে জিতেছিলেন ঠিকই কিন্তু ভোটের ভাগ ৫.০৭%-এর বেশি কমে হয়ে যায় ৪৫.৪৭%। তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী অপূর্ব সরকার ওরফে ডেভিড ২০১৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসেন। তিনি ৩৯.২৬% ভোট পেয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের ভোট ১৯.৬১% বেড়েছিল সেবার। ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছয়টিতে জিতেছিল তৃণমূল, বিজেপি একটি আসন জিতেছিল। ১৯৯৯ সালে এই আসনে অধীর পেয়েছিলেন ৪,৩৪,০৭৩ ভোট, ২০০৪ সালে ৫,০৮,০৯৫ ভোট, ২০০৯ সালে ৫,৪১,৯২০ টি ভোট, ২০১৪ সালে পান ৫,৮৩,৫৪৯ ভোট আর ২০১৯ সালে পান ৯,৯১,১৪৭ টি ভোট। কিন্তু যেখানে বরাবর ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন অধীর, সেখানে গত লোকসভায় ৪৫.৪৭ ভোট পান অধীর। 

ফলে এবার লড়াই অধীরের জন্য কঠিন। যদিও অধীর চৌধুরী বহরমপুর ধরে রাখার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। বলছেন "আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে গেলে রাজনীতি ছেড়ে দেব, বাদাম বিক্রি শুরু করব।"

কংগ্রেস সমস্ত জায়গায় হেরে গেলেও বহরমপুরে মানুষের যে আস্থা আছে হাতচিহ্নেই এমনটা বহু মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন। বহরমপুরে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নিজস্ব এক সমর্থন তৈরি করতে পেরেছেন অধীর চৌধুরী। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি 'অধীর দা'। বড় অংশের মহিলা ভোটও রয়েছে তাঁর বাক্সে। সেই মহিলারা মনে করেন 'অধীর দা' হেরে গেলে বা রাজনীতি ছেড়ে দিলে মহিলারা এখন যতটা নিরাপদ বোধ করেন ততটা নিরাপদ আর থাকবেন না৷

অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, অধীর চৌধুরীকে টেক্কা দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতটাই মরিয়া যে তৃণমূল এই নির্বাচনী এলাকার নির্দিষ্ট হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ পকেটে তৃণমূল কর্মীদের বিজেপি প্রার্থী নির্মল কুমার সাহার পক্ষে প্রচার করতে বলেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা আসনে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের নির্বাচনী বোঝাপড়ার ব্যর্থতার জন্য বরাবর অধীর চৌধুরীকে দায়ী করছেন। সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে কংগ্রেসের নির্বাচনী সমঝোতার নেপথ্যেও অধীর চৌধুরীকেই দায়ী করেন মমতা।

আরও পড়ুন- অধীরের গড় কি অধীরেরই রইবে? রাহুলের ন্যায় যাত্রায় যা প্রমাণ পেল বহরমপুর

অন্যদিকে অধীর চৌধুরী I.N.D.I.A জোট ত্যাগ এবং শরিকদের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন মমতার বিরুদ্ধে। বিজেপির নির্দেশে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁচাতেই মমতা ইন্ডিয়া জোটে থাকেননি বলে অভিযোগ অধীরের। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের বিরুদ্ধে বিজেপি যেভাবে দুর্বল প্রার্থী দিয়েছে তাতেই দু'টি দলের মধ্যে গোপন বোঝাপড়া স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। তৃণমূল এবং বিজেপির হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচাতে তাই কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর মধ্যে বোঝাপড়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন অধীর। সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা একে অপরের পক্ষে প্রচার করেছেন তাই এবার।

বিজেপির হয়ে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সুপরিচিত স্থানীয় চিকিৎসক নির্মল কুমার সাহা। তৃণমূলের নেতারা বলছেন, বহরমপুরের মতো 'পিছিয়ে পড়া' অঞ্চলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বিশাল 'হিট'। পাশাপাশি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ইউসুফ পাঠান সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ পাবেন যা অধীর চৌধুরীর মতো একজন প্রবীণ নেতার জন্যও বেশ প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করবে। অন্যদিকে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী হিসাবে অধীর সিপিআই(এম)-এর সমর্থন পাচ্ছেন এই আসনে। বিজেপি এই অঞ্চলে ক্রমাগত শক্তি বাড়াচ্ছে। নির্মল সাহা একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক ফলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতায় বিজেপির লাভ হবে। আবার ইউসুফ পাঠানের তরুণ ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এই নির্বাচনে অধীর চৌধুরী চাপে রয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, অধীর জিতলেও তাঁর ভোটের ব্যবধান অবশ্যই গতবারের তুলনায় আরও কমবে।

তৃণমূল ও বিজেপির ধর্মের টোপে ভোট টানার প্রচেষ্টায় অধীর চৌধুরীর 'ধর্ম নিরপেক্ষ' ভোট প্রার্থনা কি সত্যিই জিতে যাবে? ছয়বারের সাংসদ হয়ে অধীর কি আবারও বুঝিয়ে দেবেন, বহরমপুরের অলগলি তাঁর? উত্তর জানবে দেশ, ৪ জুন।

More Articles