৩৬৮ দিন লোকেশনে এসে বসেছিল সকলে, আসেননি চ্যাপলিন! যেভাবে তৈরি হলো সিটি লাইটস...
Charlie Chaplin City Lights: চ্যাপলিন নাকি একবার “চ্যাপলিনের মতো দেখতে কে?” এই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলেন। বিচারকরা তাঁকে তৃতীয় স্থান দেন।
“মানুষ হাসতে চায়, কিন্তু তাঁদের হাসানো ভারী কঠিন। মানুষ কাঁদতে চায় না, কিন্তু তাঁদের কাঁদানো ততটাই সোজা”
প্রায়ই বলতেন চ্যাপলিন। তাঁর 'মাই অটোবায়োগ্রাফি' ইংরাজি সাহিত্যের সেরা আত্মজীবনীদের একটা, যতক্ষণ না আপনি জানতে পারছেন বইটার অর্ধেকের বেশি মিথ্যে, বানানো। চ্যাপলিন সযত্নে এড়িয়ে গেছেন তাঁর মায়ের বেশ্যাবৃত্তির কথা। মায়ের সঙ্গে স্টেজে গাইবার যে দারুণ গল্পটা আছে, যেখানে হানার গলা ভেঙে যায়, আর চার্লি বাকিটা গেয়ে দেয়, সেটাও পুরো মিথ্যে (কেনেথ লিন আর ডেভিড রবিনসন তথ্য প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন চ্যাপলিনের জন্মের আগেই হানা স্টেজ ছেড়ে দেন। দেহব্যবসা ছাড়া অন্য কোনও আয় ছিল না তাঁর। তাই প্রায়ই পুলিশ তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যেত)। এমনকী চার্লির বইতে সিডনি আর চার্লি ছাড়া হানার আর এক অবৈধ সন্তান লিও ডার্ডেনের উল্লেখটুকু নেই।
নিজের আত্মজীবনীর শুরুর লাইনে সেই যে এক মিথ্যে লিখে গেলেন চার্লি, তাতে তাঁর জন্মদিনটাই বদলে গেল একেবারে। শুরুতেই তিনি লিখছেন,
"I was born on 16th April, 1889, at eight o' clock at night, in East Lane..."
গুগুল খুলে দেখুন, সবাই এই দিনটাকেই তাঁর জন্মদিন মানে। মজাটা হয় তখনই যখন দেখি, এর আগে অন্তত তিনবার চ্যাপলিন তিন রকম দিন, সময় আর জায়গার নাম বলেছেন। একবার তো নিজেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জমিদারের ছেলেও বলেছেন।
তাহলে সত্যিটা কী? একটু পুরনো খবরের কাগজ উল্টানো যাক। ১১ মে ১৮৮৯ সালে The Magnet পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল একটা ছোট্ট খবর। যে সব ছেলেমেয়ের বাবা মা নিজেরা উদ্যোগ নিতেন না শিশুর জন্মপত্র তৈরিতে, তাঁদের জন্মের রেজিস্টার এভাবেই হতো। চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়ার এই শিশুকে তাঁর নাম দিতে রাজি হন, যদিও তিনি এঁর জন্মের আগে বহুদিন হানার সঙ্গে ছিলেন না। কেন? তা জানা যায় না। চ্যাপলিন বড় হয়ে একবার বলেওছিলেন “আমার বাবার সঙ্গে আমার চেহারা বা স্বভাবে কোনও মিল নেই। কেন যেন মনে হয় আমি কোনও ইহুদির ছেলে। আমার চেহারা, পয়সার প্রতি লোভ, কোনও ইহুদি বাবাকেই মনে করায়”। এটাই শিশুটির জন্মের একমাত্র অফিশিয়াল ডকুমেন্ট। এখানে তারিখ বলা হয়েছে ১৫ এপ্রিল। আর হানা চ্যাপলিনের মঞ্চের নাম লিলি হার্লে ব্যবহার করা হয়েছে মায়ের নাম হিসেবে।
চার্লির জীবন নিয়ে এমন মিথ ভূরি ভূরি। আর তার প্রধান কারণ চ্যাপলিন বহু ক্ষেত্রে নিজেই তাতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। একটা গল্প বাজারে খুব চলে। চ্যাপলিন নাকি একবার “চ্যাপলিনের মতো দেখতে কে?” এই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলেন। বিচারকরা তাঁকে তৃতীয় স্থান দেন। এই গল্পটা ছোট থেকে এত শুনেছি, আমিও সত্যি ভাবতাম। তারপর ডেভিড রবিনসনের সেই প্রায় হাজার পাতার চ্যাপলিনের জীবনী পড়ে ভুল ভাঙল। সেই বই থেকেই ক’টা তথ্য দেওয়া যাক।
আরও পড়ুন- ১৬ বছরেই গলায় চরম মাদকতা! ‘স্নো হোয়াইট’-এর পর কোথাও কেন গলা দিলেন না গায়িকা?
