পাল্টে যাওয়া জীবনজগৎ বাস্তবতায় কেন মৃণালকে খুঁজেছেন অঞ্জন?
Chaalchitra Ekhon Review: 'চালচিত্র' সিনেমায় উঠোন পরিষ্কারের যৌথ উদ্যোগের যে ব্যাখ্যা শোনান কুণাল সেন, তাকেই যেন খুঁজে পায় রঞ্জন শুটিংয়ের মধ্যাহ্নভোজনে।
১
পুব বাংলা থেকে ১৫ বছর বয়সে এসেছিলেন মৃণাল সেন। কলকাতায়। তারপর জীবন এবং কর্মকাণ্ডে সর্বদাই জড়িয়ে আছে এই শহর। এমনকী তাঁর উদযাপিত ছবির নাম 'কলকাতা ৭১'। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের খুঁটিনাটি স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ, রাজনীতি থেকে অরাজনীতি, প্রশ্ন - সবই মুঠোয় ধরে গেছেন মৃণাল সেন। জন্ম ১৪ মে, ১৯২৩। প্রয়াণ ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮। তিনি যে সময় কাজ করে গেছেন, আমাদের কৈশোর-যৌবনের সেই দিনরাত্তির, জ্যান্ত হয়ে উঠল 'চালচিত্র এখন' ছায়াছবিতে। নির্দেশক, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার নানা ভূমিকায় অঞ্জন দত্ত সেই ছবিতে হাজির। মৃণাল সেনের ১০১ তম জন্মদিনের দিন চারেক পরে সেই ছবি দেখে বেশ খানিকটা অতীতচারী হয়ে আছি।
হয়তো, অঞ্জনও হয়ে আছেন। যত্নে, শ্রমে, দায়বদ্ধতায়, ভালোবাসায় তিনি এই ছবিতে নির্মাণ করেছেন পুরনো সময়, পুরনো সম্পর্ক আর পুরনো প্রশ্ন। সমকালে যার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। না সময়ের, না সম্পর্কের, না প্রশ্নের। একদিক থেকে ভাবলে, এই ছবির কেন্দ্রে আছেন মৃণাল সেন, ছবিতে যাঁর নাম কুণাল। আছেন রঞ্জন নামের আড়ালে স্বয়ং অঞ্জন দত্ত। বাস্তব থেকে নামের সামান্য রদবদল-সহ কল্পনা ভুবনে আছেন গীতা সেন, কে কে মহাজন থেকে উৎপল দত্ত, একটু শ্রীলা মজুমদার, সামান্য অনুপকুমার এবং আরও অনেকে। বাস্তব-অবাস্তবের এইসব মিশেলে কাহিনিচিত্র দুই স্তরে এগোতে থাকে। গল্পের ভিতরের সময় আর বাইরের সময় আলাদা হয়ে যায়। আবার, একটা সংলাপও চলে উভয়ের মধ্যে। ১৯৮১ সালে বানানো 'চালচিত্র' ছবির অনুষঙ্গ পরতে পরতে মিশতে থাকে 'চালচিত্র এখন' ছবির শরীরে। পাল্টে যাওয়া জীবনজগৎ বাস্তবতায় কেন তাঁকে খুঁজেছেন অঞ্জন? শুধুই কি মৃণাল সেন শতবার্ষিকীর স্বীকৃতি আর অভিবাদন?
