কী এমন রয়েছে জগন্নাথের রত্নভাণ্ডারে? রহস্য সমাধান করতে পারবে বিজেপি?

Jagannath Mandir Ratna Bhandar: রত্নভাণ্ডারের দু'টি প্রকোষ্ঠ রয়েছে: 'ভিতর ভাণ্ডার' (অভ্যন্তরীণ কোষাগার) এবং 'বাহার ভাণ্ডার' (বাহ্যিক কোষাগার)।

রাম গত, এখন লক্ষ্য জগন্নাথ। নবীন পট্টনায়েকের বিজেডি সরকারকে ফেলে দিয়ে বিজেপি গেরুয়া ঝড় তুলেছে দেশের অন্যতম বিখ্যাত মন্দির রাজ্য ওড়িশায়। আর এবারের নির্বাচনে বিজেপির অন্যতম ইস্যু ছিল জগন্নাথ মন্দির। প্রাচীন এই মন্দির বহু রহস্যে আর জমকে মোড়া। এই রহস্যের অন্যতম হচ্ছে মন্দিরের রত্নভাণ্ডার। সেই রত্নভাণ্ডারের হারানো চাবিই এবারের নির্বাচনে ওড়িশায় বিজেপির প্রবেশদ্বার খুলে দেয়। গত ১৫ মে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কটকে একটি জনসভায় বলেছিলেন বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতায় এলেই রত্নভাণ্ডারের নিখোঁজ চাবিগুলির তদন্তের জন্য গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করবে। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করে দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা বলেছিলেন বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে রত্নভাণ্ডারের হারিয়ে যাওয়া চাবি নিয়ে তদন্ত শুরু করবে। ২০ মে কটকে একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, "জগন্নাথ মন্দির বিজেডি শাসনে নিরাপদ নয়। গত ছয় বছর ধরে শ্রী জগন্নাথের রত্নভাণ্ডারের চাবি পাওয়া যাচ্ছে না। বিজেডির নেতারা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত।” কিন্তু কী এই রত্নভাণ্ডার? সেখানে কী এমন আছে? চাবিই বা হারালো কীভাবে?

পুরী জগন্নাথ মন্দিরে দেবতাদের অর্থাৎ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে ভক্তরা যে সোনা ও রত্ন উপহার দেয় তা জগন্নাথ মন্দিরের উত্তর দিকে জগমোহন (প্রার্থনা হল) সংলগ্ন রত্নভাণ্ডারে সংরক্ষণ করা হয়। রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ওড়িশা রিভিউ অনুসারে, মন্দিরের পরিচালনা, প্রশাসন বিষয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা বাড়াতে জগন্নাথ মন্দির আইন, ১৯৫২ পাস করা হয়। এই আইনের অধীনে, দেবতাদের দেওয়া অলঙ্কার এবং সোনার একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং পুরী কালেক্টরেটের রেকর্ড রুমে তা সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন- রাম অতীত, লক্ষ্য জগন্নাথ! ক্ষমতায় এসেই পুরীর মন্দির নিয়ে বিরাট সিদ্ধান্ত বিজেপির

রত্নভাণ্ডারের দু'টি প্রকোষ্ঠ রয়েছে: 'ভিতর ভাণ্ডার' (অভ্যন্তরীণ কোষাগার) এবং 'বাহার ভাণ্ডার' (বাহ্যিক কোষাগার)। ১৯৭৮ সালের শেষ হিসেব অনুযায়ী, বাহার ভাণ্ডারে ৮৭টি সোনার অলঙ্কার, কিছু মূল্যবান পাথর এবং ৬২টি রুপোর জিনিসপত্র রয়েছে। ভিতর ভাণ্ডারে ৩৬৭টি সোনার জিনিস রয়েছে যার মধ্যে আছে মূল্যবান রত্ন খচিত অলঙ্কার, সোনার প্লেট, মুক্তো, হিরে, প্রবাল এবং অন্যান্য মূল্যবান পাথর এবং ২৩১টি রুপোর সামগ্রী। রত্নভাণ্ডারের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে মন্দিরের ম্যানেজিং কমিটি। এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ‘পুরীর রাজা’ দিব্যসিংহ দেব (চেয়ারম্যান), প্রধান প্রশাসক (এসএন আইএএস-স্তরের আধিকারিক) এবং রাজ্য সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বা মনোনীত অন্যান্য সদস্যরা।

ভিতর ভাণ্ডারের জিনিসগুলি কখনই ব্যবহার করা হয় না। কঠিন তালাচাবি দেওয়া থাকে সেই প্রকোষ্ঠে। ম্যানেজিং কমিটি চাবিগুলি সাধারণত মন্দির প্রশাসনের সরকারি কোষাগারে জমা করে। রাজ্য সরকার নির্দেশ দিলে তবেই একমাত্র তালা খোলা যেতে পারে। বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত জিনিসগুলি বাহার ভাণ্ডারে সংরক্ষণ করা হয়। মন্দিরের আধিকারিক এবং প্রধান প্রশাসকের উপস্থিতিতে তা খোলা যেতে পারে।