১। ১৯২০ সালের ২০ আগস্ট সিঙ্গাপুরের The Straits Times-এ একটা সংবাদ প্রকাশ পেল। নাম "How Charlie Chaplin Failed," যাতে এই মিথটা প্রথম বাজারে ছাড়া হলো। মনে রাখতে হবে, সেটা ছিল একেবারেই গসিপ পাল্প পত্রিকা। কী লেখা হল?
"Lord Desborough, presiding at a dinner of the Anglo-Saxon club told a story which will have an enduring life. It comes from Miss Mary Pickford who told it to Lady Desborough, “Charlie Chaplin was one day at a fair in the United States, where a principal attraction was a competition as to who could best imitate the Charlie Chaplin walk. The real Charlie Chaplin thought there might be a chance for him so he entered for the performance, minus his celebrated moustache and his boots. He was a frightful failure and came in twentieth."
মানে তৃতীয় নয় চ্যাপলিন ২০ হয়েছিলেন। সেটা মেরি পিকফোর্ড বলেন লেডি ডেসবারোকে। তিনি এক ক্লাবে গল্পটা বলেন। সেখানকার একজন এদের খবর দেন। মানে হিয়ার সের হিয়ার সের হিয়ার সে...নাসিরুদ্দিনের গল্পের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর মতো।
২। এবার দেখুন, ঠিক পরের বছর মার্চ মাসে Albany Advertiser একই খবর কীভাবে প্রকাশ করছে।
"A competition in Charlie Chaplin impersonations was held in California recently. There was something like 40 competitors, and Charlie Chaplin, as a joke, entered the contest under an assumed name. He impersonated his well known film self. But he did not win; he was 27th in the competition."
বাহ... এক বছরের মধ্যে সাত সাতটা ধাপ পিছিয়ে গেল। এখানে আরও মজা, সোর্সের উল্লেখ নেই। মানে সোর্সের মধ্যেই ভূত।
৩। মজা বাড়ল ক' বছর পরে। The Week নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করল,
"Chaplin entered a look-alike contest of himself in France. He probably thought he was a shoo-in for the prize and everyone would have a hearty laugh at the end. But then he came in third. A theory: Chaplin's eyes probably threw off the judges, since those baby blues couldn't be seen in black and white. But Chaplin isn't the only celebrity to have lost a look-alike contest of themselves to an impostor"
মানে শুধু তৃতীয় না, কেন তৃতীয় তার যুক্তিও আছে। বাঃ বাঃ। আর হুড়মুড়িয়ে জনগণ এটাই গিলতে লাগল।
আসুন দেখা যাক, আসলে গবেষকরা কী বলেন? ডেভিড রবিনসন সারা জীবন গবেষণা করেও এমন কোনও প্রতিযোগিতায় চ্যাপলিনের অংশগ্রহণের কথা জানেননি। কেভিন ব্রাউনলো জনে জনে জিজ্ঞেস করেছেন, যারা চ্যাপলিনকে চিনতেন। সবাই, এমনকী উনা চ্যাপলিনও বলেছেন শুনেছি করেছিলেন, কিন্তু আমাকে তিনি বলেননি। বোঝো কাণ্ড। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন,
