নববর্ষে মিড ডে মিলে ফ্রায়েড রাইস-চিকেন! বছরের অন্যদিন ধুঁকতে থাকা শিশুদের কী জোটে আসলে?

Poila Boishakh Mid day Meal: সারা বছর সবজি তো দূর অস্ত, খিচুড়িতে সামান্য আলুও থাকে না। পোস্ত নয়, সয়াবিনও নয়, আলুর ঝোল দিয়ে খেতে বসিয়ে দেওয়া হয় বাচ্চাদের।

একদিন কম্বল বিতরণ, একদিন অকাল বিরিয়ানি, একদিন ক্রিসমাস কেকগুচ্ছ। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এস্মস্ত কাজ করেই থাকে। পরের দিন ওই কম্বলের, ওই বিরিয়ানি খাওয়া মানুষটির, ওই কেক পাওয়া শিশুটির কী খাওয়া জুটল, কী আশ্রয় জুটল তার খোঁজ রাখে না কেউই। সারা বছর কোনওমতে ভাত ডাল খেয়ে বাঁচা মানুষকে একদিনের উৎসব দেওয়ার মধ্যে দায়িত্ব পালন নেই, আছে কেবল সেবার আড়ালে স্বার্থসিদ্ধিই। এই প্রশ্ন নতুন করে উঠছে তৃণমূল সরকারের এক সিদ্ধান্তে। পয়লা বৈশাখে মিড ডে মিলে, স্কুলের শিশুদের 'ভালোমন্দ' খাওয়ানোর নির্দেশিকা দিয়েছিল শিক্ষা দফতর। সোমবার প্রধান শিক্ষকদের স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের মিড-ডে-মিলে পোলাও, ডিমের কারি বা চিকেন কষার মতো ভালো মেনু করার নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকার।

রবিবার ছিল পয়লা বৈশাখ। রবিবার স্কুল ছুটি, তাই নতুন বাংলাবর্ষের প্রথম কর্ম দিবসেই রাজ্যের সমস্ত স্কুলে মিড ডে মিলে পড়ুয়াদের স্পেশাল মেনু খাওয়ানোর নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছিল জেলা আধিকারিকদের দফতর থেকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই যা নির্দেশিকা আসে তার সবটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন হয় না। জেলা অনুযায়ী, স্কুল অনুযায়ী মেনু বদলেছে। সরকার বলছে, বাঙালির বড় উৎসব নববর্ষের পয়লা দিন সকলেই বাড়িতে ভালো খান, নতুন পোশাক পরেন। তাই স্কুলের পড়ুয়াদেরও সরকারের তরফে ভালো খাওয়ানো হবে।

আরও পড়ুন- অপুষ্টিতে ভুগে মরছে লাখো লাখো শিশু, এই ভারত চেয়েছিলেন নেতাজি?

খাওয়ানো তো হবেই! শিয়রে লোকসভা ভোটও। বাকি সারাটা বছর সরকারি স্কুলগুলিতে মিডি-ডে-মিলে যাই জুটুক না কেন, সারাবছর যতই মিড-ডে-মিলের চাল-ডিম চুরি যাক না কেন একদিনের 'চ্যারিটি' দিয়ে ভোটের আগে সরকারের জনকল্যাণকে প্রচারের সুযোগ কোন শাসকই বা ছাড়ে। মূল শহরের স্কুলগুলির কথা যদি বাদও থাকে, প্রান্তিক অঞ্চলের স্কুলগুলিতে মিড-ডে-মিলে কী দেওয়া হয়? তার আগে জানা যাক, মিড-ডে-মিলে বাচ্চা প্রতি বরাদ্দ কত টাকা?

মিড ডে মিল প্রকল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে চালায়। খরচের কেন্দ্র রাজ্য অনুপাত হচ্ছে ৬০ঃ৪০। মিড-ডে মিলে প্রাথমিকে পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ হচ্ছে ৫ তাকা ৪৫ পয়সা। এই টাকার মধ্যে কেন্দ্র দেয় ৩ টাকা ২৭ পয়সা আর রাজ্য দেয় বাকি ২ টাকা ১৮ পয়সা। উচ্চপ্রাথমিকের ক্ষেত্রে এই মোট বরাদ্দ ৮ টাকা ১৭ পয়সা। এই বাজারে কোন সবজি, কোন ডাল, কোন ডিম এই টাকায় হয়? এই হিসেব শুনে শিশুও গড়াগড়ি দেবে।

