কী ছিল, কী হল! প্রিয় পিকনিকের মরণযাত্রা ডেকে আনল বাঙালি নিজেই?

Picnic of Bengalis: পুরনো মেজাজ হারিয়েছে চড়ুইভাতি সংস্কৃতি। আজ শীতের দিনগুলিতে পিকনিক বদলে গেছে ফ্যামিলি গেটটুগেদারে।

একটা দিনের মুছল স্মৃতি, ঘুচল চড়িভাতি,

পোড়াকাঠের ছাই পড়ে রয়, নামে আঁধাররাতি।

'চড়িভাতি'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শীতের কাঁচা-মিঠে রোদ গায়ে মেখে চড়ুইভাতির আনন্দে আত্মহারা হওয়ার স্মৃতি জীবনের সম্বল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে সেই গল্প। কুয়াশাঘেরা কোনও এক সকালে বন্ধুদের সঙ্গে বা পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে কাটানো একটা দিনের অপেক্ষায় কাটে বছরভর। পৌষ-মাঘের হাড়কাঁপানো শীতে গনগনে আগুনের শিখায় রান্নার আসর বসে এক জনহীন প্রান্তরে। সঙ্গে থাকে চোঙ বা বক্স। প্রকৃতির কোলে দিনভর হুল্লোড় আর খাওয়াদাওয়া। এরই নাম চড়ুইভাতি বা পিকনিক বা বনভোজন। তবে পিকনিককে শুধু আধুনিক সভ্যতার অংশ মনে করলে একবারেই ভুল ভাবা হবে। বহু যুগ আগে থেকেই প্রকৃতির কোলে বসে খাওয়াদাওয়ার রীতি চালু ছিল। আজ বিবর্তনের নিয়ম মেনে চড়ুইভাতির মেনুর পরিবর্তন হয়েছে শুধু, উদ্দেশ্য ও আনন্দর বদল হয়নি।

পিকনিক বা চড়ুইভাতি কাকে বলে?

পিকনিক একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ, যার অর্থ প্রকৃতির কোলে বসে খাওয়াদাওয়া এবং হইহুল্লোড় করা। খাওয়াদাওয়া বলতে রোজকার সাধারণ ঘরোয়া পদগুলির বদলে একটু অন্য ধরনের খাওয়ার কথাই এক্ষেত্রে বিবেচ্য। নদীতীর, পার্ক, গ্রামের শেষে একটুকরো ফাঁকা মাঠ বা কোনও বাগানবাড়ি পিকনিকের আদর্শ জায়গা। 'পিকনিক' শব্দের বাংলা সংস্করণ চড়ুইভাতি। অনেকেই মনে করেন, বনে-বাদাড়ে চড়াইপাখির কিচিরমিচির ডাকের ছন্দে সংগৃহীত খাবার একসঙ্গে খাওয়া থেকেই হয়তো চড়ুইভাতি কথাটি এসেছে। অঞ্চল ও সংস্কৃতিভেদে এর নাম ভিন্ন হয়ে যায়। আরও একটি শব্দ পিকনিক বোঝাতে বাঙালি ব্যবহার করে, তা হলো বনভোজন। অনেকের মতেই, এই বনভোজনের সঙ্গে বাঙালির প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১১ সালে তাঁর লেখা 'অচলায়তন' নাটকে নতুন শব্দ উল্লেখ করেন- 'বনভোজন'। 'চোখের বালি' উপন্যাসে আশালতা আর বিনোদিনীর শান্ত পরিবেশে চড়ুইভাতির দৃশ্য বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা রয়েছে।