আরও পড়ুন- ‘মৃণাল সেনের চোখে দেখেছি আমার শহর’: কথাবার্তায় অঞ্জন দত্ত
২
অঞ্জন বারংবার প্রকাশ্যে-প্রচ্ছন্নে, এই ছবিতে, দুই অবস্থানের মানুষের মিতালি-মতপার্থক্যে যে প্রশ্নের কেন্দ্রে আঘাত করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়, সে হলো ব্যক্তি-সমষ্টির মিথোজীবিতার প্রশ্ন। পিটার ভাইসের মারা-সাদ, রঞ্জনের নাটকের দল, মৃণাল সেনের সমবায়ী শিল্পের গরজে গড়ে ওঠা ইউনিট, কলকাতা আর বার্লিনের খোয়াব- একে অপরকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করে গেছে। ১৯৬৪ সালে মঞ্চায়িত এই নাটকের পটভূমি বা সময়কাল ১৮০৮ সালের। ফরাসি বিপ্লবের সূত্রে একই প্রশ্ন তুলেছিল নাটকটি। ব্যক্তি না সমষ্টি। বিপ্লব কাকে আমূল পাল্টে দেবে? পুরো ছবি জুড়ে সেজন্য নানা মাত্রায় এবং তলে বিবিধ তাৎপর্যে দেখা দেয় 'নিজের চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে' দাঁড় করানোর প্রশ্ন। রঞ্জন নামের মধ্যে মিশে যেতে থাকে যক্ষপুরী এবং অন্তর্ভেদী রঞ্জনরশ্মির প্রসঙ্গ। ঢুকে পড়ে সার্ত্র এবং কামুর 'মাওবাদ' সমর্থন বিষয়ে মতান্তরের কথা। অস্তিত্ববাদ, কিমিতিবাদ এবং মাওবাদের ব্যক্তি-সমষ্টি টানাপড়েন এবং দ্বৈরথের জটিল দীর্ঘ সব প্রসঙ্গ। একদিকে দীপু, অন্যদিকে রঞ্জন, একদিকে মিতা আর সর্বোপরি, কুণাল সেন সেই সন্ধানের বিচিত্র সংগতি সন্ধানে শরিক হয়ে ওঠে। চমৎকার অভিনয় করেছেন দুই কুশীলব, অঞ্জন দত্ত এবং শাওন চক্রবর্তী। অঞ্জন তো মৃণাল সেন কথা বলার ধরণ, মুদ্রাদোষ এমনকী চাহনি পর্যন্ত নকল করেছেন। নবাগত শাওন অসাধারণ। কোথাও তাঁর অভিনয়ে কোনও মসৃণতা বা আত্মবিশ্বাসের অভাব লক্ষ্য করা যায়নি। উভয়ের রসায়ন এই ছবির চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা দিল। ছোট্ট ভূমিকায় বিদীপ্তা এবং সুপ্রভাত অনবদ্য। অন্যরকম অভিনয়ে মন ছুঁয়ে গেলেন শুভাশিস।
কথাটা অবশ্য শুধু অভিনয়ের নয়। কথাটা আরও নানা সংকটের ইশারার। মিনার্ভা থেকে হেঁটে প্রেমিক-প্রেমিকার শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত জোয়ান অফ আর্কের গল্প বলতে বলতে, শুনতে শুনতে হেঁটে যাওয়া, কেননা পকেটে বাসভাড়া নেই, অথবা, উলঙ্গ হয়ে নিজেকে ছবি বানানোর সংকল্প শুনিয়ে এক ধাক্কায় স্থায়ী চাকরি ছেড়ে দেওয়া - সবটাই হয়তো 'দায়বদ্ধতা' নামক এক মানবিক-অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসার মোকাবিলা থেকে জন্ম নেয়। খুবই প্রশংসনীয়, কুণাল সেনের কৌতুকের আবরণে থাকা অভিভাবকত্ব আর বাহ্যিক নির্লিপ্ততার গভীরে তীব্র আবেগের চলাচল। দীপু চরিত্রের আপোস এবং রঞ্জনের সে নিয়ে অস্থিরতা। কান্না। পরিচালকের সঙ্গে মতবিরোধ। আত্মআবিষ্কার। আবার, দর্শকের দিকে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন, নিজের শর্তে বাঁচার অঙ্গীকার কি ভুল না ঠিক? তখনই মুর্শিদাবাদ থেকে আসা অভিনেতা কিংবা স্বপ্নদৃশ্যের অবাস্তব তোলপাড় ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে। পিটার ভাইস তাঁর নাটকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন একদিকে আর্তো আর অন্যদিকে ব্রেখ্টকে। রঞ্জনের দৃশ্যকল্পে, চাবুক মারার সূক্ষ্মতায় সেই চিহ্নক স্পষ্ট। তারপরই কুণাল সেনের 'প্যাশ্টটা পরে এসো' - এক ঝটকায় অভিঘাত ভেঙে দেয়। মজা দিয়ে ক্ষত ঢাকা হলো। সেও কি ব্রেখটীয় নয়?
