রাজনীতিতে শূন্য! দিদি নম্বর ১ দিয়ে ভোটে জিততে পারবেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়?
Rachana Banerjee TMC Candidate: রাজনীতি আর টেলিভিশনের পর্দাকে গুলিয়ে ফেলেছেন রচনা। পরপর বেফাঁস মন্তব্য করেছেন।
নাম ঝুমঝুম বন্দ্যোপাধ্যায়। টিভির পর্দায় তাঁকে মানুষ চেনেন 'দিদি নম্বর ওয়ান বলেই, চেনেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই। রাজ্যজুড়ে জনপ্রিয় টেলিভিশন গেম শো দিদি নম্বর ওয়ানের মাধ্যমে ঘরে ঘরে মহিলাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় তিনি। এই জনপ্রিয়তাকে ভোটে রূপান্তরিত করতে চেয়েছে তৃণমূল। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিয়ে কেবল মহিলা ভোট টানা নয়, মহিলাদের 'দিদি নম্বর ওয়ান'-কে সরাসরি ময়দানে নামিয়ে ভোট জিততে চাইছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টিভির দিদিকে রাজনীতির দিদি হিসেবে মানতে কতটা প্রস্তুত সাধারণ মানুষ? রাজনীতির কোনও পাঠ না থাকা, অভিজ্ঞতা না থাকা রচনাকে কতখানি পাবেন সাধারণ মানুষ?
রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২ অক্টোবর। শুধু বাংলা সিনেমায় নয় তেলগু, তামিল এবং কন্নড়, ওড়িয়া চলচ্চিত্রেও প্রচুর কাজ করেছেন রচনা। ১৯৯৪ সালের মিস কলকাতা হয়েছিলেন। তারপর মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় মিস বিউটিফুল স্মাইল সহ ভারতের এমন পাঁচটি প্রতিযোগিতা জিতেছেন রচনা। যদিও রচনা নামটি তাঁর পর্দার নাম। ১৯৯৩ সালের তাঁর অভিষেক ঘটে চলচ্চিত্রের পর্দায়। দান প্রতিদান সিনেমার পরিচালক সুখেন দাস ঝুমঝুম পাল্টে তাঁর নাম করে দেন রচনা।
প্রথম সিনেমার ঠিক এক বছর পরে ১৯৯৪ সালে মিস কলকাতা প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন রচনা। সাউথ সিটি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তিনি তখন। ১৯৯৪ সালে মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনালে থেকে বাদ পড়ে যান তিনি, জেতেন মধু সাপ্রে। চলচ্চিত্র জীবনে ৪০ টিরও বেশি সিনেমায় অভিনেতা সিদ্ধান্ত মহাপাত্রের বিপরীতে প্রধান মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেন রচনা। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে সূর্যবংশম চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ৩৫টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন রচনা। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত মহাপাত্রকে বিয়েও করেন রচনা। ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। ২০০৭ সালে ফের প্রবাল বসুকে বিয়ে করেন তিনি। ২০১৬ সালে তাঁর থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যান রচনা। তাঁদের এক পুত্র সন্তানও রয়েছে।
আরও পড়ুন- যাদবপুরে সততা বনাম দুর্নীতি! সায়নী ঘোষের বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী সৃজন ভট্টাচার্য?
