ম্যাল নিউট্রিশন : সারা বিশ্বের ক্ষুধার্ত শিশু এবং তাদের ভবিষ্যত

আপনি কি নিজের ওজন নিয়ে চিন্তিত? খাওয়া দাওয়ায় আকছার পরিবর্তন আনেন? আপনি জানেন ভারতের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ নিজের প্রয়োজনীয় প্রতিদিনের খাবারের যোগান দিতে পারেন না ? চলুন জেনে নি সারা ভারতের এবং বিশ্বের ম্যাল নিউট্রিশন বা অপুষ্টির কিছু তথ্য এবং সাথে সাথেই আমাদের ওজন এবং শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে ঠিক কী কী বিষয় আমাদের মাথায় রাখা আবশ্যিক।

সারা পৃথিবী ব্যাপী গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স নামের একটি পরিসংখ্যান চালু করা হয় আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে, ২০০৬ এ। যেখানে প্রথমদিকে যোগদান করা দেশের সংখ্যা কম হলেও আস্তে আস্তে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে একশো।

২০১৪র পরিসংখ্যানটি খতিয়ে দেখলে জানা যায় সারা পৃথিবীর ২০০র ও বেশি দেশগুলির মধ্যে থেকে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স এ অংশগ্রহণ করেছিল ৭৬ টি দেশ, যার মধ্যে থেকে ভারতের স্থান ছিল ৫৫। এটি পুরোনো বছরের রেকর্ডের তুলনায় কিছুটা ভালো।

এবার আসা যাক বর্তমান পরিস্থিতিতে, ২০২০ সালে প্রকাশিত এই পরিসংখ্যানে ভারতের স্থান ৯৪, অংশগ্রহণ করা দেশের সংখ্যা ১০৭। আরও ২৫ টি দেশ বাতিল হয়েছে তাদের সমস্ত রকম তথ্য প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে জমা করতে না পারার কারণে।

এই পরিসংখ্যান টি মূলত বের করা হয় চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।

১) undernourished অর্থাৎ যে সমস্ত মানুষ নিজের প্রয়োজনীয় খাবার পান না।

২) wasting অর্থাৎ যে সমস্ত পাঁচ বছর বা তারচেয়ে কম বয়সের শিশুর ওজন তাদের বয়সের তুলনায় কম।

৩) stunting অর্থাৎ যে সমস্ত পাঁচ বছর বা তারচেয়ে কম বয়সের শিশুর উচ্চতা তাদের বয়সের তুলনায় কম।

৪) mortality অর্থাৎ পাঁচ বছর বা তারচেয়ে কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার।

এই চারটি আলাদা বিষয়ে প্রতিটি দেশ নিজেদের জমা করার ভিত্তিতে নম্বর পায়। এক থেকে একশোর মধ্যে এই পরীক্ষায় যে দেশের নম্বর যত কম তার পরিস্থিতি ততটাই ভালো।

নম্বরের আবার শ্রেণী বিভাগ রয়েছে, যে দেশ ৯.৯ এর নিচে স্কোর করেছে তাদের অবস্থা ভালো, এখানে ছোটো ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় খাবার পায় এবং অনাহারে মৃত্যুর হার কম।

এরপরের স্তরে আসে সেই সমস্ত দেশ যাদের স্কোর ১০ থেকে ১৯.৯ এর মধ্যে। এদের পরিস্থিতি চিন্তার। তারপর ২০ থেকে ৩৪.৯ এর মধ্যে থাকা দেশ গুলি, যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

৩৫ থেকে ৪৯.৯ থাকা দেশ গুলির অবস্থা ভয়ঙ্কর, এখানে ওই চারটি প্যারামিটারে অনুযায়ী ছোটো শিশুদের ওজন, উচ্চতা , মৃত্যুর হার এবং সারাদেশ ব্যাপী অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেকটাই বেশি।

এরপরের ধাপে আসে ৫০ বা তার বেশি পাওয়া দেশগুলো, যাদের অবস্থা কল্পনার বাইরে। এবং সৌভাগ্যবশত ২০২০র গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স এর রিপোর্টে এই তালিকায় থাকা ১০৭ টি দেশের কোনোটিই জায়গা পায়নি।