৩
তৃতীয় কেন্দ্র, আবারও উদঘাটিত হল। তার নাম কলকাতা। অঞ্জন দত্ত সেই কবে থেকে এই শহরকে ঘিরে আবেগমথিত বার্তা দিয়ে চলেছেন। সেই বার্তা যেন এক শহরকে ঘিরে 'বিকল্প' সন্ধানেরই বার্তা। কলকাতা নিয়ে আবেগপ্রবণ মৃণাল সেনও। কলকাতা ৭১ এবং তথ্যচিত্র 'ক্যালকাটা মাই এল ডোরাডো' এবং বহু সাক্ষাৎকার তার স্পষ্ট চিহ্ন! ছবিতে-ছবিতে তার বিস্তার। সেই বিকল্প সন্ধান বেশ খানিকটা ব্যক্তিক। কেননা অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাচর্চার আন্তর্জাতিক সমান্তরে অঞ্জন জানেন একনায়কতন্ত্রের উল্টোপিঠেই থাকে পার্টি শাসনের বহুত্বহীন দমনস্বর। চিঁড়ে চ্যাপ্টা ব্যক্তি তখন কোনও তৃতীয় বিকল্পের সন্ধানী। কলকাতা তখন যেন বহুশরিক এবং বহুস্বরিকের প্রতিনিধি। একমাত্রিক 'কমিউনিজম' এবং একমাত্রিক 'ব্যক্তিবাদ' সেখানে ব্যক্তিত্বহীন সমষ্টিকে একা দর্পণের সামনে দাঁড় করায়। ভিন্ন প্রয়োগে 'প্রিয় বন্ধু' শ্রুতিনাটকের অঞ্জন সেক্ষেত্রে চেনা, যদিও তাঁর এই ছবিতে তিনি অবজেক্টিভ কোরিলেটিভ হিসেবে বেছে নিলেন গুরু শিষ্য, পিতা পুত্রের নিবিড় অথচ সংঘাতময় সম্পর্ককে। মুন্সিয়ানা আছে ক্যামেরারও। সাত দশকের শেষ, আট দশকের গোড়া - এই কালসীমা ধরতে তিনি সেইসব ভিস্যুয়ালই ব্যবহার করলেন, যেখানে কলকাতা থমকে আছে। এমনকি দ্বিতীয় হুগলি সেতুও দেখাননি। আমার চেনা পাড়া, বাজার, স্কুল, জটলা এবং গঙ্গার ঘাট দিয়ে অনায়াসে সেই কলকাতা গড়ে উঠল। নইলে বনগাঁ থেকে রিহার্সালে আসা ছেলেটির কড়া শব্দগুলো বিশ্বস্ত হতে পারত না।
'চালচিত্র' সিনেমায় উঠোন পরিষ্কারের যৌথ উদ্যোগের যে ব্যাখ্যা শোনান কুণাল সেন, তাকেই যেন খুঁজে পায় রঞ্জন শুটিংয়ের মধ্যাহ্নভোজনে। ব্যক্তি আর সমষ্টির একটা চলাচলের শব্দ শোনা যায়। এখানে একটাও বাড়তি শব্দ ব্যবহার না করে, শুধু সিনেমার ভাষা দিয়ে একা রঞ্জনের মুখ, সংলাপহীন, অনেক কথা বলে যায়। পরে, যার সমর্থন পাওয়া যাবে কুণাল সেনের অভিনয় না করে ব্ল্যাঙ্ক তাকিয়ে থাকার নির্দেশে। শেখর দাশের উৎপল দত্ত উঁচু তারে 'প্রোপাগন্ডা' শব্দের সুষম প্রতিধ্বনি তৈরি করে। মূল সিনেমার দৃশ্যটি আবার একবার দেখে নিতে দর্শককে অনুরোধ করব। নইলে নীরবতা-সরবতার এই বনাম বদ্ধ বিপরীত যুগ্মক বোঝা যাবে না।
আরও পড়ুন- সত্যজিৎ, ঋত্বিক নন; মধ্যবিত্ত সমাজকে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন মৃণাল সেনই!
