বুলডোজার নীতি ‘অন্যায়’, সুপ্রিম নির্দেশেও কমবে দেশে সংখ্যালঘু শোষণ?
Bulldozer Justice: আসলে এই বুলডোজারের আগ্রাসনের সঙ্গে এনকাউন্টার করে হত্যার কোনও পার্থক্য নেই এবং এর মধ্যে দিয়ে কিছু দৃশ্যকল্প তৈরি হয়।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবশেষে জানাল, বুলডোজার চালিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা কখনওই আইন হতে পারে না। সদ্য তাঁর শেষ মামলার শুনানি চলাকালীন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেই কথাগুলোর প্রতিধ্বনিই যেন শোনা গেল বিচারপতি বিআর গোভাই এবং কে ভি বিশ্বনাথনের গলায়। অন্য একটি মামলার রায় দেওয়ার সময়ে এই দুই বিচারপতি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, কোনও সভ্য দেশে বুলডোজার জাস্টিস চলতে পারে না। ওই বেঞ্চের স্পষ্ট বক্তব্য, আগে থেকে কারণ দর্শিয়ে নোটিস না পাঠিয়ে কোনও অভিযুক্তের বাড়ি ঘর ভেঙে ফেলা যাবে না, তা সে যতই বেআইনি নির্মাণ হোক না কেন!
শুধু তাই নয়, এই সংক্রান্ত রায়ে আরও বেশ কিছু নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যে কোনও অভিযুক্তকে অন্তত ১৫ দিন সময় দিতে হবে। যে সরকারি আধিকারিক, নিজেকে বিচারপতি ভেবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাও রুজু হবে। সেইরকম কোনও ঘটনায়, গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্পত্তি পুনর্নিমাণের খরচ যাতে সেই সরকারি আধিকারিকের বেতন থেকে কাটা হয়, সেই নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশ দেওয়া হলেও, দেশের সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু একটি জরুরি বিষয় সচেতনভাবে উল্লেখ করেনি। এতদিন ধরে রাষ্ট্রের বুলডোজার সন্ত্রাসে যাঁদের ঘর ভেঙেছে, তাঁদের কি ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার, তাঁদের ঘর কি আবার তৈরি করার নির্দেশ দেবে সরকার?
আরও পড়ুন: রাতারাতি ভিটেমাটি ছাড়া হবেন ৫০ হাজার নাগরিক! কেন বাছাই করা এলাকাতেই বুলডোজার?
২০২২ সাল থেকেই কার্যত এই বুলডোজার একটা প্রতীক হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন যোগী আদিত্যনাথ হুঙ্কার দিয়ে বলেন, তিনি ক্ষমতায় ফিরলে ওই বুলডোজারকেই তিনি দুষ্কৃতি,মাফিয়া এবং দাঙ্গাবাজদের দমন করতে ব্যবহার করবেন। তিনি আরও বলেন, ভারতবর্ষের আইনি প্রক্রিয়া এতো ধীর লয়ে চলে, যে মানুষকে দ্রুত বিচার দিতে গেলে, এই ধরনের কঠোর এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াই প্রয়োজন। তিনি এই কথাটা বললেও, পাশাপাশি সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন কিছু কথাও সেই সময়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেন, যা অবাক হওয়ার মতোই। যা শুনে মনে হতেই পারে, তিনি যে দাঙ্গাবাজ দমনের কথা বলেছিলেন সেই সময়ে তা মুসলমানদের উদ্দেশ্য করেই বলেছিলেন। আর তা তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ দেখেই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। তার পরে এই বুলডোজারের সঙ্গে ছবি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ-সহ অন্য বিজেপি নেতারা দাবি করেন, এই পদ্ধতিতেই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে হবে, এই পদ্ধতিতেই বিরোধীদের দমন করা জরুরী। যোগী আদিত্যনাথকে সবাই বলাও শুরু করেন, তিনি হচ্ছেন ‘বুলডোজার বাবা’। তার ফলও মেলে হাতেহাতে, দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। বিজেপি শাসিত গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরাও একই পদ্ধতি নেওয়া শুরু করেন, তাঁদেরও আদর্শ হয়ে ওঠেন সেই যোগী। তারপর থেকেই এই বুলডোজার হয়ে উঠছিল, রাষ্ট্রীয় শক্তির পরিচায়ক। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘অবৈধ’ ব্যবসা থেকে শুরু করে, ঘরবাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে এই বুলডোজার নামক যন্ত্রকেই ব্যবহার করা হবে বলা হলেও, দেখা গিয়েছিল, ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছিল যাঁদের উপরে, তাঁরা সবাই সংখ্যালঘু মানুষজন।