Movie Scene

'অরণ‍্যের দিনরাত্রি' ছবির মেমরি গেমের দৃশ্য

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিতে পিকনিকে মেমরি গেম খেলার দৃশ্যও ভোলার নয়। মার্গারেট মিসেলের 'গড উইথ দ্য উইন্ড' নির্মিত হয়েছে একদল শহরবাসীর বনে গিয়ে পিকনিক করার প্রস্তুতি নিয়ে। এছাড়া টেনিদার ভয়াবহ পিকনিক আয়োজনের কেলেঙ্কারিগুলি চিরকাল বাঙালির মনে থেকে যাবে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত টেনিদা সমগ্রের 'বনভোজনের ব্যাপার' গল্প বোধহয় আমাদের সবার অভিজ্ঞতার ছবি। বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে টেনিদার মতোই বিরিয়ানি, পোলাও, কোর্মা আদতে খিচুড়ি, ডিমে এসে ঠেকে। তাও কোনওভাবে উতরে যেতে পারলে বাঁচোয়া। আবার হিমানীশ গোস্বামীর জীব্রামেও বনভোজনের বিপুল আয়োজন ভেস্তে গিয়ে পড়ে থাকে কেবল শসা, যাকে 'শসাগড়া পৃথিবী' বলে অভিহিত করেছিলেন হিমানীশ গোস্বামী।

আরও পড়ুন: কোথায় হারিয়ে গেল উত্তর কলকাতার বিখ্যাত সিনেমা হলগুলো?

চড়ুইভাতির আঁতুড়

ফ্রান্সকে আধুনিক পিকনিকের আঁতুড় বলে মনে করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের পর যখন দেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরছিল, সেই সময় সাধারণ মানুষ বাইরে কোনও পার্কে একত্রিত হয়ে সময় কাটাতেন। সঙ্গে থাকত খাবার ও পানীয়র ব্যবস্থা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বিশ্বজুড়ে পিকনিকের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে। তবে খোলা আকাশের নিচে পিকনিকের ধারণা জনপ্রিয়তা পায় ইংল্যান্ডে বিংশ শতাব্দীতে। ১৭৬৩ সালে লেডি মেরি কোক তাঁর বোনকে লেখা চিঠিতে পিকনিক পার্টির কথা উল্লেখ করেন। ১৮০২ সাল নাগাদ লন্ডনে ২০০ জন সদস্যকে নিয়ে পিকনিক সোসাইটিও গড়ে উঠেছিল। খাদ্য-ঐতিহাসিক পলি রাসেলের মতে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল এই সোসাইটি। টটেনহ্যাম স্ট্রিটের একটি ভাড়া করা বাড়িতে তাঁরা দেখা করতেন। নাট্য-বিনোদনের পাশাপাশি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকত সেখানে। ভাড়ার সেই বাড়িতে কোনও রান্নাঘর না থাকায় খাবার তৈরি আসত বাইরে থেকেই। এই সোসাইটির সব সদস্যরা মিলেই পার্টির এক একটি দায়িত্ব ভাগ করে নিতেন। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে পিকনিক ছিল সামন্তপ্রভুদের কাছে প্রকৃতির মাঝে খাওয়াদাওয়ার অলস অবসর। এই থেকেই সাধারণ মধ্যবিত্তর জীবনে ঢুকে পড়ে পিকনিক অবসর। চার দেওয়ালে ঘেরা বাড়ির বদলে খোলা আকাশ ও প্রকৃতি হয়ে ওঠে পিকনিকের আদর্শ জায়গা।

