শেষপর্যন্ত চাঁদের মাটি স্পর্শ করতে পারবে তো চন্দ্রযান ৩?
Chandrayaan-3 to land on Moon: আপাতত চাঁদের আকাশে ২৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সেটি। সেখান থেকেই চাঁদের মাটিতে নেমে আসার কথা তার। কিন্তু পরিস্থিতি ও ল্যান্ডার মডিউলের অবস্থা কি আদৌ সঙ্গ দেবে, ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের।
অপেক্ষা মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার। চাঁদের মাটি ছোঁবে বহু প্রতীক্ষিত চন্দ্রযান ৩। বারবার ব্যর্থতার পরেও হার মানে না বিজ্ঞান। আর এইখানটিতেই তার সবচেয়ে বড় সাফল্য। বছর কয়েক আগের কথা। সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল চন্দ্রযান ২। বিজ্ঞানীদের এত এত দিনের পরিশ্রম মাটিতে মিশে গিয়েছিল এক মুহূর্তে। তবু হার মানেননি তাঁরা। ফের রণসাজে সেজে তাঁরা চন্দ্রপাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করেছেন চন্দ্রযান ৩-কে। গত ১৪ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে মহাকাশে পাড়ি দেয় সেটি। ৫ অগস্ট তা পৌঁছে যায় চাঁদের কক্ষপথে। ২৩ অগস্ট, বুধবার সেটির চাঁদে পা দেওয়ার কথা।
আরও পড়ুন: চাঁদ ছুঁতে আর সামান্য কয়েক ঘণ্টা! চন্দ্রযান ৩-এর সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা?
নির্ধারিত সময় অনুযায়ী, বুধবার বিকেল পৌনে ছ'টায় চাঁদের মাটি ছোঁয়ার কথা ছিল চন্দ্রযান ২-এর। প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, সময় কিছুটা পিছিয়েছে। পৌনে ছ'টার পরিবর্তে সন্ধে ৬টা বেজে ৪ নাগাদ অবতরণ করবে চন্দ্রযান ৩। তবে কথা দিয়েও রাখতে পারলেন না ইসরোর বিজ্ঞানীরা। শেষলগ্নে তৈরি হল অনিশ্চিয়তা। ভারতীয় মহকাশ সংস্থা ইসরোর তরফে নতুন করে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি অনুকূল না থাকলে পিছনো হতে পারে অবতরণ। সে ক্ষেত্রে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার তারিখ চারদিন পিছিয়ে বুধবারের পরিবর্তে রবিবারও হতে পারে। একদিন আগেই ইসরোর স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারের ডিরেক্টর নিলেশ এম দেশাই জানান, কবে অবতরণ হবে, সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ২৩ অগস্ট অবতরণের দু'ঘণ্টা আগে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ল্যান্ডার মডিউলের অবস্থা এবং চাঁদের পরিস্থিতি বুঝে ঠিক করা হবে অবতরণের সময়। সামান্যতম প্রতিকূল অবস্থা বুঝলেই অবতরণ পিছিয়ে ২৭ তারিখ করা হবে। তেমনই বিকল্প ভেবে রেখেছে ইসরো।
২০১৯ সালে চাঁদজয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল চন্দ্রযান ২। চাঁদের মাটিতে পা দিতে যাবে কি যাবে না, মাত্র ২.১ কিলোমিটার দূরে আচমকাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল এর ল্যান্ডার। ইসরো জানায়, সফটওয়্যার গোলযোগের কারণেই কাজ করেনি ব্রেক। ধীরে ধীরে নামার বদলে চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান ২। তবে চাঁদের কক্ষপথেই থেকে গিয়েছিল চন্দ্রযান ২-এর অরবিটার। তবে ওই যে 'হারায় যা তা হারায় শুধু চোখে।' চাঁদের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে চন্দ্রযান ২ এর সেই অরবিটারের সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গিয়েছে চন্দ্রযান ৩-এর বিক্রমের।