প্রাথমিকভাবে, পুরীর রাজপরিবার, মন্দির কমিটি এবং পুরী কালেক্টরেটের কাছে রত্ন ভাণ্ডারের চাবি ছিল। ১৯৬৩ সালে, রাজ পরিবার মন্দিরের উপর রাজ্য সরকারের মালিকানাকে চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলা করে। সেই মামলাতে হারার পর রাজপরিবার তাদের চাবিটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়। বাকি দু'টি চাবি মন্দির কমিটি এবং পুরী কালেক্টরেটের কাছেই থেকে যায়। ১৯৭৮ সালে শেষবার ভিতর ভাণ্ডারটি খোলা হয়েছিল। সেই হিসেব অনুযায়ী, মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠানে নিয়মিত ব্যবহৃত প্রচুর পরিমাণে সোনার অলঙ্কার ছাড়াও ভিতরের কোষাগারে ৪৩৬৪ ভরি (৫০ কেজি) ওজনের সোনার জিনিস এবং ১৪,৮৭৮ ভরি (১৭৩ কিলোগ্রাম) রুপো সংরক্ষিত আছে।

তারপর থেকে, মন্দির প্রশাসন দু'বার ভিতরের কোষাগার খোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ভক্তদের অনুভূতিতে আঘাত হতে পারে এই ভয়ে তা বন্ধ করে দেয়। শেষ এই ধরনের প্রচেষ্টা হয় ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ওই ঘরের চাবিই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৬-সদস্যের দল, যার মধ্যে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই) তিনজন সদস্য ছিলেন, একটি গ্রিল গেট দিয়ে সার্চ লাইট ব্যবহার করে বাইরে থেকে ভিতরের চেম্বারটি পরিদর্শন করতে বাধ্য হয়েছিল। ওড়িশা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে এই পরিদর্শন করা হয়েছিল।

চাবি হারানোর বিষয়টি ওড়িশা জুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি করে। ২০১৮ সালের ১ জুন প্রথম এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পুরীর জেলা কালেক্টর অরবিন্দ আগরওয়াল তখন অভ্যন্তরীণ কোষাগারের চাবিগুলির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি জানান, চাবি নেই। ওড়িশার সাধারণ মানুষ, ভক্ত এবং বিরোধী দল বিজেপি এবং কংগ্রেস এই ঘটনা নিয়ে শোরগোল ফেলে দেয়। নবীন পট্টনায়েক প্রশাসন ২০১৮ সালের ৫ জুন এই বিষয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বিচারপতি রঘুবীর দাসের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন রাজ্য সরকারকে ৩২৪ পাতার রিপোর্ট জমা দেয় সেই বছরের নভেম্বরে।

রাজ্য সরকারের উপর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের প্রধান প্রশাসক পি.কে. জেনাকে সরিয়ে দেওয়া হয় দায়িত্ব থেকে। তদন্তের দশ দিনের মধ্যে, ১৩ জুন, পুরী জেলা প্রশাসন জেলা রেকর্ড রুমের একটি লকারের মধ্যে ভিতর ভাণ্ডারের নকল চাবিসমেত একটি বাদামী সিল করা খাম পায়। এই চাবিগুলি বদলির আগে আগরওয়াল জেলা কোষাগারে জমা দিয়েছিলেন। বিরোধী দল এবং এমনকী পুরী শঙ্করাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতীও বিজেডি সরকারের সমালোচনা করেন এই অবহেলার জন্য। দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে।

আরও পড়ুন- প্রভু জগন্নাথ খোদ মোদির ভক্ত! লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগে কেন আঘাত বিজেপির?

২০২৩ সালের এপ্রিলে, পুরীর বাসিন্দা দিলীপ কুমার বড়াল রাজ্য বিধানসভায় হারানো চাবি তদন্তের বিচার বিভাগীয় কমিটির রিপোর্ট পেশ করার জন্য ওড়িশা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। দিলীপ বড়ালের মতে, রাজ্য সরকার তদন্ত কমিশনের জন্য প্রায় ২৩ লক্ষ টাকা খরচ করেছে বলে জানা গেছে কিন্তু সেই তদন্তের ফলাফল জনগণের থেকে গোপন রাখে। ২০১৮ সালে রাজ্য সরকারের কাছে যে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছিল তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

রত্নভাণ্ডারকে এই সময়কাল থেকেই বিজেপি ইস্যু করে তোলে। রত্নভাণ্ডার না খোলায় জগন্নাথ মন্দিরের ভক্তদের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তাকে ব্যবহার করে ভারতীয় জনতা পার্টি। বিজেপি দাবি করতে থাকে যে, ভক্তরা জানতে চাইছেন অলঙ্কারগুলি আগের মতোই সুরক্ষিত আছে কিনা। ওড়িশা কংগ্রেসও ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি তুলসী যাত্রা করে যাতে রাজ্য সরকারকে রত্ন ভাণ্ডার খোলার জন্য চাপ দেওয়া হয়। সংগৃহীত তুলসী পাতা মন্দিরে নিবেদন করেন কংগ্রেস নেতারা।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে, ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক রত্নভাণ্ডারে রাখা গয়না এবং অন্যান্য মূল্যবান পাথরের তালিকা তদারকির জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অরিজিৎ পাসায়াতের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। এরপর লোকসভা নির্বাচন হয়। ওড়িশায় একইসঙ্গে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন হয়। তাতে ২৪ বছরের বিজেডি সরকারের পতন হয়। ক্ষমতায় আসে বিজেপি। লোকসভার প্রায় সমস্ত আসনই যায় বিজেপির দখলে। জগন্নাথের রত্নভাণ্ডারের হারানো চাবির রহস্য সমাধান করতে পারবে কি বিজেপি?

More Articles