কেষ্টনগর খ্রিস্টমন্দির: পুতুলখেলার স্মৃতি
Christo Mandir: অনেকেই এ-কথা জানেন, পর্যটন দপ্তর ঘোষিত, রাজ্যের প্রাচীন সাতটি গির্জার মধ্যে কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্রাল চার্চ অন্যতম। ‘প্রাচীন’ শব্দটিকে সামনে রেখে এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য এ-চার্চের প্রতিষ্ঠাবৃত্তান্তটি।
দাদু পরতেন সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় মেঘের মতো শুভ্র কেশ। পঁচাত্তর বছর বয়সি আমার দাদু বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন রোজ। দাদুর আঙুল ধরে, ওঁর সঙ্গে-সঙ্গে যেতাম আমিও, সেই ছোটবেলায়। রাস্তায় যখন পরিচিত কেউ জিজ্ঞেস করত, ‘রামবাবু, কোথায় চললেন?’─ ‘এই, একটু নাতিকে চার্চ ঘুরিয়ে আনি!’
চার্চে পৌঁছে, আমি কী দেখতাম? বড়ো লোহার গেট পার করে, গির্জার সামনে মাঠ। মাঠের শেষে, কয়েকটি সিঁড়ি। তারপরই, চার্চে ঢোকার দরজা। ঢোকামাত্রই, কেমন যেন পালটে যেত আমার চারপাশের পরিচিত জগৎচিত্রগুলি। বলা ভাল, এখনও যায়।
প্রধানত, চারটি স্তম্ভের ওপর চার্চের সামনের অংশটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইউরোপীয় নকশাকাজ, এখনও ধরে রেখেছে পিলারগুলি। তলায় আছে দুটি রোমান খিলান। চার্চে প্রবেশের পরেই বাঁ-দিকে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি। ডানদিকেও, যিশু, মা মেরি ও যিশুর জীবনকেন্দ্রিক নানা ঘটনামুহূর্তকে একাধিক মূর্তির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। আছে অজস্র তৈলচিত্রও। এরপর ডানদিকে এগোলে, প্রধান উপাসনাকক্ষ। কক্ষে, সারি সারি প্রার্থনার আসনরূপী কতগুলি কাঠের বেঞ্চ রাখা। কিন্তু ওই কক্ষে কেবলমাত্র ধর্ম-অনুসরণকারীদেরই প্রবেশ সম্ভব। কৃষ্ণনগর চার্চের সর্বাধিক উঁচু যিশুমূর্তিটির শিল্পসৌকর্য চোখে পড়ার মতো। এখানে জানিয়ে রাখা উচিত, এই মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন কৃষ্ণনগরের যশস্বী মৃৎশিল্পী বরেণ পাল।
আরও পড়ুন:মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়
অনেকেই এ-কথা জানেন, পর্যটন দপ্তর ঘোষিত, রাজ্যের প্রাচীন সাতটি গির্জার মধ্যে কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্রাল চার্চ অন্যতম। ‘প্রাচীন’ শব্দটিকে সামনে রেখে এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য এ-চার্চের প্রতিষ্ঠাবৃত্তান্তটি। ইতিহাসকথন অনুযায়ী, ১৮৪৫ সালে টমাস জাবিবুক প্রথম কৃষ্ণনগর আসেন এবং তাঁরই একান্ত উদ্যোগে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি উপাসনাগৃহ কৃষ্ণনগরে স্থাপিত হয়।
