পৃথিবীজুড়ে হু হু করে বাড়ছে শিশু নির্যাতন! যে বাস্তব জানলে শিউরে উঠতেই হবে
Child Abuse: নিউক্লিয়ার পরিবারের শিশুরাই তুলনায় বেশি নির্যাতনের শিকার, বলছে সমীক্ষা।
পৃথিবীজুড়ে শিশুরা নানা ধরনের নিৰ্যাতনের শিকার। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটি। এর ভেতর নাবালক-নাবালিকার সংখ্যা ১০০ কোটি, যাদের বয়স ২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেই নির্যাতনের শিকার। শিশু নির্যাতন ঠেকাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শিশু নিগ্রহ বন্ধ করতেই হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীজুড়ে শিশু নির্যাতন বন্ধে প্রয়াসী। তবে এই উদ্যোগ কার্যত কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা এখন সময়ের অপেক্ষা।
শৈশব-কৈশোরে যারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তারা বাকি জীবনটা নানা সমস্যার শিকার হয়। বেড়ে ওঠার বয়সে নির্যাতনের শিকার হওয়ার জন্য ভবিষ্যতে তাদের অনেকেই সুস্থ নাগরিক হিসেবে জীবন কাটাতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা লেগেই থাকে। শিশুরা নির্যাতনের ফলে কী ধরনের সমস্যার শিকার, সে-সম্পর্কে গবেষণাও কম হয়নি। স্বেচ্ছাসেবীদের গবেষণায় দেখা দিয়েছে, শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে পরিচিত জনের হাতে। এজন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে দায়ী অভিভাবকরাও।
অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা আবার নির্যাতনের শিকার হচ্ছে স্কুলে। শারীরিক, মানসিক পীড়ন অথবা যৌন নিপীড়নের ঘটনা লেগেই রয়েছে। আর নাবালকদের তুলনায় নাবালিকারাই বেশি সংখ্যায় যৌন নির্যাতনের শিকার। এদের অনেকে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার নির্যাতনের শিকার হয়ে শিশুদের একাংশ আত্মঘাতীও হচ্ছে। এছাড়া নির্যাতিত শিশুরা যে সমস্যাগুলিতে আক্রান্ত, এর মধ্যে রয়েছে ঘুম ঠিকমতো না হওয়া, সামান্য কারণে রেগে ওঠা, উদ্বেগজনিত সমস্যা কিংবা কোনও কাজে একাগ্র হতে না পারা। যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে নাবালিকারা অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়ছে বলেও স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: যৌন হেনস্থা রুখতে কড়া আইন, আদৌ ভারতকে শিশুর বাসযোগ্য করতে পারল পকসো?
সমীক্ষা চালিয়ে এও দেখা গিয়েছে, অভিভাবকদের সঙ্গে যে শিশুদের মানসিক সম্পর্ক মজবুত নয়, তারা শৈশব-কৈশোরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে লেখাপড়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিউক্লিয়ার পরিবারের শিশুরাই তুলনায় বেশি নির্যাতনের শিকার। আর যে শিশুরা অহরহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তারা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সদস্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, শিশু নির্যাতন রোধ করা সম্ভব। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এই কর্মসূচির নামকরণ করা হয়েছে 'ইনস্পায়ার'। সাত দফা এই কর্মসূচির অন্তর্গত শিশুকে নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার মতো সুযোগ দেওয়া, স্কুলের লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুকে জীবনশিক্ষা দেওয়া, অভিভাবকরা যাতে শিশুদের বেড়ে ওঠা সম্পর্ক যত্নশীল হন, এধরনের বিষয়গুলি 'ইনস্পায়ার'-এর অন্তর্গত। শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলিতে আরও দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে শিশু কিংবা কিশোর-কিশোরীরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনুন্নত দেশগুলির বাসিন্দা শিশুরা বেশি মাত্রায় নির্যাতনের শিকার। এক্ষেত্রে সাধারণ পরিবারের তুলনায় উদ্বাস্তু পরিবারের শিশুরাই বেশি মাত্রায় আক্রান্ত।
শিশু নির্যাতনের হার পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে তুলনায় কম হলেও সমস্যাটা কিন্তু সর্বত্রই রয়েছে। এ-ব্যাপারে 'জার্নাল অফ রিহ্যাবিলিটেশন অফ টর্চার ভিকটিমস অ্যান্ড প্রিভেনশন অব টর্চার' শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সামাজিক সমস্যা শিশু নির্যাতন। এছাড়া শিশু নির্যাতন ইউরোপজুড়েও গুরুত্বপূর্ণ এক সামাজিক সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলিতে অভিবাসী পরিবারের শিশুরা বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও শিশু নির্যাতনের ধরনটা পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলিতে চলা শিশু নির্যাতনের মতোই। নাবালিকারা তুলনায় বেশি অত্যাচারিত। আর বেশিমাত্রায় আক্রান্ত উদ্বাস্ত পরিবারের শিশুরা।