“This anecdote told by Lord Desborough, whoever he may have been, was quite widely reported in the British press at the time. There are no other references to such a competition in any other press clipping albums that I have seen so I can only assume that this is the source of that rumour, urban myth, whatever it is।”
তবে আজকের এই পর্ব শুধু বিতর্ক দিয়ে শেষ করতে কেমন যেন লাগছে। বরং শেষপাতে পারফেকশনিস্ট চ্যাপলিনের অনবদ্য এক গল্প শোনাই। এটাও ডেভিড রবিনসনের বইতেই পাওয়া।
টকি আসাতে আর যে-ই যত খুশি হোক না কেন, ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন। চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকল তাঁর ওপর। "অনেক হয়েছে, এবার নির্বাক ছবি তৈরি বন্ধ করো, মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দেবে নির্বাক ছবিকে। তারা সবাকের স্বাদ পেয়ে গেছে।" কিন্তু চ্যাপলিন একগুঁয়ে। কিছুতেই তাঁর বিখ্যাত ‘ট্র্যাম্প’ চরিত্রটিকে দিয়ে কথা বলাবেন না তিনি। "যে দিন ও কথা বলে উঠবে, সে দিনই মৃত্যু ঘটবে ওর"- বন্ধু র্যালফ্ বার্টনকে বারবার বলতেন তিনি। আর এই সমস্ত সবাক ছবির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি ঠিক করলেন একটি ছবি বানাবেন। নির্বাক ছবি। সবার সম্মিলিত প্রতিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখক আর্থার জনসনের সঙ্গে মিলে ছয় হপ্তায় ছবির গল্প লিখে ফেললেন চ্যাপলিন। ঠিক করলেন ছবিতে সুরও দেবেন তিনি নিজেই। ছবির নাম ঠিক হলো ‘City Lights’। চ্যাপলিন ছবির সঙ্গে কাজ শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় মারা গেলেন তাঁর প্রিয়তম মানুষটি- তাঁর মা হানা চ্যাপলিন। মানসিকভাবে ভেঙেচুরে যাওয়া চ্যাপলিন প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলেন ছবির কাজ। কাহিনিতেও সামান্য অদলবদল করলেন। নেশাড়ু মানুষটির মধ্যে নিয়ে এলেন তাঁর বাবা চার্লসের আদল আর অন্ধ ফুলওয়ালিকে গড়ে তুললেন সদ্যপ্রয়াত হানার ছায়ায়। কাহিনি একেবারে সরল। অদ্ভুত এক মিষ্টি গল্প। ভবঘুরে চ্যাপলিন শহরে ঘুরতে ঘুরতে এক বিরাট বড়লোককে আত্মহত্যা থেকে বাঁচায়। সে আবার দারুণ নেশাড়ু। নেশার ঘোরে সে চ্যাপলিনকে আপন করে নেয়, কিন্তু পরদিন সকালে নেশা কেটে যেতেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাকে। প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটে। এদিকে চ্যাপলিনের সঙ্গে দেখা হয় এক অন্ধ ফুলওয়ালির। মেয়েটি রাস্তার মোড়ে এক কোণে বসে ফুল বেচে। কোনও কারণে সে চ্যাপলিনকে বড়লোক ঠাওরায়। চ্যাপলিনও সে ভুল ভাঙায় না। সে ঠিক করে, ওই বড়লোকের থেকে টাকা এনে মেয়েটির চোখ ভালো করবে। নেশাড়ু মানুষটি চ্যাপলিনকে টাকা দেয়। চ্যাপলিন সে টাকা মেয়েটির চোখ ভালো করতে দেয়। বড়লোকটি সজ্ঞানে ফিরে এলে চ্যাপলিনকে যথারীতি চিনতে পারে না। চ্যাপলিন জেলে যায়। জেল থেকে ফিরে সে দেখে মেয়েটি এখন দেখতে পায়, তার বড় ফুলের দোকান হয়েছে। কিন্তু সে তো চ্যাপলিনকে দেখেনি আগে, ফলে চিনতে পারে না। শেষে এক মোক্ষম মোচড়ে মেয়েটি বুঝতে পারে, এই সেই মানুষ, যে তাকে নতুন জীবন দিয়েছে।
