দিঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, বাঙালির মনে জায়গা পাকা করছে চটকপুর
কথায় আছে বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। বাঙালি বেড়াতে খুব ভালবাসে। ক্যালেন্ডারে একটু লম্বা ছুটি চোখে পড়ল তো ব্যাস। বেড়ানোর পরিকল্পনা একেবারে তৈরি। বাঙালির আবার এক বদনামও আছে। বেড়াতে যাওয়া মানেই নাকি তাঁরা দিপুদা-র বাইরে ভাবতে পারেনা, মানে দিঘা, পুরী এবং দার্জিলিং। তবে এ কথা হলফ করে বলা যায় যে এই বদনাম বাঙালি ঘুচিয়ে ফেলেছে। এখন দেশে বিদেশে বিভিন্ন বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রে প্রায় সারা বছরই বাঙালি ভিড় করে।
দীপুদার কথা যে বললাম, তাতেও আর আগের মত অত আগ্রহ নেই বাঙালির। বরং নিরিবিলি, শান্ত, ভিড় থেকে দূর, এরম জায়গাই তাদের বেশি পছন্দ। আর সেই তালিকায় গত কয়েক বছরে উত্তরবঙ্গের অনেক গ্রাম জায়গা করে নিয়েছে। জায়গা গুলি যেমন ছবির মত সুন্দর, তেমনই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, নিভৃত, শান্ত
এবং সেখানকার মানুষের আতিথেয়তা পর্যটকদের এখন বার বার টেনে নিয়ে যায় সেই সব সদ্য বিখ্যাত হওয়া গ্রামগুলিতে।
সেই মানচিত্রে নাম করে নিয়েছে দার্জিলিং থেকে মাত্র 26 কিলোমিটার দূরে সিঞ্চল ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারির অন্তর্গত ছোট্ট গ্রাম চটকপুর। উচ্চতা দার্জিলিঙের চেয়েও বেশি, 7887 ফুট। চটকপুর একটি ইকো ভিলেজ, অর্থাৎ এখানে সব কিছু পরিবেশবান্ধব রাখা হয়। সবুজের সমারোহে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দর্শন করা এবং পাহাড়ের সৌন্দর্যকে উপভোগ করার একটি আদর্শ জায়গা এটি। বলা হচ্ছে, টাইগার হিলকেও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দর্শন করার নিরিখে হার মানায় উনিশটি পরিবার নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে বিরাজমান এই ইকো ভিলেজ। হ্যাঁ, অবশ্যই আবহাওয়া একটা বড় ভূমিকা নেয়। সারা বছর অবশ্যই দেখা পাবেন না স্লিপিং বুদ্ধার। তবে যদি দেখতে পান, তাহলে আপনার যাওয়া সার্থক। ওখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে, যেখান থেকে সূর্যদয়, সূর্যাস্ত দেখবেন প্রাণ ভরে।
তবে হ্যাঁ, যদি আকাশের মুখ ভারও থাকে, যদি চারদিক ঢেকে থাকে মেঘে, তাতেও আফশোস করবেননা আপনি। কুয়াশা আর মেঘের চাদরে ঢাকা চটকপুর যেন কোনো এক রূপকথার মায়াবী গ্রাম। ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে আপনি দাঁড়াবেন, আর আপনাকে ঘিরে ফেলবে মেঘের দল, আর দূরে দাঁড়ানো পাইন গাছ থাকবে মেঘের আড়ালে, দেখে মনে হবে যেন শত রহস্যের জাল বুনছে এক দল রূপসী।
তবে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে কিন্তু চটকপুরের ইতিহাস মাত্র এক দশকের। আপার চটকপুরের প্রেম হোমস্টের মালিক প্রেম দর্জি শেরপা জানালেন কী ভাবে একটি পাহাড়ী গ্রাম এমন সুন্দর একটি পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠল।