উদাহরণ হিসেবে ব্রিটেনের কথাই ধরা যাক। ব্রিটেনে বেশিরভাগ সময়ে উদ্বাস্তু পরিবারের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের জন্য রক্ষাকবচ নেই। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উদ্বাস্তু হওয়ার আগে স্বদেশেও এই শিশুদের মধ্যে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে। 'ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ পলিসি সায়েন্সেস অ্যান্ড ল'-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ভারতে শিশু নির্যাতন সম্পর্কে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি করেছেন স্নেহা রায় এবং ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী মাডিকি। গবেষকরা বলেছেন, শৈশব-কৈশোরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করছে যে কোনও শিশুর ভবিষ্যতের জীবন। স্নেহ, ভালবাসা থেকে বঞ্চিত শৈশব ভবিষ্যতের পক্ষে অশুভ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতে, ১৮ বছরের কম বয়সের যে কোনও মানুষের জন্যেই শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ রয়েছে।
ভারতে শিশুরা লাগাতারভাবে নির্যাতনের শিকার। মানসিক নির্যাতন তো রয়েইছে, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শিশু নির্যাতন রোধে চাইল্ড লাইনের হেল্পলাইন নম্বরে লাগাতার অভিযোগ জমা পড়ছে। আড়াই ঘণ্টা অন্তর ১৬ বছরের কমবয়সি নাবালিকারা ধর্ষিত হচ্ছে। এছাড়া প্রতি ১৩ ঘণ্টা অন্তর ১০ বছরের কম বয়সের নাবালিকা ধর্ষিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ভারতে শিশু নির্যাতনের ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়ছে। দৈনিক শতাধিক শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ২০২০ করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পরে শিশুদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়েছে।ভারতে অভিভাবকদের অনেকেরই জানা নেই, শিশুকে কোন পদ্ধতিতে বড় করে তুলতে হবে। শাসনের নামে শিশুদের বেধড়ক পিটুনি দেওয়ার কাজটা অভিভাবকরা কর্তব্য বলেই মনে করেন। যদিও এতে শিশুরা মানসিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া অভিভাবকদের অনভিপ্রেত কড়া শাসনের শিকার শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হতাশা, উদ্বেগ ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে হীনম্মন্যতায় ভুগছে অথবা আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করছে।
স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, নির্যাতনের শিকার ৭৫ শতাংশ শিশুই লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে। ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশু যারা যৌন নির্যাতনের শিকার ঘনঘন স্কুল কামাই করছে ওরা। প্রতি ১০জনের মধ্যে একজন নির্যাতিত শিশু মানসিক অত্যাচারের জেরে ধূমপান করছে অথবা মাদকাসক্ত। শিশুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে পরিবারের কোনও সদস্যের হাতে। অথবা পরিবারের ঘনিষ্ঠ কোনও ব্যক্তিই নির্যাতনের জন্যে দায়ী। গবেষকরা জানিয়েছেন, একান্নবর্তী পরিবার ভাঙার পরে শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ভারতীয় সমাজে বেড়েই চলেছে।
ভারতীয় সমাজে শিশুদের যৌন শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি বরাবরই অবহেলিত। যৌন শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু থাকলে শিশু নির্যাতন অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে শিশুরা নিজেদের শরীর সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারত। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ভারতে একাধিক আইনও রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৩, ৩২৩-৩২৫, ৩৫৪, ৩৭৫, ৫০৬ ধারায় শিশু নির্যাতন পুরোপুরিভাবে বেআইনি। এছাড়া রয়েছে পকসো আইন। সমস্যার সমাধান হচ্ছে না তাতেও।