সেকালের ভারতীয় চড়ুইভাতি

আমাদের দেশে চড়ুইভাতি বা পিকনিকের ইতিহাস বহু পুরনো। ধ্রুপদী ভারতীয় শিল্পে ও সাহিত্যে পিকনিক ও বাগানে পার্টির উল্লেখ রয়েছে বহু জায়গায়। ভারতীয় রাজা-মহারাজারাও পরিবার, সৈন্যবাহিনী নিয়ে মৃগয়া করতে বেরোতেন। খাওয়াদাওয়া ও পানীয়ের ব্যবস্থা থাকত ঢালাও। কৌশাম্বিতে শুঙ্গ যুগের একটি টেরাকোটার মূর্তি পাওয়া গেছে, যেখানে রথের মাঝে পিকনিক পার্টি চিত্রিত রয়েছে। বিনোদচন্দ্র শ্রীবাস্তব তাঁর বই 'হিস্ট্রি অফ এগ্রিকালচার ইন ইন্ডিয়া'-তে উল্লেখ করেছেন যে, ওই মূর্তির মাঝে একটি বড় প্লেট রয়েছে, যাতে রান্না করা চাল, ডাল, মিষ্টি ও নানারকম পদ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এমনকী, মহাভারতেও পিকনিকের উল্লেখ রয়েছে। অর্জুন, কৃষ্ণ ও বলরামের সেই পিকনিকে সবরকমের সুরার ব্যবস্থা ছিল। কাদম্বরী, মাধবিকা এবং ঋতুকালীন ফুলের সুবাসযুক্ত রাম ছিল পিকনিকে।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে লেখা বাৎস্যায়নের কামসূত্র গ্রন্থেও উদয়ন যাত্রা বা সমাজের ধনী মানুষদের সারাদিনব্যাপী বাগানে পিকনিকের কথাও জানা যায়। উদয়ন যাত্রায় বাড়ির চাকররা রান্না করে রকমারি পদ পরিবেশন করতেন। দিনশেষে বাবুরা বাড়ি ফেরার সময় ফুল, গাছের পাতা বা ছোট গাছের চারা পিকনিকের স্মৃতি হিসেবে বাড়ি নিয়ে যেতেন।

পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট ও তাঁদের পারিষদরাও জোৎস্নারাতে মিলিত হতেন চড়ুইভাতির উদ্দেশ্যে। ষোড়শ শতকে বিখ্যাত পার্সি চিত্রশিল্পী মীর সৈয়দ আলির আঁকা ছবি 'দ্য প্রিন্সেস অফ দ্য হাউস অফ তৈমুর'-এ দেখা গেছে হুমায়ূন আসনে বসে চড়ুইভাতির আনন্দে মেতে উঠেছেন। রাজকর্মচারীরা গাছের তলায় বসে থাকা অতিথিদের খাবার, পানীয় পরিবেশন করছেন। চার্লস বস্কারভিল্লের ছবিতে আরও আধুনিক সময়ের পিকনিকের রূপ ধরা পড়েছে। ১৯৩৭ সালে তিনি বলেন, জয়পুরের মহারাজার আয়োজন করা পিকনিকে খাবার এসেছিল লরি করে। পিকনিকের মেনুতে ইউরোপিয়ান খাবারের সঙ্গে ছিল নানা ধরনের ভারতীয় পদও। শূকরের মাথা দিয়ে তৈরি তরকারি, শাক ভাজা আর সঙ্গে হুইস্কি, বিয়ার, সিডার ( আপেল থেকে তৈরি সুরাবিশেষ) এবং জল পরিবেশন করা হয়েছিল অতিথিদের।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে চড়ুইভাতি

রাজকীয় পিকনিক বা চড়ুইভাতি প্রায়শই বৈভবের উপলক্ষ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগের সহজাত মাধ্যম ছিল চড়ুইভাতি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রয়েছে চড়ুইভাতির ধারণা। সময়ের ব্যবধানে পরিবেশের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আচার চড়ুইভাতি। দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুতে, তামিল মাস আদির আঠেরোতম দিনে মানুষ কাবেরী নদী বা জলাশয়ের সামনে মিলিত হন। বর্ষার আগে জলের উদ্দেশ্যে আদি পেরুক্কু উৎসব পালন করেন। এই উৎসবে চড়ুইভাতির মেজাজে কলাপাতায় করে নানা ধরনের মশলা দিয়ে তৈরি পদ, যেমন লেমন রাইস, দই ভাত, নারকেল ভাত ইত্যাদি খাওয়া হয়। তামিলনাড়ুর মুসলিম ধর্মের মানুষের মধ্যেও জলপ্রপাতের কাছে চড়ুইভাতি করার আচার রয়েছে। এক্ষেত্রে খাবার বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে যাওয়া হয় বা ওই পিকনিকের জায়গাতেই রান্না করে খাওয়া হয়। পাশের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশেও এমন উৎসব পালন করা হয় যার নাম 'কার্তিকা বনভোজনালু'। কার্তিক মাসে আমলকি গাছের তলায় বসে সকলে চড়ুইভাতি করেন। হিন্দু পুরাণমতে, আমলকি গাছে ঈশ্বর বাস করেন এবং এই গাছের তলায় বসে খাবার খেলে শরীর সুস্থ থাকে। এই উৎসবে সুগন্ধি ভাত, ভাজা, ভাডিয়ালু (স্থানীয় পদ), মশলা দিয়ে তৈরি ডাল, মিষ্টির পদ পরিবেশন করা হয়।