এই পরিসংখ্যানে ভারত পেয়েছে ২৭.২ শতাংশ নম্বর যার ফলে এই ১০৭ টি দেশের তালিকায় আমাদের স্থান ৯৪। আমাদের পেছনে ফেলে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করেছে আমাদেরই কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ, যেমন বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল এবং মায়ানমার। উল্লেখ্য, এই প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে কয়েকটির আবার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের চেয়ে অনেকটাই খারাপ।

ভারতের আইসিএমআর অর্থাৎ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ্ মেডিক্যাল রিসার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী একজন স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন অন্তত ৪৮ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন, একই ভাবে WHO অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের বক্তব্য অনুযায়ী একজন মানুষের তার প্রতি কেজি ওজন পিছু ০.৮ থেকে ১ গ্রাম অবধি প্রোটিন খাওয়া উচিত। তারমানে একজন ষাট বছরের মানুষের ৫০ গ্রামের একটু বেশি প্রোটিন, প্রতিদিন।

কিন্তু একটি ভারতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় প্রোটিন খেতে পান না, আরও অবাক করার বিষয় যে ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষ এটা জানেনই না যে তাদের প্রতিদিন প্রোটিন খাওয়া প্রয়োজন। এমনকি ৮৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে প্রোটিন খেলে ওজন বেড়ে যায়, যে ধারণাটি সম্পূর্নরূপে ভুল।

ভারতে প্রতিদিন খাওয়া প্রোটিনের মাত্রা কম হওয়ার পেছনে আরও একটি বিষয় ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ন। এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় কারণে আলাদা আলাদা সাপ্তাহিক দিনে নিরামিষ খাওয়ার চল রয়েছে, এছাড়া আরও একটি সরকারি তথ্য অনুযায়ী ভারতের প্রায় ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ নিরামিষ খেয়ে থাকেন।

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে নিরামিষ খাবারে প্রোটিন কি নেই? অবশ্যই আছে, ডাল, সোয়াবিন বা বাদামে প্রোটিন থাকে, কিন্তু সেই মাত্রা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের তুলনায় অনেকটাই কম।

ফলস্বরূপ ভারতের ৩০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মানুষদের প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ মাংসপেশীর সমস্যায় বা দেহে পর্যাপ্ত শক্তির অভাবে ভোগেন। ঠিক সেই বয়সের মানুষরা যাদের কর্মক্ষমতার ওপর তার পরিবার, তার উন্নতির ওপর সম্পূর্ন দেশ নির্ভর করে।

আপনি জানলে হয়তো অবাক হবেন ঠিক ম্যাল নিউট্রিশন এর কারণেই ভারতের জিডিপি ৪ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং ভারতীয় ছেলেমেয়েদের কর্মক্ষমতা প্রায় ৮ শতাংশ কমে এসেছে।

আবার একই ভাবে ভারতের প্রায় ১৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে অবিসিটি এবং অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভোগে, যার কারণ পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় খাবার না খাওয়া। আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য দ্রব্য ধান, গম বা বাজরা  এবং এই খাবারগুলি তে প্রোটিনের পরিবর্তে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি, যে কারণে এই বিষয়টি ভারতে নজরে পড়ার মতো।

আপনি যদি নিতান্তই আপনার ওজন নিয়ে চিন্তিত থাকেন অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিন, নিজে থেকে নেওয়া যে কোনও সিদ্ধান্ত আপনাকে অনেক বড় বিপদে ফেলে দিতে পারে।

আর রইলো পড়ে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স এর ফলাফল? GHI ২০৩০ অবধি পৃথিবীকে ওই চারটি সমস্যা থেকে সম্পূর্নরূপে মুক্ত করতে চায়। অর্থাৎ অংশগ্রহণ করা সমস্ত দেশের স্কোর করতে হবে শূন্য। চিন্তার মতো স্কোর এই মুহূর্তে আফ্রিকা মহাদেশের সিংহভাগ এবং দক্ষিণ এশিয়া।

বলে রাখা ভালো, ভারত বিগত কয়েক বছরে পাঁচ বছর বা তারচেয়ে কম বয়সের ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর হার কিছুটা কমিয়ে এনেছে। আগামীতে এই উদ্যোগ কে আরও সফল করতে পোষণ অভিযান, আইসিডিএস, মিড ডে মিল, বালওয়াড়ি অভিযান এর মতো বেশ কিছু প্রকল্প।

আমরা চাইবো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের দেশ তথা সারাবিশ্ব এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে বেরিয়ে আসুক।

More Articles