এখানে আরও কয়েকটি তথ্য মনে করে নেওয়া উচিত। কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের প্রধান ধর্মীয়-মন শাক্তভাবনার দিকে প্রবাহিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রজাদের মধ্যেও সেই ভাবনারই ঢেউ ছিল পূজারূপে জাগ্রত। পাশাপাশি কৃষ্ণনগর থেকে সামান্য দূরত্বে, বাংলার প্রথম আধুনিক-মনের রূপকার শ্রীচৈতন্যের অভ্যুত্থান, অল্প হলেও বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি এখানকার বাসিন্দাদের আশ্রয়ভাবনায় নিমজ্জিত করেছিল। ‘অল্প হলেও’ বলছি এই কারণে, এমন কথিত আছে, বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও চৈতন্যের ভাবমূর্তিকে বিশেষ পছন্দ করতেন না রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। এও শোনা যায় যে, তাঁর রাজত্বসময়ে নবদ্বীপে চৈতন্যপূজা প্রায় বন্ধ হওয়ার সম্মুখীন হয়েছিল।
যদিও, এ-তথ্য অনেকেই মানতে নারাজ। কিন্তু এ-কথা স্বীকার্য যে, কৃষ্ণনগরের এত কাছের একটি অঞ্চলে চৈতন্যের আবির্ভাব-ঘটনা, যা প্রায় গোটা মধ্যযুগের নানান শিল্প-সাহিত্য ও মানুষের জাগরুক-ভাবনাকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছিল, চৈতন্য-মতাদর্শের সেই হরিনাম-বাতাস তেমনভাবে কিন্তু কৃষ্ণনগরে প্রবেশ করতে পারেনি। শহরে দুটি গৌড়ীয় মঠ আছে, ঠিকই, কিন্তু তাদেরও বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি নয়!
আরও পড়ুন: উনিশ শতকে বিশ্বের দরবার আলো করে ছিল, কালের নিয়মে কদর হারিয়েছে কৃষ্ণনগরের মূর্তি
এইসব তথ্যের উল্লেখ করছি একটিই কারণে। ১৯৪৫ সালে যখন টমাস জাবিবুক কৃষ্ণনগরে এলেন, তার ৬৩ বছর আগে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রয়াত হয়েছেন। সম্ভবত, তখন শিবচন্দ্র রায়ের রাজত্বকাল। তখন, জাবিবুক যে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের জন্য উপাসনাগৃহ তৈরি করছেন, সেই ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃষ্ণনগরের স্থানীয় ভক্তরাও নিশ্চয়ই ছিলেন। অর্থাৎ, হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি, খ্রিষ্টবিশ্বাস সে-সময়ের আগে থেকেই কৃষ্ণনগরের কিছু মানুষের মধ্যে প্রবেশ করেছিল!
জানা যায়, ১৮৪৫-এ উপাসনাগৃহটি তৈরির পরে নিজের অসুস্থতার কারণে উপাসনাগৃহটিকে বন্ধ করতে বাধ্য হন জাবিবুক। এবং সেখানে একটি ডিসপেনসারি খোলা হয়। এর ১০ বছর পরে, ফাদার মিলন বেঙ্গল মিশনের জন্য কাজ করার সময় সেই ডিসপেনসারিটি ফেরৎ চান। তাঁর এই চাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছিল স্থানীয় ভক্তদের ইচ্ছেও। ১৮৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর, উপাসনাগৃহটির পরিচালনার জন্য বিশপ নিযুক্ত হন ফ্রান্সিস পোজি। ‘কৃষ্ণনগর রোমান ক্যাথলিক ডায়োসিস’─সরকারিভাবে নামটি স্থির হয় ১৮৮৭ সালে। এবং ১৮৮৭ সালেই, এক ভূমিকম্পে চার্চের বহু অংশ ভেঙে পড়ে। এখন যে-চার্চটি আমরা দেখতে পাই, তা বিশপ পোজির চেষ্টায় ভূমিকম্পের দু’বছরের মধ্যেই গড়ে তোলা হয়। তবে এখন আর ‘কৃষ্ণনগর রোমান ক্যাথলিক ডায়োসিস’ নয়, বদলে ‘কৃষ্ণনগর ক্যাথলিক চার্চ’ নামেই এই গির্জাটি বেশি পরিচিত।