১৯২৮-এর ডিসেম্বর মাস থেকে এ ছবির কাজ শুরু করেন চ্যাপলিন। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি। প্রায় তিন বছর ধরে চলা এ ছবির শুটিং চ্যাপলিনের জীবনেও এক অনন্য রেকর্ড। এত বেশি দিন ধরে তিনি কোনও ছবির শুটিং করেননি। তবে এ ক্ষেত্রে এত দিন লাগল কেন? তা নিয়েই আমাদের গল্প। শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়, এই তিন বছরের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে চ্যাপলিন ছবির মাত্র একটি দৃশ্যের শুটিং করেছেন- পর্দায় যার আয়ু এক মিনিটেরও কম। ব্যাপারটা খোলসা করেই বলি। ওই যে রাস্তার ধারে বসে থাকা ফুলওয়ালি মেয়েটি চ্যাপলিনকে বড়লোক ভাববে, সেই দৃশ্যটি কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না চ্যাপলিনের নিজের কাছেই। চ্যাপলিন কোনও লিখিত চিত্রনাট্য ব্যবহার করতেন না। শুটিং স্পটে এসে নানা আইডিয়া গিজগিজ করত তাঁর মাথায়। প্রথমে ভাবলেন মেয়েটি চ্যাপলিনকে একটি ফুল কিনতে অনুরোধ করবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলেন, খামোখা তাঁকেই বা কেন? চ্যাপলিনের অদ্ভুত একটা স্বভাব ছিল। যা মাথায় আসত, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলতেন। যদিও জানতেন, শেষ পর্যন্ত ছবিতে তা থাকবে না। ফলে রাশ প্রিন্টের পরিমাণে বেড়ে যেত হু হু করে। অন্ধ মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা ভার্জিনিয়া চেরিল অভিনয় জানতেন না। "এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। আমি আমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিজের মতো করে অভিনয় শেখাই। ফলে আগে থেকে অভিনয় শিখলে তোমাকে আগে সেটা ভুলতে হতো," বলতেন চ্যাপলিন।
আরও পড়ুন- দর্শক মনে প্রাণে চেয়েছিল শাহরুখ মরুক! সাইকোপ্যাথ খুনিই ছিল বাজিগরের ‘হিরো’
যাই হোক, যা বলছিলাম, এই ফুলওয়ালির সঙ্গে চ্যাপলিনের দেখা হওয়ার দৃশ্যটিকে পাখির চোখ করে নিয়েছিলেন তিনি। "এ দৃশ্যটি বিশ্বাসযোগ্য না হলে গোটা সিনেমাটাই ভুল হয়ে যাবে," বারবার বিড়বিড় করে বলতেন তিনি। প্রথমে ঠিক হয়, চ্যাপলিন রাস্তায় যেতে যেতে মেয়েটিকে দেখবেন, তাঁর থেকে ফুল চাইবেন, কিন্তু মেয়েটি অন্য ফুল ওঠাবে। ফলে চ্যাপলিন বুঝবেন মেয়েটি চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু চ্যাপলিনকে মেয়েটি বড়লোক ভাববে কীভাবে? আচ্ছা, এমন যদি হয়, একজন বড়লোক চ্যাপলিনের আগে ফুল কিনলেন... তারপর চ্যাপলিন। ধুস-স্। তাতেও দাঁড়াচ্ছে না গোটা ব্যাপারটা। চ্যাপলিন অস্থির হয়ে উঠলেন। বারবার একই শট নিচ্ছেন আর মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। পারফেকশনিস্ট চ্যাপলিন অন্য কোনও দৃশ্যের কথা ভাবতেই পারছেন না। বিরক্ত চ্যাপলিন সবার সঙ্গে রাগারাগি শুরু করলেন। হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় এল তাঁর। প্রথমে এক বড়লোক মেয়েটির থেকে ফুল কিনবে। তারপর চ্যাপলিন তার শেষ কপর্দকটি দিয়ে একটা ফুল কিনবে মেয়েটির কাছ থেকে- মেয়েটি ভাববে সেই বড়লোকটিই ফিরে