পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির স্থায়ী সমাধান! সংকট কাটাতে নতুন যে শক্তি উৎপাদনে মগ্ন কেন্দ্র

Green Hydrogen: সমপরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন দরকার তা রাখার জন্য আকারে বহুগুণ বড় স্টোরেজ প্রয়োজন।

নতুন বছরে এসে পড়েছে দেশ, বিশ্ব। গোটা বছর জুড়েই নানা রাজনৈতিক তর্কাতর্কি-দলাদলির মধ্যেই বেশ কিছু ঘটনা জনসাধারণের জীবনের দৈনিক আলোচনায় উঠে এসেছিল। রাজনৈতিক শাসক-বিরোধী বিতর্কের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে তো থেকেইছে, প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়া আর সাধারণ মানুষের কপাল- দুইয়েই সমান আঘাত এনেছে তেল, গ্যাস সহ সমস্ত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানির মূল্য বাড়ার ফল হিসেবে ভোগ্য পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে সারা বছরই নাজেহাল থেকেছে মানুষ। গত অর্থবর্ষে, বিশ্ব বাজার ও অর্থনীতি জ্বালানির সংকটকে ঘিরে বারবার আলোড়িত হয়েছে। বিশ্ব-রাজনীতির বিভিন্ন মঞ্চ এবং বৈঠকগুলির দিকে চোখ রাখলেই এই অবস্থার প্রতিফলন চোখে পড়বে। কিছুকাল আগেই ঘটে যাওয়া G-20 সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক বৈঠক ও আলাপ-আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে জ্বালানির সংকট। প্রশ্ন উঠছে জ্বালানির বন্টন ব্যবস্থা নিয়েও। এমনকী, জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে বিশ্ব-রাজনীতির চাপান-উতোর।

এ অবস্থায় ভারতের মতো উন্নয়নশীল, জনবহুল দেশে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি আম-জনতার পকেটে অতিমাত্রায় চাপ তৈরি করেছে। এখনও পর্যন্ত ভারতের জ্বালানি বা শক্তির মূল উৎস কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। ভারতকে তার বার্ষিক জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জ্বালানির একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়। সব থেকে বড় বিষয় হলো পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার সীমিত। দু' তিন প্রজন্ম জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে মানব সভ্যতার চাকা ঘুরবে না। তাই, এই সংকটময় পরিস্থিতিতে, জ্বালানির আমদানি কীভাবে কমানো যায় এবং জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশকে কীভাবে স্বনির্ভর করে তোলা যায় তারই চেষ্টাচরিত্র খানিক করা হয়েছে। এই সূত্রে ভারত সরকারের নিউ অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি মন্ত্রক হাইড্রোজেন থেকে শক্তি উৎপাদন করার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যার পোশাকি নাম ‘ন্যাশানাল হাইড্রোজেন মিশন (২০২২)’। আমরা জানি, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করার সময় প্রচুর পরিমাণে কার্বন নির্গমন ঘটে। এই কার্বন নির্গমনের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। বলা ভালো যে, জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হলো কলকারখানা নির্ভর সভ্যতায় জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার। সুতরাং, হাইড্রোজেন শক্তি উৎপাদন করে ভারত সরকার শুধুমাত্র জ্বালানি সংকট কাটাতে চাইছে না বরং পুরো বিষয়টাকে জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে জড়িত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার এক বড়সড় উপায় হিসেবে দেখছে। তাই, এই হাইড্রোজেন থেকে শক্তি তৈরির পদ্ধতিকেও পরিবেশ-বান্ধব করার কৌশল নেওয়া হয়েছে, সেই হিসেব মেনেই নাম হয়েছে গ্রিন হাইড্রোজেন।

আরও পড়ুন- ডিজেল ছাড়াই চলবে ট্রেন, নয়া চমক ভারতে! দেখতে কেমন হবে ইকো ট্রেন?