২০০৯ সালে, চার্চের ঠিক উলটো দিকে তৈরি হয় এক নতুন স্থাপত্য, যার নাম─খ্রিষ্টমন্দির। বাইরের দেওয়ালে রয়েছে সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট পলস্, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার, সেন্ট জেমস্-এর মতো সন্তদের মূর্তি। প্রধান দরজার চূড়ায় রয়েছেন, মা মেরির কোলে সদ্যোজাত যিশু। তার সামনে, একাধিক ভারতীয় চিন্তক ও মনিষীদের মূর্তি। আর ভেতরে? ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায়, ‘খ্রিষ্ট’ শব্দটির সঙ্গে ‘মন্দির’ শব্দটির সংযুক্তির কারণ।
খ্রিষ্টমন্দিরের ভেতরের প্রধান দেওয়ালে, নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত, হিন্দু-রীতির নানান প্রথাচিহ্নকে ব্যবহার করে, দেওয়ালে মূর্তির সাহায্যে দেখানো হয়েছে একটিই দৃশ্য─যিশু বাঙালি-হিন্দুর ঘরে জন্মালে কেমন হত তাঁর চারপাশ! উলুধ্বনি সহযোগে আমাদের চেনা পরিবেশে সেই ঈশ্বর-সন্তানের আবির্ভাবের চিন্তাকেই ‘খ্রিষ্টমন্দির’ তুলে ধরেছে, যা একইসঙ্গে নতুন ও কিছুটা হলেও অনিরপেক্ষ। কারণ বাঙালিয়ানার মধ্যে কেবল হিন্দুত্ব নয়, অনেক ধর্মই একত্র রামধনু বসবাস করে। কিন্তু দেয়ালের ওই মূর্তিগুলির কাহিনিচিত্রের মধ্যে অন্য কোনও ধর্মের প্রবেশাধিকার প্রায় যেন নেই।
আরও পড়ুন:ইতিহাসে মাখামাখি বড়দিন! কলকাতার বুকে যেভাবে বেঁচে রয়েছে একফালি আর্মেনিয়া
তবু আশ্চর্য এই যে, ধর্মনিয়ন্ত্রকদের মন অনেক জটিলতাকে সঙ্গে নিয়ে চললেও, সাধারণ মানুষের তাতে খুব একটা যায় আসে না। তাই হয়তো চার্চে ঢোকার তিনটি রাস্তার মধ্যে একটির অর্ধেক অংশে রয়েছে মুসলিমদের বাস। সেখানে নতুন একটি মাদ্রাসা স্কুলও তৈরি হচ্ছে এখন। প্রত্যেক বছর ২৫ ডিসেম্বরে এই রাস্তাটিতেই মেলা বসে। সেইসব মুসলিমগৃহের সামনেও চলতে থাকে মেলা। সম্পূর্ণ গলিটাই সাজানো হয়, আলো দিয়ে। রাস্তাটির মাঝখানে, যার একদিকে খ্রিষ্টানদের বসবাস অন্যদিকে নির্মীয়মাণ মাদ্রাসা, সেখানে বাঁশ পুঁতে, খড় বিছিয়ে, ছোট-ছোট পুতুল দিয়ে সাজিয়ে, নানান আলো-সহযোগে বেথলেহেমে সদ্যোজাত যিশুর জন্মমুহূর্তটি দেখানো হয়।
চার্চের মেলায় ছোট থেকে যখনই দাদুর সঙ্গে, ওই ছোট-ছোট পুতুল-ঘেরা যিশুর জন্মমুহূর্তটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম, মনে হত এ তো জন্মাষ্টমীর ঝুলন!
আজ বুঝি, যিনি বা যাঁরা খড়ের ওপর ওই পুতুলগুলি প্রত্যেক বছর সাজান, পৃথিবীর সেই সাধারণ মানুষগুলির কাছে গোকুলের কৃষ্ণের ছোটবেলা, আর বেথলেহেমের ২৫ ডিসেম্বর, ‘প্রার্থনা’ ও ‘শান্তি’র নিরাময়ে, যেন সমার্থক!