এসেছে। কিন্তু শট তোলার পরই বাতিল করে দিলেন চ্যাপলিন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস শুটিং বন্ধ রইল। চ্যাপলিন আইডিয়া পাচ্ছেন না। ভার্জিনিয়া চেরিল এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, "আমরা শুটিং করতে আসতাম। শুটিং হতো না। চ্যাপলিন আসতেন না। ফলে সারাদিন বসে বই পড়া বা উল বোনা ছাড়া অন্য কাজ ছিল না।" অতিরিক্ত চিন্তায় চ্যাপলিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথম ৮২ দিন শিডিউলে মাত্র ২১ দিন শুটিং হয়- তাও চ্যাপলিন বাতিল করে দেন। ১ এপ্রিল, ১৯২৯-এ চ্যাপলিন সুস্থ হয়ে আবার সেই ফুল দেবার দৃশ্যে চলে যান। আবার শুরু হয় সেই দৃশ্যের শুটিং। ৩৪১টি টেক নেওয়া হয় সে দিন। কিন্তু তারপরেও আসল ম্যাজিক, চ্যাপলিনকে বড়লোক ভাবা- অধরাই রইল। বিরক্ত চ্যাপলিন স্থির করলেন, সিনেমাটা আর বানাবেনই না। ৫৩৪ দিন শুটিং শিডিউল পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ১৬৬ দিন। ৩৬৮ দিন গোটা ইউনিট লোকেশনে এসে বসেছিল- চ্যাপলিন আসেননি।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে মাঝরাতে চিৎকার করে উঠে বসলেন চ্যাপলিন- "গাড়ির দরজার আওয়াজ! একমাত্র এইভাবেই মেয়েটি বুঝবে চ্যাপলিন বড়লোক।" অর্থাৎ কিনা রাস্তার কোণায় মেয়েটি বসে। একটি দামি গাড়ি সামনে এসে থামবে। তার দরজা খুলে বেরিয়ে আসবেন এক ধনী ব্যক্তি। তিনি সজোরে দরজা বন্ধ করবেন। মেয়েটি বুঝবে কোনও বড়লোক খরিদ্দার এসেছে। সে তাকে ফুল নিতে বলবে। কিন্তু সামনে পাবে চ্যাপলিনকে। তৎক্ষণাৎ সবাইকে ফোন করে লোক পাঠিয়ে বলা হলো সকাল সকাল শুটিং স্পটে চলে আসতে। আরও বেশ কয়েকশো টেক নিয়ে অবশেষে চ্যাপলিন যখন ‘ওকে’ বললেন, তখন সবাই বিধ্বস্ত- কিন্তু জন্ম হয়েছে বিশ্ব সিনেমার অন্যতম সেরা একটি দৃশ্যের।
ভবঘুরে চ্যাপলিন হেঁটে যাচ্ছে সড়ক বেয়ে। ফুটপাথে উঠতে যাবেন, এমন সময় একগাদা গাড়ি এসে পথ আটকে দাঁড়াল। এরই মধ্যে একটা খালি গাড়ির এপাশের দরজা খুলে অন্য পাশের দরজা দিয়ে বেরোল চ্যাপলিন। জোরে দরজা বন্ধ করল। সামনেই ফুল নিয়ে মেয়েটি। সে চ্যাপলিনকে বড়লোক ভেবে ফুল কিনতে অনুরোধ করে। চ্যাপলিন অন্য একটি ফুল বাছে। হাতের ধাক্কায় ফুলটি মাটিতে পড়ে যায়। চ্যাপলিন নিচু হয়ে তোলে। মেয়েটি তবু মাটি হাতড়াতে থাকে। চ্যাপলিন বোঝে মেয়েটি অন্ধ। হাত ধরে মেয়েটিকে তোলে সে। মেয়েটি চ্যাপলিনের কোটের বাটনহোলে ফুল গুঁজে দেয়। চ্যাপলিন তার হাতে গুঁজে দেন নিজের শেষ কপর্দকটি। এমন সময় সে গাড়ির মালিক গাড়িতে চেপে দরজা বন্ধ করে। গাড়ি চলে যায়। মেয়েটি "স্যার আপনার চেঞ্জটা..." বলে সে দিকে ফেরে। এবার ভবঘুরে চ্যাপলিন বুঝতে পারে মেয়েটি তাঁকে ধনী ঠাউরেছে। সে পা টিপে টিপে স্থান ত্যাগ করে।
হ্যাঁ, এই ছিলেন চ্যাপলিন। পর্দায় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রাণপাত করতেন। হয়তো দর্শকরা ততটা মনোযোগ দেবেন না জেনেও। কারণ তিনিই তো একবার বলেছিলেন, "Comedy is really a serious business", আর সেটা তাঁর মতো ভালো আর কে-ই বা জানত!