গতবছর রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন বেশ কিছু বিজেপি শাসিত রাজ্যে দেখা গেল সেই বুলডোজারকে ব্যবহার করেই সংখ্যালঘু মানুষদেরই লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে, তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হলো। গুজরাটের আনন্দ জেলার খাম্বাটে অভিযোগ ওঠে, বেশ কিছু রাস্তার ধারের অস্থায়ী দোকান এবং বাড়ি থেকে রামনবমীর মিছিলে পাথর ছোড়া হয়েছে, এবং সেই দোকানগুলো সব ‘অবৈধ’। অতএব ভেঙে দেওয়া হোক ওই দোকানগুলো। যদিও সেই দোকানের যাঁরা মালিক, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই সেখানকার পুরসভাকে ট্যাক্স দিয়ে আসছেন এবং সমস্ত দোকানগুলো বৈধ। তবুও কোনও সুযোগ বা আগাম নোটিস না দিয়ে ঐ দোকানগুলো ভেঙে ফেলা হলো। একইরকম পদ্ধতি নিতে দেখা গেল মধ্যপ্রদেশের খারগোনে এবং রাইসেন জেলাতেও। সেখানেও অভিযোগ ওঠে, কিছু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে রামনবমীর মিছিলে পাথর ছোড়া হয়েছে, অতএব চালাও বুলডোজার। অথচ কেউ একবার খোঁজও নিলেন না, যে ঐ অঞ্চলের বেশ কিছু ঘর কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকায় তৈরি। ভেঙে গেল আবারও বেশ কিছু সংখ্যালঘু মানুষের ঘর, প্রার্থনার স্থান এবং বহু স্বপ্ন। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীরা হয়ে উঠলেন যথাক্রমে ‘বুলডোজার মামা’ ও ‘বুলডোজার দাদা’। বিরোধীরা অভিযোগ করলেও, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা জানেন, নির্বাচনে ফায়দা তুলতে হলে, তাঁদের দেখাতেই হবে যে তাঁরা কোনও ‘অবৈধ’ কিছুই মেনে নেবেন না, এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে একজন প্রশাসককে কঠোর হতে হয়। আসলে দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশ, এই বুলডোজারের মাধ্যমে তাঁরা একটাই বার্তা দিতে চাইলেন সংখ্যালঘু মুসলমানদের। কী সেটা? তা হল, সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আস্ফালনের সামনে মাথা নীচু করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাঁচা ছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ নেই। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হিরণ্ময় নীরবতা কেন? এই নিয়ে যখন অনেকেই প্রশ্ন তুললেন, তখন তিনি আরও কঠোর বার্তা দিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে একটি বুলডোজারের সঙ্গে ছবি তোলালেন সচেতনভাবে, দেখাতে চাইলেন যে জেসিবি বা বুলডোজারের কর্মকান্ডকে পরোক্ষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও সমর্থন করছেন।
আসলে এই বুলডোজারের আগ্রাসনের সঙ্গে এনকাউন্টার করে হত্যার কোনও পার্থক্য নেই এবং এর মধ্যে দিয়ে কিছু দৃশ্যকল্প তৈরি হয়। প্রথমত এটা দেখানো সম্ভব, যে আইন আদালত কোনও কিছুরই আর কোনো প্রয়োজন নেই, যাঁরা ভাঙতে আসছেন, তাঁরাই আইন, তাঁরাই আদালত, কোনও কিছুরই তাঁরা তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু একটি সভ্য সমাজে প্রশাসনের কী দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? প্রাথমিকভাবে আদালতের কাজ এই ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে কে দোষী তা নির্দিষ্ট করা, তারপর সেই দোষী ব্যক্তির শাস্তির নিদান দেওয়া। কিন্তু সেই শাস্তি কি কখনও এমনটা হতে পারে, একজন ব্যক্তি মানুষের দোষের জন্য, তাঁর পুরো ঘরবাড়ি ভেঙে দিতে হবে? নিশ্চিত কোনও সভ্য সমাজ এবং তার আইন এই শাস্তি দেবে না? কারণ একজন মানুষ একা একটি ঘরে থাকেন না, তাঁর পরিবারও থাকে তাঁর সঙ্গে, যদি তিনি দোষীও হন, তাঁর দোষের জন্য তাঁর পুরো পরিবারকে তো আর শাস্তি দেওয়া যায় না এবং তা উচিতও নয়। দ্বিতীয়ত যদি এটা দেখানো যায়, এই মূহুর্তে শাসকদলই আইন, তাহলে নির্বাচনে এই ঘটনার প্রভাব পড়তে বাধ্য, ঠিক যেভাবে উত্তরপ্রদেশে জেতা গেছে এবং পরবর্তীতে গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেও যে ফলাফল বিজেপির অনুকূলে গেছে তার অন্যতম কারণ কি এই বুলডোজার রাজের অন্যায়, যাকেই ন্যায় এবং আইন বলে চালাতে চেয়েছে বিজেপি?