কোনও প্রাথমিক স্কুলে ১০০ জন পড়ুয়া থাকলে রোজ মিড-ডে মিল খাওয়াতে কম করে ৮০০ গ্রাম ডাল লাগে। দাম ১০০ টাকার বেশি। আনাজপাতি পেজ ৪ কিলো। ঋতুভেদে যার খরচ কম করে ১৫০ টাকা। ৫-৬ কেজি আলু কিনতেই ১২০ টাকার বেশি লাগে। এর উপর তেল-মশলা-হলুদ-নুন, আদা-রসুনে খরচ প্রায় ১০০ টাকা। গ্যাসও খরচ হয় ১৫০-১৬০ টাকার। সরকার থেকে রন্ধনকর্মীর খরচ মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা দেওয়া হয়। সব মিলে প্রতিদিন খরচ হয় প্রায় ৬০০ টাকা।
সরকার বলেছে নববর্ষ উপলক্ষ্যে কলকাতা জেলার ক্ষেত্রে স্পেশাল মেনুতে থাকবে ফ্রায়েড রাইস, ডিমের কারি, আলুর দম, সঙ্গে রসগোল্লা। বাকি জেলাগুলির ক্ষেত্রে ডিমের কারি বা চিকেন। এই স্পেশ্যাল মেনুর খরচ জোগাবে কে? সারা রাজ্যে এক কোটিরও বেশি পড়ুয়া আছে প্রাথমিকে। আধিকারিকরা বলছেন অতিরিক্ত যে খরচ হবে তা ‘মিসলেনিয়াস ম্যানেজমেন্ট ইভোলিউশন কস্ট’-এ স্কুলগুলিকে দিয়ে দেওয়া হবে। বাস্তব বলছে, এখনও এমন বহু স্কুল রয়েছে যেখানে শিক্ষকরা নিজেদের বেতন থেকে টাকা দিয়ে পড়ুয়াদের একদিন একটু ভালো খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সরকারের একদিনের এই এলাহি খাওনদাওনের পর বছরের বাকিদিন শিশুরা প্রকৃত পুষ্টি পাচ্ছে কিনা তা কে দেখবে খতিয়ে?

আরও পড়ুন- মিডডে মিলে মাংস বাদ, শিশুর পাতে নেই দুধটুকুও! কোন পথে আসছে দেশে ‘অচ্ছে দিন’?

সরকারের নির্দেশিকা আছে, সপ্তাহের প্রথম দিন মিড-ডে-মিলে সবজি দেওয়া খিচুড়ি ও চাটনি খাওয়ানো হবে। এছাড়াও ভাত, মুসুর ডাল, সোয়াবিন ও আলুর তরকারিও থাকবে। দ্বিতীয় দিনে ভাত, মুসুর ডাল ও মরশুমি সবজি। তৃতীয় দিনে ভাত, ডিম ও আলুর কারি। চতুর্থ দিনে ভাত, মুসুর ডাল, পোস্ত। পঞ্চম দিনে ভাত, মুসুর ডাল, সোয়াবিন আলুর তরকারি এবং ষষ্ঠ দিনে ভাত, মুসুর ডাল, ডিম সেদ্ধ। এছাড়া, স্পেশ্যাল মেনু হিসেবে বিভিন্ন স্কুল নিজেদের উদ্যোগে মাসে অন্তত একদিন মাছ ও মাংস খাওয়াবে বাচ্চাদের।

৫ টাকা ৪৫ পয়সায় পোস্ত, মুসুর ডাল! রাজ্যের গ্রাম তথা প্রান্তিক এলাকার স্কুলগুলিতে গেলে মিড-ডে-মিলের প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট হয়ে যাবে। সবজি তো দূর অস্ত, খিচুড়িতে সামান্য আলুও থাকে না। পোস্ত নয়, সয়াবিনও নয়, আলুর ঝোল দিয়ে খেতে বসিয়ে দেওয়া হয় বাচ্চাদের। মুসুর ডালে ডাল নয়, হলুদ গোলা জল থাকে। তাতে একজন বাড়ন্ত শিশু কী পুষ্টি পায় এই আলোচনা গ্লানি বাড়াবে আরও। সরকার একদিন পোলাও-চিকেন খাইয়ে ভোট পেতে পারে ঠিকই, তবে 'চ্যারিটি'-র নামে আসলে কোটি কোটি শিশুকে ঠকানো তাতে বন্ধ হয়ে যায় না।

More Articles