উনি বলছিলেন, একুশ শতকের শুরুয়াত তখন। দার্জিলিং থেকে এক বন দপ্তরের অফিসার এই গ্রামে আসেন। তখন এখানকার গুটিকয়েক পরিবারের পেশা ছিল শুধু মাত্র কৃষিকাজ। তাছাড়া জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, বনমুরগী ধরে দিন গুজরান হত তাদের। ওই অফিসারই বলেন যে এই গ্রাম পর্যটকদের জন্যে আদর্শ জায়গা হতে পারে। তিনিই গ্রামবাসীদের উপদেশ দেন হোমস্টে খোলার। শুধু তাই নয়, তিনি রাস্তা বানাতেও অনেক সাহায্য করেন বলে জানাচ্ছেন প্রেম। শেষমেশ ২০০৯ সালে ইকো ভিলেজ চটকপুর পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে প্রথম তিন বছর বিশেষ পর্যটকের আনাগোনা ছিলোনা। ২০১২ সালের পর সেই ছবি পাল্টায়। পাল্টায় প্রেমদের কষ্টের জীবন।
তবে সারা বছর তাঁরা ব্যবসা করতে পারেন না। ঘন জঙ্গলের মধ্যে থাকা এই অফবিট রিট্রিট বন্ধ থাকে তিন মাস। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। প্রেম জানাচ্ছেন, বাকি নয় মাসে তার মোটামুটি দুই-তিন লক্ষ টাকার ব্যবসা হয়। সেই ব্যবসায় লাভের মুখ যে খুব একটা দেখেন তাও নয়, কারণ সব কিছুই আনতে হয় সাড়ে সাত কিলোমিটার দূর সোনাদা থেকে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য হোক বা শাক সবজি, সব কিছুর জন্যেই তাঁরা শোনাদার ওপর নির্ভরশীল। এমন কি, চিকিৎসার জন্যেও তাদের শোনাদা যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আছে পানীয় জলের সমস্যাও। পুরোটাই আসে ঝর্ণার জল থেকে। প্রেম জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের আঁচ তাঁরাও পাচ্ছেন। গত এক দু বছর মে জুন মাসেও পানীয় জলের সমস্যায় ভুগেছেন তাঁরা। তবে হ্যাঁ, কোনো সমস্যাই পর্যটক অব্দি পৌঁছাতে দেন না ওরা। তাদের আপ্যায়নে থাকেনা এক ফোঁটা ত্রুটি।
শাসক দল, প্রশাসন, জিটিএ নিয়েও কথা ওঠে, তবে প্রেম খুব একটা আগ্রহ দেখাননা। তার বক্তব্য, তাঁরা রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে, নিজেদের সব কিছু নিজেরাই গুছিয়ে নিচ্ছেন। প্রশাসন খুব একটা সাহায্য করেনা, এবং তাতে তার কোনো বক্তব্যও নেই। এই উনিশটি পরিবার নিজেদের মত গ্রামটিকে গুছিয়ে নিয়েছেন। তবে তাদের দুটো দাবি। জলের সমস্যা মেটানো হোক এবং যতো শীঘ্র সম্ভব ওখানে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র চালু করা হোক।
ভবিষ্যতে হোমস্টের ব্যবসা আরো ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাওয়ায় বললেন, এত সুন্দর একটা জায়গায় তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে খুব শান্তিতে আছেন। তার কাছে এটাই স্বর্গ।
কী ভাবে যাবেন, কোন সময়ে যাবেন এই সব তথ্য পাওয়া কোনো ব্যপার নয়, তাই সেইসবে গেলাম না। তবে গেলে হাতে একটু সময় রাখবেন, ঘুরে দেখবেন পাইনের জঙ্গল, কালিপখরি ও আসে পাশের অঞ্চল গুলো, উপভোগ করবেন গ্রামটির অপূর্ব সৌন্দর্য। শহরের ইঁদুরদৌড় থেকে পালিয়ে তিনটে দিন কাটিয়ে আসুন, কথা দিচ্ছি, সব ক্লান্তি কেটে যাবে।