একালের চড়ুইভাতি

ভারতে বসবাসকারী সব ধর্ম-বর্ণর মানুষের মধ্যেই চড়ুইভাতিতে পরিবেশন করা হয়, এমন কিছু বিশেষ খাবার রয়েছে। যেমন আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যে কোনও বাঙালি পিকনিকের কথা চিন্তা করলেই যে যে খাবারগুলির কথা মনে পড়ে সেগুলি হলো পাঁউরুটি, কলা, সেদ্ধ ডিম, কেক, জয়নগরের মোয়া। এ তো গেলো সকালের জলখাবারের কথা। অনেকে আবার কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম আর জয়নগরের মোয়াও রাখেন সকালের জলখাবারে। সারাদিন ধরে চা, পকোড়ার সঙ্গে চলে দেদার নাচ-গান আর নানা ধরনের খেলা। দুপুরের খাবারে ভাত, ডাল, ঝুড়ো আলুভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি- একেবারে এলাহি আয়োজন। আনন্দে আটখানা কচি থেকে বুড়ো- সব বয়সিরা। একসময় খাওয়াদাওয়া হতো কলাপাতায়। তারপর এল শালপাতার থালা। আজ থার্মোকলের থালা, গ্লাস বাজারে পাওয়া গেলেও কলাপাতায় পিকনিক খাওয়ার মজা ছিল অন্যরকম। বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে হাত পুড়িয়ে কতশত রান্নার আবিষ্কার- আমাদের সকলের জীবনেরই সোনালি অধ্যায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় জীবনের রূপ বদলেছে, পরিবর্তন এসেছে পিকনিকেও। পিকনিকের আড্ডা, মন খোলা আনন্দের সঙ্গে নেশা ও দুর্ঘটনা জড়িয়ে গেছে একালের চড়ুইভাতির সঙ্গে। এক শ্রেণির মানুষের কাছে পিকনিকের অর্থ বীভৎস আওয়াজে ডিজে বাজিয়ে শুধুই হাত-পা ছোড়া। পিকনিকে অশালীনতাই নিউ নর্মাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকন্ঠ মদ্যপান করে তালজ্ঞান হারিয়ে নদীতে নেমে তলিয়ে গেছে কত তরুণ প্রাণ কিংবা পিষে দিয়েছে কোনও গাড়ি। আর পরিবেশের কথা না বলাই ভালো। প্রকৃতির বুকে খানিক সময় কাটাতে গিয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে পরিবেশকে। চড়ুইভাতির আনন্দ শেষে পড়ে থাকা এঁটো থালা, গ্লাস, মদের বোতল তারই প্রমাণ। ফলস্বরূপ চেনা পুরনো মেজাজ হারিয়েছে চড়ুইভাতি সংস্কৃতি। আজ শীতের দিনগুলিতে পিকনিক বদলে গেছে ফ্যামিলি গেটটুগেদারে। মানুষের উন্মাদনাতেও ভাটা পড়েছে। ফলে পিকনিকের প্রাণখোলা আনন্দও আজ হারিয়ে গেছে, প্রয়াণ ঘটছে চড়ুইভাতির।

More Articles