যৌবন ফেরানোর ওষুধ থেকে সর্দিকাশির যম, আজও বিকল্প নেই চ‍্যবনপ্রাশের

Chawanprash: সকাল সকাল মুখ-হাত ধুয়ে একচামচ চ্যবনপ্রাশ আপনার ইমিউনিটি বাড়াবে দ্বিগুণ।

কলকাতার দোরগোড়ায় শীত কড়া নাড়ছে। মানে 'শীত আসবে আসবে' করছে। আসার রাস্তাও পরিষ্কার বলা চলে। তাই এই আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে চ্যবনপ্রাশ না হলে কি চলে! তাই সকাল সকাল মুখ-হাত ধুয়ে একচামচ চ্যবনপ্রাশ আপনার ইমিউনিটি বাড়াবে দ্বিগুণ।

আর শীতকাল মানেই নানা রোগের পাহাড়। কখনও জ্বর, কখনও ঠান্ডা লাগা- এইসব হরদম লেগেই আছে। কিন্তু এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কী করে? আবহাওয়া তো আর বদলানো যাবে না। তবে নিজেদের শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানো যেতে পারে। তার জন্য দরকার এমন কিছু খাদ্য, যা শরীরকে করে তোলে ভেতর থেকে সতেজ। সেই কারণেই ছোটবেলা থেকে আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ওপর বেশি ভরসা করতেন, আর সেই কারণেই শীত পড়লেই তাদের কাঠের আলমারি থেকে বের হত চ্যবনপ্রাশের কৌটো। চ্যবনপ্রাশ-এ ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা শরীরের জন্য ভালো। এতে সবথেকে বেশি জরুরি যে জিনিসগুলো থাকে, সেগুলি হলো আমলা, ভিটামিন সি এবং গুজবেরি ইত্যাদি। এই চ্যবনপ্রাশ যেমন শরীরের ইমিউনিটি বাড়ায়, তেমনই যে কোনও সংক্রমণের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। তাই আমাদের ছোটবেলায় দিদা-ঠাম্মাদের দাওয়াই ছিল চ্যবনপ্রাশ।

কীভাবে এসেছিল এই চ্যবনপ্রাশ
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চরক সংহিতা-তেও চ্যবনপ্রাশের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ‘চ্যবনপ্রাশ’ নামের দুটো ভাগ, একটা ‘চ্যবন’ আর একটা ‘প্রাশ’। ‘চ্যবন’ শব্দের অর্থ ‘অপতনশীল পরিবর্তন’। আবার ‘চ্যবন’ কিন্তু এক প্রাচীন ঋষিরও নাম। বলা হয়, সেই ঋষির নাম থেকেই ‘চ্যবনপ্রাশের’ উৎপত্তি। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণেও এই ঋষি চ্যবনের উল্লেখ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: শুধু ঝোল কিংবা অমলেট নয়, মিষ্টিতেও বিকল্প নেই ডিমের

কিংবদন্তি অনুসারে, একদিন রাজা শরিয়তি তাঁর কন্যা সুকন্যাকে নিয়ে বনভোজনে বেরিয়েছিলেন। শিকার করতে করতে তারা ঋষি চ্যবনের আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। এরই মধ্যে রাজকুমারী সুকন্যা দু'জোড়া জ্বলন্ত আলো দেখে সেই আলো অনুসরণ করে ঋষির সামনে উপস্থিত হন, কিন্তু সুকন্যা তখনও জানতেন না যে, দু'জোড়া আলো আসলে ঋষি চ্যবনের চোখ, যিনি দীর্ঘ তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। এরপর সেই আলো লক্ষ্য করে সুকন্যা একটি লাঠি দিয়ে আঘাত করলে ঋষি চ্যবনের তপস্যা ভঙ্গ হয় এবং তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে সেখানে রাজা স্বয়ং পৌঁছে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঋষি চ্যবনের কাছে তাঁর কন্যার বোকামির জন্য বারবার ক্ষমা চান। ঋষি তাঁদের ক্ষমা করে দেন, কিন্তু নিজের বোকামির জন্য সুকন্যা স্বয়ং ঋষি চ্যবনের স্ত্রী হওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন এবং চ্যবন তাঁকে সাগ্রহে গ্রহণ করেন।

এরপর ভালোই চলছিল, কিন্তু ঋষি চ্যবনের মনের মধ্যে উপস্থিত হল ভয়। তিনি বৃদ্ধ, রুগ্ন, ভালো দেখতে না, অন্যদিকে রাজকুমারী সুকন্যা যৌবনা! তাই নিজেকে সুপুরুষ করার জন্য তিনি মহাবৈদ্য অশ্বিনী কুমারের কাছে গেলেন। এবং তাঁর নিজস্ব সমস্যা তাঁদের জানালেন। তাঁরা ঋষি চ্যবনের যৌবন ফিরিয়ে আনার জন্য এমন একটি আয়ুর্বেদিক ঔষধি তৈরি করলেন, যা খেয়ে ঋষি তাঁর যৌবন-অবস্থায় ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীর সামনে উপস্থিত হলেন।

অন্যদিকে রাজকুমারী সুকন্যার ঋষি চ্যবনের প্রতি ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে অশ্বিনী কুমারেরা তাঁকে বর দিতে চাইলেন। সুকন্যা বর হিসেবে তাঁর স্বামীর যৌবন ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত ঔষধির প্রণালী জানতে চাইলেন। অশ্বিনী কুমাররা তাঁর ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন। আর সেই থেকে ঋষি চ্যবনের নামেই প্রচলিত হয়ে আসছে এই ‘চ্যবনপ্রাশ’।

