মর্গ থেকে কীভাবে পাচার হত বেওয়ারিশ লাশ? যা জানাচ্ছে সিবিআই
R G Kar Hospital Incident: সিবিআই সূত্রের খবর, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মর্গে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহ থেকে অস্ত্রোপচার করে বের করে নেওয়া হত বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
মর্গ থেকে গোপনে বের করে নেওয়া হত বেওয়ারিশ লাশ। তার পর অস্ত্রোপচার করে বের করে নেওয়া হত জরুরি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেসব বিকাতো বিরাট অঙ্কে। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মৃতদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে এমনই বেআইনি ব্যবসার কথা সামনে এসে গিয়েছে। গত কয়েক বছরে নাকি আড়ে-বহরে বেড়ে উঠেছিল সেই ব্যবসা। কীভাবে হত লাশপাচার। শুধুই কি প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, নাকি এর শিকড় গাঁথা আরও গভীরে। ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে এই সমস্ত প্রশ্ন।
আরজি কর কাণ্ড নিয়ে উত্তাল রাজ্য। গত ৯ অগস্ট আরজি কর কলেজের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল এক তরুণী চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত দেহ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বেরোয় ভয়ঙ্কর ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রমাণ। সেই মামলার তদন্তে নেমে সিবিআইয়ের হাতে আসতে থাকে আরজি কর কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ।
আরজি কর মামলায় গ্রেফতারির আগে সন্দীপ ঘোষকে লাগাতার জেরা করেছে সিবিআই। সেই জেরাতেই সন্দীপের একের পর এক দুষ্কর্মের কথা সামনে এসেছিল। নন মেডিক্যাল ডেপুটি সুপার আখতার আলি আগেই অভিযোগ তুলেছিলেন যে মর্গে ইএনটি-র কর্মশালায় নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে মৃতদেহ পাচার করা হয়। সম্প্রতি সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গত কয়েক বছরে মৃতদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির কারবার ফুলেফেঁপে উঠেছিল।
আরও পড়ুন: আরজি কর মর্গ দুর্নীতি: গভীর রাতে যে সব ভয়াবহ কুকর্ম চলত মর্গে!
আরজি কর হাসপাতালে হতে থাকা দুর্নীতির তদন্তে নেমে দেখা যায়, শুধু আরজি করই নয়, এমন দুর্নীতি চলছে রাজ্যের আরও বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালেও। সেই সব সরকারি হাসপাতালগুলির মর্গও কার্যত দুর্নীতির আড়ত হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে। সিবিআই তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, গত সাত-আট বছরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির মাধ্যমে অন্তত ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত থেকে অন্তত তেমনটাই জানাচ্ছে। আর এই চক্রে জড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালও। ইতিমধ্যেই সেগুলিকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে তদন্তকারী সংস্থাগুলি।
কীভাবে পাচার করা হত মৃতদেহ থেকে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ? সিবিআই সূত্রের খবর, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মর্গে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহ থেকে অস্ত্রোপচার করে বের করে নেওয়া হত বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর সেই সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রয় হত চড়া দামে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এক-একটি অঙ্গের দর উঠত চার থেকে আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত। শুধু যে এ রাজ্যেই সীমিত ছিল এই ব্যবসা, তা নয়। পড়শি একটি দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের মর্গ থেকেও মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হত বলে জানা গিয়েছে। রাজ্যে সাম্প্রতিক কালে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সংখ্যা তুলনায় বেড়েছে। ফলে মানবদেহের হৃদপিণ্ড, যকৃত, কিডনির চাহিদাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। চিকিৎসা-শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি কাজে লাগে। আর সেই সুযোগটা নিয়েই ফুলে ফেঁপে উঠেছে এই বেআইনি ব্যবসা। যেখানে বড় চাঁই হিসেবে উঠে এসেছে সন্দীপ ঘোষের নাম।
সিবিআই তদন্তকারীরা জানান, আর জি কর হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতির মামলায় মূল অভিযোগকারী আখতার আলির সঙ্গে কথা বলেও মর্গ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির কারবারের ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু সূত্র পান গোয়েন্দারা। ওই সূত্রের ভিত্তিতে আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায়। তদন্তকারীদের দাবি, ওই দু’জনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বেআইনি অঙ্গ-ব্যবসার জোরালো সূত্রই মিলছে।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বার আরজি কর কলেজের মর্গে হানা দিয়েছে সিবিআই। গত সাত বছরের ময়না তদন্ত ও বেওয়ারিশ দেহের নথি সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিবিআই। ওই নথিতে একাধিক অসঙ্গতি ধরা পড়েছে তদন্তকারীদের নজরে। আর এই অসঙ্গতিকে ধরেই তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন গোয়েন্দারা। সাম্প্রতিক তালে দক্ষিণবঙ্গের এক সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে বেআইনি ভাবে মৃতদেহ বের করার সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন কয়েক জন। সেই ঘটনায় উঠে আসে বেশ কয়েক জন বড় কর্তার নাম। সে সময় স্থানীয় ডোমের ঘাড়ে দোষ ঠেলে মাথা বাঁচান তাঁরা। শেষমেশ অবশ্য ধামাচাপা পড়ে যায় বিষয়টি। আরজি করের তদন্তের সঙ্গে সেই ঘটনার যোগ টেনে নতুন করে তদন্তের চেষ্টা চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা। তদন্তকারীদের সূত্রের দাবি, রাজ্যের বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের একাংশ ওই বেআইনি কাজে জড়িত বলে প্রাথমিক সূত্র পাওয়া যাচ্ছে এবং ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সন্দীপের জড়িত থাকার ইঙ্গিত মিলছে।
আরও পড়ুন: জোর তল্লাশি এবার আরজি করের মর্গে, কী খুঁজছেন সিবিআই গোয়েন্দারা?
অজ্ঞাত পরিচয়ের দেহ যাকে সাধারণ ভাবে বেওয়ারিশ লাশ বলা হয়, তেমন দেহ সাত দিন পেরোলে পুড়িয়ে দেওয়াই দস্তুর। আইন অনুযায়ী কোনও অজ্ঞাতপরিচয়ের দেহ থেকে অঙ্গ নিতে হলে স্বাস্থ্য ভবনের ছাড়পত্র প্রয়োজন। কিন্তু সেই ছাড়পত্র না নিয়ে ডাক্তারদের বেআইনি সিন্ডিকেটই বেআইনি এই অঙ্গব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত বলে অভিযোগ। আপাতত সেই মামলায় সন্দীপ ঘোষের নাগাল পেয়েছে তদন্তকারীরা। তবে এর সঙ্গে আরও বড় বড় নাম জড়িয়ে রয়েছে বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।