ইসরোর তরফে জানানো হয়, ওই দুটি যানের মধ্যে দ্বিমুখী একটি যোগাযোগ স্থাপিত হয় দেখা হওয়ার পরেই। চন্দ্রযান ৩ বিক্রম ল্যান্ডার চন্দ্রযান-২ অরবিটারের সঙ্গে যোগাযোগও স্থাপন করে। আর চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার আগে এ খবর খানিকটা আশাপ্রদ তো বটেই। কীভাবে দুই প্রজন্মের অরবিটারের দেখা হল, এ নিয়ে একটি অ্যানিমেটেড উপস্থাপনাও প্রস্তুত করে ইসরো। তারা আরও জানায়, এই সাক্ষাৎ ও দ্বিমুখী যোগাযোগের ফলে ল্যান্ডার মডিউলে পৌঁছনোর আরও একটা রাস্তা বেরিয়ে এসেছে ইসরোর কাছে। এবার অপেক্ষা শুধুই ল্যান্ডিংয়ের।
কিন্তু সেই ল্যান্ডিং ঘিরেই ফের সংশয় দানা বেঁধেছে বিজ্ঞানীদের অন্দরে। ২৩ অগস্ট ল্যান্ডিংয়ের যে সম্ভাবনা গাঢ় হয়ে উঠেছিল, সেই ব্যাপারে নিঃসংশয় হতে পারছেন না তাঁরা। চাঁদ ছোঁয়ার জন্য বর্তমানে সর্বনিম্ন কক্ষপথে প্রতীক্ষায় রয়েছে ল্যান্ডার বিক্রম। সোমবার রাত পর্যন্ত বিক্রমের গতিবিধি একেবারে স্বাভাবিক ছিল। রবিবার দ্বিতীয় দফায় গতি কমানোর পর তা নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ হয়েছে। আপাতত চাঁদের আকাশে ২৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সেটি। সেখান থেকেই চাঁদের মাটিতে নেমে আসার কথা তার। হিসেব অনুযায়ী, ২৫ কিলোমিটারের কক্ষপথ থেকে চাঁদের মাটিতে সফট স্যান্ডিং করতে বিক্রমের সময় লাগার কথা ১৭ মিনিট। কিন্তু পরিস্থিতি ও ল্যান্ডার মডিউলের অবস্থা কি আদৌ সঙ্গ দেবে, ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের। সব কিছু ঠিক থাকলে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ীই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে নামবে বিক্রম। তার পর তার পেটের ভিতর থেকে নেমে আসবে রোবট গাড়ি প্রজ্ঞান। একদিকে যখন বিক্রম অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে কাজ শুরু করে দিয়েছে চন্দ্রযান ৩-এর অরবাইটার। ইতিমধ্যেই তার পাঠানো বেশ কিছু ছবি প্রকাশও করেছে ইসরো।
তবে এ বার তেমন কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না মহাকাশবিজ্ঞানীরা। গত বার মুহূর্তের অপ্রস্তুতিতে চন্দ্রযান ২-এর পাশা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের সমস্ত স্বপ্ন, আশাও। তবে এ বার তেমন কোনও ভুল করতে রাজি নয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এর আগে আমেরিকা, রাশিয়া ও চিন শুধুমাত্র চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে। চাঁদ অভিযান সফল হলেই সেদিক থেকে 'এলিট' দেশের তালিকায় ঢুকে পড়বে ভারতও। শুধু তাই নয়, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী হিসেবে প্রথম দেশ হবে ভারত।
আরও পড়ুন:চাঁদে যেতে গিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলেন ওঁরা
চন্দ্রযান ৩-র সাফল্য নিয়ে গোটা দেশ উৎকণ্ঠায়। উত্তেজিতও বটে। সেই উত্তেজনার ছোঁয়াচ পৌঁছে গিয়েছে বিজেপি সদর দফতরেও। চাঁদের মাটি ছোঁয়ার আগেই সেই সাফল্যের যাবতীয় কৃতিত্ব যেচে পড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘাড়ে তুলে গিয়েছেন মন্ত্রী জীতেন্দ্র সিংহ। তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কারণেই দেশের এমন উন্নতি। শুধুমাত্র পরিকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, দেশের মহাকাশ গবেষণাকে যে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে, তা তো মোদির জোরেই। আগের সরকার এমন ব্যপার স্যাপারে একেবারেই মাথা ঘামায়নি বলেও তোপ দেগেছেন তিনি। যদিও চন্দ্রযান ৩ ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা তুঙ্গে, তবু মহাকাশ অভিযান বলে কথা। যে কোনও মুহূর্তে যা কিছু হতে পারে। সাফল্যের আগেই যে সাফল্যের ভার মোদির ঘাড়ে যাচ্ছে, ব্যর্থতার ভারও কি তাঁর পিঠেই চাপাবেন দলের সতীর্থরা! সে কথাও কিন্তু ভাবাচ্ছে চন্দ্রযান ৩-র সফল অবতরণের মতোই!