একজন নির্বাচক দীর্ঘ সময় ধরে যদি দেখেন বুলডোজারের তলায় যে কোনও কিছুই পিষে ফেলতে পারে যে দল, সেই পরাক্রমশালী ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে চান বেশীরভাগ নির্বাচক। এটাই সেই ‘বিকল্প দৃশ্যকল্প’ যা নানান ভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে বেশ কিছু বছর ধরে। কখনও গুজরাট মডেলকে তুলে ধরা, কখনও বা প্রবল শক্তিশালী একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন বলেই প্রতিবেশী দেশের আক্রমণের সমুচিত জবাব দেওয়া গেছে এই ভাবনা তৈরি করা, কখনও ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং রাজনৈতিক দলকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া— এই সমস্ত কিছুই আসলে একজন সাধারণ নির্বাচককে প্রাভাবিত করে। একটা সময়ে নির্বাচনের সময়েই এই সব নিয়ে বেশি আলোচনা হত, কিন্তু আজকের সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সারা বছর ধরে এই আলোচনা হয়। সারা বছর ধরেই একজন নির্বাচকের আচরণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়। যাঁরা ভোটকুশলী বলে পরিচিত, তাঁদের কাজটাই হচ্ছে, কীভাবে একজন নির্বাচককে তাঁর বিরোধী অবস্থান থেকে সরিয়ে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা যায়। আগে যাঁরা বিজ্ঞাপন দিতেন, তাঁরা কোনও একটি দ্রব্যের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞাপন করতেন। ইদানীং কোন মানুষ কী পছন্দ করেন, সেই বুঝে সংস্থারা বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক দলও নিজেদের বিজ্ঞাপন করেন, কোন মানুষ কোন আদর্শ, কোন নেতার কথায় প্রভাবিত হন, সেটাও যেহেতু আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার সময়ে ভোটকুশলীদের করায়ত্ব, তাই তাঁরা ভালোই জানেন কী করে একজন নির্বাচকের কাছে তাঁর পছন্দমতো দৃশ্যকল্প উপস্থাপিত করতে হয়। বিকল্প সত্যিটাই কখন যেন সত্যি হয়ে যায়, মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: নতুন ভারতের অন্য নাম এখন বুলডোজার
আজকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই বুলডোজার ‘অ’ন্যায় সংক্রান্ত রায় হয়তো কিছুটা সাময়িক স্বস্তি দেবে, হয়তো এই রায় এই বেআইনি বুলডোজার আইনকেই প্রতিষ্ঠিত আইন হয়ে যাওয়া থেকে বিরত করবে। কিন্তু এই রায়কে কী করে লাগু করা হবে, সেটাই আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে আগামিদিনে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যদিও এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, দেরিতে হলেও ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় মানবাধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। যে বুলডোজার ‘অ’ন্যায়কেই দেশের রাজনৈতিক নেতা এবং এক অংশের সংবাদমাধ্যম এতদিন ধরে ন্যায় এবং আইন বলে চালানোর চেষ্টা করে গেছে, যে দেশে আইন আদালতকে উপেক্ষা করে কার খাবারে কী আছে, কে কী পরবে, তা দেখে পিটিয়ে মারাটাই প্রচলিত আইনে পরিণত হয়েছে, সেই দেশে এই রায় কতটা সংখ্যালঘু মনে ভরসা জোগাবে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার অবকাশ আছে। মনে রাখা জরুরি, ইতিপূর্বে এই শীর্ষ আদালত, গো-রক্ষা সংক্রান্ত মামলায় নির্দেশ দিয়েছিল, যে গো-রক্ষার অজুহাতে যদি কোনও ব্যক্তি বা সমষ্টির উপরে হামলা হয়, কিছু ক্ষেত্রে হত্যা পর্যন্ত করা হয়, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। যার অন্যথা হলে তা আদালত অবমাননা হিসেবে গ্রাহ্য করা হবে। এর পরেও কি গো-রক্ষক বাহিনীর তান্ডব কমেছে? গোরক্ষক বাহিনীর যাঁরা শিকার, তাঁরাই ঘটনাচক্রে বুলডোজার রাজেরও শিকার। তাঁরা কি প্রতি ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে পৌঁছে তাঁদের আর্জি জানাতে পারবেন? স্থানীয় প্রশাসন যদি রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হয়, বুলডোজার যদি সেই প্রশাসনের ন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে, তাহলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই রকম হাজার রায় দিলেও, আদপে পরিস্থিতি কিছুই বদলাবে না। আদালতের রায়কে সমাজের নীচু মহলে লাগু করতে গেলে, দৈনন্দিন রাজনীতিতে পরিবর্তন করতে হবে, কিন্তু সেই চেষ্টা কি আদৌ আমাদের শাসক দল করবে? প্রশ্ন থেকেই যায়।