অভিনয়ে পড়ন্ত বেলায় তিনি চলে আসেন টেলিভিশন মাধ্যমে। জনপ্রিয় বাংলা নন-ফিকশন টিভি শো, দিদি নং ১-এর সঞ্চালনার কাজ শুরু করেন। সম্ভবত চলচ্চিত্রের থেকেও তাঁকে মানুষ সবিচেয়ে বেশি চেনে জি বাংলার এই রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে।
দিদি নম্বর ১-এর শোয়ে কিছুকাল আগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির হন। তখনও প্রার্থীতালিকা ঘোষণা হয়নি। যেভাবে একটি রিয়েলিটি শো মুখ্যমন্ত্রীর বন্দনা আর সরকারি প্রকল্প প্রচারের জায়গা হয়ে গেছিল জি বাংলাকে রাজনৈতিক চ্যানেল বলে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তখন, সেই শোয়ে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিগলিত মমতাস্তুতি, মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবিকে ঘিরে উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। দিদি মমতা আর দিদি নম্বর ১ রচনা মিলে সেই সন্ধ্যাতে প্রায় প্রমাণ করে ফেলেছিলেন এই শোয়ের বিনিময়ে যৌথ দেনা-পাওনার গল্প আছে। তার কিছুকাল পরেই ব্রিগেডের মঞ্চে জনগর্জন সভা থেকে জানা যায় রচনা এবার হুগলি আসনে ভোটে দাঁড়াবেন।
সিঙ্গুরে ডাকাত কালীর মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রচার শুরু করেছেন তিনি। কালীকে বেনারসি শাড়ি দিয়ছেন। এবার জনতাকে প্রতিশ্রুতি দেবেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কই নেই। ২০১৯ সালে হুগলি লোকসভা কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয় তৃণমূলের। এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়। এবারও এই আসনে তিনিই বিজেপি প্রার্থী। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন তৃণমূলের রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সিপিআইএমের মনোদীপ ঘোষ। রচনা এবং লকেট পুরনো বন্ধু, সহকর্মীও। তবে রাজনীতিতে লকেটের আনাগোনা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে বেশ বেশি। রচনা যে এই ময়দানে একেবারেই আনকোরা তা নির্বাচনী প্রচারেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। রাজনীতি আর টেলিভিশনের পর্দাকে গুলিয়ে ফেলেছেন রচনা। পরপর বেফাঁস মন্তব্য করেছেন।
আরও পড়ুন-বারুইপুর, যাদবপুর হয়ে দমদম! ‘সুদিন’ ফেরাতে পারবেন সুজন চক্রবর্তী?
প্রচারে নেমেই বলে ফেলেছেন ‘হুগলির মানুষ খুব লাকি যে আমাকে দেখতে পাবে’! মানুষ লাকি বলে তাঁকে দেখতে পাবে? তাঁকে দেখে মানুষ কী করবে? নিজের দিদি নম্বর ১ ইমেজ থেকে যদি একজন প্রার্থী বেরোতেই না পারেন তিনি মানুষের কাছে কী আশ্বাস দেবেন? সংসদ তাঁকে দেখতে পাবে, এই তাঁর ভূমিকা? এখানেই শেষ না। হুগলির শিল্প নিয়েও আলটপকা মন্তব্য করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, হুগলির কিছুই তিনি জানেন না, রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়েও তাঁর চর্চা নেই। রাজ্যের শিশুও আজকাল জানে এখানে শিল্প নেই। বিধানসভা, লোকসভা সব নির্বাচনেই বিরোধিদের মূল অস্ত্রই হচ্ছে শিল্পহীনতার অভিযোগ। অথচ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় চোখে ধোঁয়া দেখছেন। কলকারখানার চিমনি থেকে বেরনো গলগল ধোঁয়ায় তাঁর চোখ জ্বালা করছে। হুগলিতে শিল্পের অভাবই নেই! রাস্তাঘাট সব চিমনির ধোঁয়ায় ভরপুর।
রচনা বলেছেন, "আমি যখন এলাম দেখলাম অনেক কারখানা হয়েছে। চিমনি থেকে শুধু ধোঁয়াই ধোঁয়া, রাস্তাঘাট অন্ধকার। শুধু ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এত কারখানা হয়েছে, তাহলে কী করে বলছেন কারখানা হয়নি, হয়েছে আরও হবে।"
শ্রীরামপুর কেন্দ্রের বামপ্রার্থী দীপ্সিতা ধর রচনার রাজনৈতিক চেতনা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। পর্দার অভিনেতা-গায়করা যখন রাজনীতিতে আসেন পর্দার গ্ল্যামারের বাইরে এসে তারা সকলেই প্রায় বলেন মানুষের হয়ে কাজ করবেন। দীপ্সিতা বলছেন, রচনা যে শিল্পের সঙ্গে জড়িত সেখানে বহু টেকনিশয়ান আছেন, শ্রমিক আছেন যাদের নিজস্ব অনেক দাবি দাওয়া আন্দোলন আছে। রচনা কেন এর আগে কোনওদিনই তাঁদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেননি?
সত্যিই তাহলে দলের টিকিটে জিতে সাংসদ হওয়ার পরে এখন বাড়তি মুনাফা থাকে? যে মুনাফার সঙ্গে আসলে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, চাওয়া পাওয়ার কোনও যোগই নেই! রাজনীতি করতেই তাহলে একমাত্র কোনও যোগ্যতা লাগে না আজকাল?