গাছ চেরাই নয়! জানেন, চেনের করাত প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল সন্তানের জন্ম দিতে!
Chainsaw for Child Birth: খানিকটা পেনসিল ছোলার মতো করেই, করাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শ্রোণী অঞ্চল কেটে ফেলতেন ডাক্তাররা।
নিমেষে বড় বড় গাছ কেটে দু'ফাঁক করে দেয় করাত। যন্ত্রচালিত করাত দিয়ে শক্ত কাঠের গুঁড়ি সহজেই চেরাই হয়ে যায় কারখানাতেও। তবে এই অস্ত্রের বা যন্ত্রের জন্ম কিন্তু গাছ কাটার জন্য নয়। এর প্রাথমিক ব্যবহার জানলে চোখ কপালে উঠবে! গাছেরা নয়, মানুষের জন্যই প্রথম তৈরি হয় চেনের করাত। তবে মানুষ কাটার জন্য না, মানুষকে কোনও শাস্তি দিতেও না। মানুষের জন্ম দিতে প্রথম এই জাতীয় করাতের ব্যবহার! যৌনাঙ্গ থেকে সন্তানকে বের করে আনতেই তৈরি হয়েছিল এই করাত। শুনতে ভয়ানক হলেও, প্রাচীন কালে ঠিক এতখানিই বীভৎস ছিল সন্তান জন্ম দেওয়ার পদ্ধতি!
চেইনশ বা চেনের করার মূলত সন্তান জন্মদানে সাহায্য করার উপকরণ হিসাবেই তৈরি হয়েছিল। এখন সি-সেকশন করা হয় বটে, তবে আগে সিম্ফিজিওটমি নামে পরিচিত একটি অস্ত্রোপচার ছিল। ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ সেই পদ্ধতি। এই প্রাচীন অস্ত্রোপচার পদ্ধতিতে বাম এবং ডান পেলভিক হাড়ের মধ্যকার তরুণাস্থি কেটে ফেলা হতো, এভাবে পেলভিস বা শ্রোণী অঞ্চলকে প্রশস্ত করা হতো এবং প্রসব ঘটানো হতো।
কীভাবে সি-সেকশন হতো আগে?
সন্তানের জন্ম দেওয়া আজও সহজ নয়। নানারকমের ঝুঁকি তাতে থাকেই। তবে যত উন্নত হয়েছে অস্ত্রোপচার ও ওষুধপত্র, তত প্রাণ বেঁচেছে জন্মদাত্রীদের। তবে যখন নাইট্রাস অক্সাইড, স্যানিটেশন এবং মরফিনের ব্যবস্থা ছিল না কোনও, পেট চিরে অস্ত্রোপচার ছিল সাংঘাতিক কষ্টের। সফল সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশনের প্রথম লিখিত রেকর্ডটি মেলে ১৫০০-র দশকের সুইজারল্যান্ডে। নিজের স্ত্রীর অপারেশন করেছিলেন এক ব্যক্তি। পেশায় তিনি গরুদের কাস্ট্রেটর! সেই সময়ের খুব সামান্য পাওয়া তথ্য বলে, মা এবং শিশু দু'জনেই বেঁচেছিল। শিশুটি ৭৭ বছর বয়স অবধি বেঁচেও ছিলেন।
আরও পড়ুন- টয়লেট পেপার নয়, এক সময়ে ভুট্টাই ছিল মানুষের শৌচাগারের অন্যতম সঙ্গী
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সি-সেকশনের ঘটনাটি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ওয়েস্টার্ন জার্নাল অব মেডিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সের ১৮৩০ সালের সংস্করণে, ডাঃ জন এল রিচমন্ড ঝড়ের সময় এক সন্তানের জন্মের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। অনেক ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করে প্রসব না হওয়ায় চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, ওই মহিলার জীবন গুরুতর বিপদের মুখে রয়েছে। চিকিৎসক প্রচণ্ড ঝুঁকি মাথায় খুব সাধারণ কিছু যন্ত্র নিয়েই সেইদিন রাত্রি প্রায় ১ টা নাগাদ সিজারিয়ান সেকশন শুরু করেন।
আঁকাবাঁকা কাঁচি নিয়েই চিকিৎসক মায়ের পেট কেটে ফেলেন এবং সন্তান বের করার চেষ্টা করেন। যেহেতু সন্তানের আকার বেশ বড় ছিল এবং মা-ও ছিলেন স্থূলকায় ফলে যতটা সহজে কাজটা হবে ভেবেছিলেন ততটা হলো না মোটেও। অভাবনীয় যন্ত্রণা পেতে থাকলেন ওই মহিলা। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, হয় মা বাঁচবেন না হয় সন্তান! চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিলেন, মা ছাড়া সন্তানের চেয়ে নিঃসন্তান মা কম কষ্ট পাবেন। তাই মাকে বাঁচানোর এবং ভ্রূণটিকে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যানেস্থেশিয়ার আগে সি-সেকশন ছিল এমনই তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ। তাই খুব একটা অস্ত্রোপচার হতোও না তখন।
আরও পড়ুন- যৌনতার খেলনা নয়, উন্মাদনার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো ‘রেক্টাল ডাইলেটর’?
কেন চেইনশ তৈরি হয়েছিল?
১৫৯৭ থেকে সি-সেকশন তুলনামূলক নিরাপদ হয়ে উঠল। এর আগে সিম্ফিজিওটমি নামে পরিচিত একটি অস্ত্রোপচার ছিল। এই পদ্ধতিতে পিউবিক সিম্ফিসিস অর্থাৎ ভালভার উপরে তরুণাস্থি দিয়ে তৈরি জয়েন্ট কেটে ফেলা হতো পেলভিসকে প্রশস্ত করতে এবং প্রসবকে সহজ করতে। প্রবল ঝুঁকি ছিল এতেও। অপারেশনে যত কম সময় লাগবে, রোগীর মারাত্মক সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা তত কম। অনেকক্ষণ ধরে যদি অস্ত্রোপচার চলে তাহলে মুশকিল রোগীকে বাঁচানো।
১৮ শতকের শেষের দিকে, দুই স্কটিশ ডাক্তার, জন আইটকেন এবং জেমস জেফ্রে এই অস্ত্রোপচারের কাজটি আরও দ্রুত এবং দক্ষআবে করার জন্য চেনের করাত বিষয়টি ব্যবহারের কথা ভাবেন প্রথম। বিশ্বের প্রথম চেইনশ ছিল এমন একটি করাত যাতে হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওই ধারালো দাঁতগুলি দিয়ে চেরাই করা হতো। খানিকটা পেনসিল ছোলার মতো করেই, করাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শ্রোণী অঞ্চল কেটে ফেলতেন ডাক্তাররা। বোঝাই যাচ্ছে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কী মর্মান্তিক হতে পারত পরিণতি। পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে যাওয়া অস্থিসন্ধি অপসারণের জন্য ব্যবহার হতো এই করাত। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার ছিল চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তারপর থেকে আর মানুষের দেহ চিরে সন্তানের জন্ম দিতে এই ভয়াবহ করাত ব্যবহার করতেন না চিকিৎসকেরা। মানুষের দেহ থেকে সোজা গাছ চেরাইতে প্রয়োগ হতে থাকল চেইন করাত।