জলবায়ু পরিবর্তনের কথাই যদি এসে পড়ে, তাহলে বলতেই হয় এতদিনে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা, পেট্রোলিয়ামের থেকে পাওয়া শক্তির বিকল্প শক্তি হিসেবে সৌর বিদ্যুৎ, হাওয়া বিদ্যুৎ এসবের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার উপায় কী? গ্রিন হাইড্রোজেন কি আদৌ পারবে জলবায়ু পরিবর্তনের কোপ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে?

জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার

বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে যে সমস্ত মৌল পাওয়া যায় তার মধ্যে হাইড্রোজেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। হাইড্রোজেন মূলত গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। তবে, পৃথিবীতে পাওয়া হাইড্রোজেনের বেশির ভাগটাই যৌগ। অর্থাৎ, হাইড্রোজেন অন্য মৌলের (যেমন- কার্বন, অক্সিজেন) সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় স্থায়ী যৌগ তৈরি করে প্রকৃতিতে রয়েছে। তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে, তড়িৎ বিভব প্রয়োগ করে হাইড্রোজেনযুক্ত যৌগকে ভেঙে সেখান থেকে মুক্ত হাইড্রোজেন তৈরি হয় করা হয়। তারপর সেই হাইড্রোজেনকে পুড়িয়ে যন্ত্র চালানোর শক্তি পাওয়া যায়। আবার একটি ফুয়েল সেলে মুক্ত হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনকে বিক্রিয়া করে করিয়ে তা থেকে শক্তি তৈরি করতে পারি। এই ফুয়েল সেল ব্যবহার করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও চালানো যায়। ১৮০০ সাল থেকেই এই হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহারের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। গত শতকের ষাটের দশকে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহার করে গাড়ি চালানোও সম্ভব হয়েছে। ঠিক ওই সময় থেকে নাসা (NASA) রকেটের জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহার করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে অন্য ক্ষেত্রে হাইড্রোজেনের ব্যবহার বাড়লেও জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনের ব্যবহার কিন্তু অপ্রচলিত থেকে গেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানির (প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম, কয়লা) সহজলভ্যতা। কিন্তু, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, যেখানে সভ্যতার অন্যতম বড় সংকট জলবায়ু পরিবর্তন- সেই অবস্থায় কার্বনযুক্ত জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে অপ্রচলিত জ্বালানি কতটা ব্যবহার করা সম্ভব তা ভাবাচ্ছে। হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে শুধুমাত্র জল, জলীয়বাষ্প ও কিছু পরিমাণে তাপ তৈরি হয়। উল্টোদিকে, জীবাশ্ম জ্বালানির বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস তৈরি হয়। তাই, দূষণমাত্রার নিরিখে হাইড্রোজেন জ্বালানির ব্যবহার নিরাপদ।

গ্রিন হাইড্রোজেন কী?

মুক্ত হাইড্রোজেন তৈরিতে হাইড্রোজেনযুক্ত যৌগকে ভাঙার কাজে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহৃত হয়। এই শক্তির প্রায় সবটাই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। যেহেতু এই পদ্ধতিতে কার্বন নির্গমন এবং তা জনিত দূষণ ঘটে, তাই একে গ্রে বা ধূসর হাইড্রোজেন বলা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই হাইড্রোজেনের দাম অন্য কোনও জ্বালানির তুলনায় অত্যন্ত বেশি। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে হাইড্রোজেনকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে তার উৎপাদন পদ্ধতি পরিবেশ-বান্ধব হতে হবে। সেই কারণেই, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সহ এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলিতে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুতের মতো পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে হাইড্রোজেন উৎপাদন এবং তাকে পুনরায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হাইড্রোজেনকেই গ্রিন হাইড্রোজেন বলা হচ্ছে। একটি দেশের ভারী শিল্প (যেমন- স্টিল, সিমেন্ট ইত্যাদি) যা একেবারেই জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর তাকে গ্রিন হাইড্রোজেন শক্তি দ্বারা চালনা করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত গ্রিন হাইড্রোজেনের উৎপাদন খুবই নগণ্য। পাশাপাশি, এর দাম এতটাই বেশি যে এটি ব্যবহার করে যেকোনও শিল্প চালনা করা অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ সুবিধের নয়।

জ্বালানি হিসেবে গ্রিন হাইড্রোজেনের স্থায়িত্ব কতটুকু?

সৌরবিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুতের মতো পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরির ব্যাপারখানা 'ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন' বলা হলেও এর মধ্যে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। হাইড্রোজেন উৎপাদনের সবচেয়ে সহজলভ্য উপাদান হল কার্বন ও হাইড্রোজেন যুক্ত একটি যৌগ মিথেন। কিন্তু মিথেন সরবরাহের চ্যানেলগুলি থেকে ফাটলের মধ্যে দিয়ে তা বাতাসে মিশতে পারে। মিথেনের বাতাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা ক্ষমতা কার্বনযুক্ত অন্যান্য যৌগের তুলনায় বেশ কয়েক গুণ বেশি। অর্থাৎ কোনওভাবে মিথেন বাতাসে মিশলে বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরও দ্রুত হবে যা শেষ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলবে। এরপরেও আরেকটি সমস্যা হল হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘনত্ব খুবই কম। সম ওজনের জীবাশ্ম জ্বালানি তুলনায় হাইড্রোজেনের আয়তন অনেক বেশি। আর এই কারণেই সমপরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন দরকার তা রাখার জন্য আকারে বহুগুণ বড় স্টোরেজ প্রয়োজন। দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট শিল্প উৎপাদনের জন্য যেটুকু জমির প্রয়োজন, সেই শিল্পে হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহার করতে হলে, শুধুমাত্র হাইড্রোজেন সংরক্ষণের জন্য ওই শিল্পাঞ্চলের সমপরিমাণ জমির দরকার পড়ছে। তাই জমি ব্যবহারের নিরিখেও হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহার মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে মোটেই লাভজনক নয়।

আরও পড়ুন- ভূস্বর্গ হয়ে উঠছে নরক! পরিবেশ ধ্বংস যে সর্বনাশ করছে কাশ্মীরের

‘ন্যাশনাল হাইড্রোজেন মিশন’- এর মধ্য দিয়ে ভারত সরকার ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে মোট জ্বালানির কয়েক শতাংশ গ্রিন হাইড্রোজেন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে চাইছে। এতে হাইড্রোজেনের চাহিদা তৈরি হতে পারে। এই চাহিদা পরোক্ষভাবে গ্রিন হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরিতে বিনিয়োগের পরিসর বাড়িয়ে তুলবে। এছাড়াও, গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকির ব্যবস্থা করছে। এতকিছুর পরেও বেশ কিছু অসুবিধা থেকেই যাচ্ছে গ্রিন হাইড্রোজেন তৈরিতে। যেহেতু, এখনও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিগুলি প্রকৃতপক্ষে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি, সেখানে দাঁড়িয়ে এই শক্তি ব্যবহার করে হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরি ও তার ব্যবহার কতটা কার্যকরী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিনির্ভর শিল্প ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বই প্রতিষ্ঠিত নয়। সে জায়গায় হাইড্রোজেন জ্বালানি নির্ভর অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর স্থায়িত্ব আরই ধোঁয়াশাময়।

জ্বালানির সুরক্ষা পাওয়া যাবে কীভাবে?

গ্রিন হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। কিন্তু, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সীমাবদ্ধতাগুলিকে উতরে যাওয়ার কাজ প্রযুক্তিবিজ্ঞান করেই চলবে। তবে, উদ্ভাবনের আনন্দ সমস্যা মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। স্রেফ প্রযুক্তিগতভাবে একটি ব্যবস্থা স্থায়ী হলেই আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় তার সুফল পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বর্তমান পৃথিবীতে শক্তির সংকট মোকাবিলায় আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো শক্তির বন্টন। এটা যেমন জীবাশ্ম শক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমন বিকল্প শক্তির ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। তাই, বিশ্ব বাজারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য তড়িঘড়ি না করে বরং প্রযুক্তির রূপায়ণ, তার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং শক্তির বন্টন নীতির ফাঁক-ফোঁকরগুলো এই বেলা মেরামত করে নেওয়াই ভালো।

 

More Articles