৪
রঞ্জনের অবস্থান থেকে পরিণতি বোঝা গেলেও, কুণাল সেনের অভিমুখ এবং শিল্প সমীক্ষা একটু আবছায়াতেই থেকে যায়। এখানেই অঞ্জন দত্তের সাফল্য। তিনি নিজেকে উপস্থিত করেও একধরনের দূরত্বে পুরোটা দেখতে চেয়েছেন। ফলে, কাহিনি কিংবা চরিত্রের সরল দাগিয়ে দেওয়া পরিণতিতে পৌঁছতে চাননি। ছবিটি এজন্যই আমার কাছে বেশ উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে। আবার একথাও ঠিক, কুণাল সেন পুরোপুরি প্রতীকীও নন। প্রশ্রয় এবং ভিন্নস্বরের স্বীকৃতি দিতে দিতে সে চরিত্রও তো নিজের সঙ্গে সমানে কথা বলে চলেছে। হয়তো সে কারণেই অঞ্জন দত্ত পুরো ছবি জুড়ে এতবার ব্যবহার করে চলেছেন কুমোরটুলির দৃশ্যাবলী। সেইসব ছোট ছোট মন্তাজে মাটির পূর্ণ-অসম্পূর্ণ নানা অবয়ব, ভাঙাচোরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মাথা, চালচিত্র ফিরে ফিরে এসেছে। নিজেকে এবং অন্যকে, এক দর্শন থেকে অন্য অবস্থানের প্রতিনিধিকে পূর্ণাপূর্ণে দেখতে দেখতে চলা যেন। আত্ম এবং অপরকে অধ্যয়নের পরিসর। মূর্তি এবং মূর্তি ভাঙার বাহ্যিক এবং অন্তর্বর্তী প্রক্রিয়া। 'আল পাচিনো কি রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে হাঁটে'। তৃতীয় বিশ্বে এ এক অমোঘ প্রশ্ন। বিনির্মিত হয় আমাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। মূল ছবির উনুন, আর সেই ছবির মাটিতে আছড়ে গিটার ভাঙার দৃশ্য এক পরিবর্তিত পরিস্থিতির ইঙ্গিত করে। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের কলকাতায় ওঠা প্রশ্ন কি আজকের নিয়ন আলোর কর্পোরেট শহরে আদৌ প্রাসঙ্গিক? কয়েকদিন আগে সন্তোষপুরে একটি বইয়ের দোকানে ছোট বৈঠকে অঞ্জন গভীর উদ্বেগে বলছিলেন পরিবর্তমান বাস্তবের কথা। প্রশ্নগুলোর ওপরেও কি তাহলে দৈত্যাকার বহুতল উঠে গেল? যাপনের 'বিকল্প' চিন্তা কি নিশ্চিহ্ন?
৫
দুটো-একটা প্রশ্ন করি। শেষ দৃশ্যের আবেগমোচক কান্না দর্শককেও আরিস্টটলীয় ক্লাইম্যাক্সে উপনীত করে। তারপর তারই সম্প্রসারণে ঢোকে কলকাতার প্রসঙ্গ। নিখুঁত ব্রেখটীয় কৌশলে তারপরই গলি পেরিয়ে আলগোছে হেঁটে যান কুণাল সেন। অতুলনীয় এই দৃশ্যের পর ইংরেজি গানটিও যথাযথ - তবে চরিত্র ধরে ধরে পরিচয় উন্মোচন কি খুব প্রয়োজন ছিল? ক্রেডিট কার্ডে বেশ কয়েকটি বানান ভুল লক্ষ্য করলাম। স্বয়ং কুণাল সেন-ই ভুল বানানে উপস্থিত। সাবটাইটেলে আগাগোড়া, পর্দায় কথিত ইংরেজি আর তলায় তার লিখিত রূপ অজস্রবার আলাদা।
ছবিটি সবাইকে দেখতে অনুরোধ করি। বায়োপিক এবং আত্মজৈবনিক উন্মোচনের এমন নির্মেদ উপস্থাপনা বাংলা ছবিতে বিরল। আমরা, পঞ্চাশোর্ধ্বের যারা ছবিটি উপভোগ করলাম, স্মৃতিমেদুর হলাম, তাঁরা লক্ষ্য রাখছি প্রশ্নগুলো কালপ্রবাহে বীজে-বীজে বাঁচে কিনা। এর উত্তর আশা করছি আসবে পরের প্রজন্মের কাছ থেকে। প্রিয়া সিনেমা থেকে মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম একাধিক পুরনো বাড়ি ধূলিসাৎ হচ্ছে। এ দীর্ঘশ্বাস ব্যক্তির না সমষ্টির? হিঁচড়ে টেনে দাঁড় করানো যাবে কি প্রশ্নগুলো?