চ্যবনপ্রাশের উপকরণ কী ও কেন খাবেন
সনাতন ভারতে বহুচর্চিত আয়ুর্বেদশাস্ত্র একালেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রাচীন উপাদান ও অনুপাত মেনে তৈরি করলে চ্যবনপ্রাশ শরীরের জন্য নাকি রক্ষাকবচ তৈরি করতে পারে। আমলকি, লবঙ্গ, শতাবরী, বিদরিকাণ্ড, হরতকি, কন্টকরি, কাকদাশিঙ্গি, ভূম্যআমলকি, বাসক, পুষ্করমূল, শালপর্ণীর মতো একাধিক উপকারী ভেষজের সাহায্যে তৈরি আয়ুর্বেদিক এই মিশ্রণ শুধু সর্দি-কাশি-জ্বরই নয়, বদহজম, পিত্তদোষ, প্রস্রাবের প্রদাহ ইত্যাদি নানা ব্যাধি দূর করতে সক্ষম। ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, এই আয়ুর্বেদিক ওষুধ খাওয়ার অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। আমলা থেকে তৈরি চ্যবনপ্রাশ প্রাচীনকাল থেকেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও দীর্ঘায়ু বাড়াতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চ্যবনপ্রাশের বার্ধক্য-প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।

চ্যবনপ্রাশ-এর উপকারিতা
সাধারণত শীতের শুরুতে শুষ্ক আবহাওয়ায় বা ঋতু পরিবর্তনের সময়ে পরিবেশে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বাড়বাড়ন্তের ফলে শিশু থেকে বয়স্ক, সকলেই সর্দি, কাশি এবং ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত হয়ে যায়। তাই এইসব রোগের হাত থেকে বাঁচতে ওষুধের মতো কাজ করে চ্যবনপ্রাশ।

শুধু তাই নয়, চ্যবনপ্রাশ পাকস্থলীর অ্যাসিডগুলির যথাযথ জারণ ঘটায়। আমলকি হজম ক্ষমতা বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্যর হাত থেকে মুক্তি দেয়।

ক্রনিক শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, যেমন হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদির সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা অবশ্যই চ্যবনপ্রাশ খান। এর মধ্যে থাকা নানা ভেষজ বনৌষধি ফুসফুসজনিত যে কোনও সমস্যাকে দূর করতে সাহায্য করে।

অনেকেই জানেন না, চ্যবনপ্রাশের আর একটি অসাধারণ গুণ হলো এটি অ্যান্টি এজিং ফর্মুলাসমৃদ্ধ। তার মানে চ্যবনপ্রাশ খেলে শীতে আপনার জেল্লা দেখে কে! ভরপুর ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি রক্তে হিমোগ্লোবিন-এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আপনার ত্বকে শীতের রুক্ষ টান যেমন দেখা যাবে না, তেমনই ত্বক হবে উজ্জ্বল ও ঝলমলে।

এটি হার্টের যত্ন নেয়, এর মধ্যে থাকা অর্জুন হৃদপিণ্ডের খেয়াল রাখে, সঙ্গে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি রক্ত পরিশ্রুত করতেও এর অবদান অনবদ্য। বর্তমান ব্যস্ত জীবনে জাঙ্কফুড খাওয়ার জন্য বা সঠিকভাবে শরীরচর্চা না করার ফলে শরীরে নানারকম টক্সিন জমতে শুরু করে। চ্যবনপ্রাশ সেই টক্সিনকে বের করে দিয়ে রক্তকে বিশুদ্ধ করে তোলে।

আজকালকার কর্মব্যস্ত জীবনে কমবেশি সকলেই যে সমস্যায় ভুগছে, তা হলো স্ট্রেস। অফিসে ডেডলাইন থেকে শুরু করে বাড়ির অশান্তিতে নাজেহাল? চ্যবনপ্রাশ-এর গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উপাদান আপনার স্নায়ুকে করে তুলবে সক্রিয় এবং মানসিক চাপের সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করবে।

চ্যবনপ্রাশ খাওয়ার সঠিক উপায়
চ্যবনপ্রাশ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তবে অনেকে অতিরিক্ত মাত্রায় তা খেয়ে ফেলেন। অত্যধিক কোনওকিছুই ভালো নয়, তাই বেশিমাত্রায় চ্যবনপ্রাশ খেলে বদহজম, পেট ফাঁপা, পেট ফুলে যাওয়া এবং পেটের প্রসারণ হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্করা ১ চা-চামচ দিনে দু'বার সকালে এবং সন্ধ্যায় হালকা গরম দুধ বা জলের সঙ্গে খেতে পারেন। শিশুদের জন্য, প্রতিদিন হাফ চা-চামচ চ্যবনপ্রাশ যথেষ্ট।

তবে যাঁরা হাঁপানি বা শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত, তাঁদের দুধ বা দইয়ের সঙ্গে চ্যবনপ্রাশ খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। অনেক সময় চ্যবনপ্রাশকে মিষ্টি এবং টক স্বাদ দেওয়ার জন্য চ্যবনপ্রাশ তৈরিতে গুড়, চিনি বা মধুর মতো মিষ্টি ব্যবহার করা হয়। একজন ডায়াবেটিস রোগীর এটি খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বা তাঁদের খাদ্যতালিকায় চ্যবনপ্রাশ অন্তর্ভুক্ত করার আগে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা আবশ্যক। তবে আজকের দিনে সুগার-ফ্রি চ্যবনপ্রাশও পাওয়া যায়।

তাই সবশেষে বলাই চলে, ‘ইস্ট অর ওয়েস্ট চ্যবনপ্রাশ ইজ দ্য বেস্ট’।

More Articles