Hamas vs Israel: গাজার মৃত শিশুদের আঙুল সব আমার দিকে তাক করা
Hamas Vs Israel: ইজরায়েলের হামলায় প্রতিদিনই অনাথ হচ্ছে গাজার শিশুরা। জল নেই। খাবার নেই। মাথার উপর আশ্রয় নেই। এক ভয়াবহ আতঙ্ক, ট্রমা গিলে খাচ্ছে হামজাদের।
ঘৃণা। হিংসা। প্রতিহিংসা। আক্রোশ। এই শব্দ গুলিকে পরপর সাজিয়ে রাখলাম। তাকিয়ে দেখলাম খুবলে নেওয়া চোখ যেমন অন্ধকার, তেমনই এই সব শব্দের ভিতর থেকে একটা রক্তমাখা শিশুর হাত উঠে আসছে। তার আঙুল আমার দিকে তাক করা। সেই আঙুল যেন বিদ্রুপ করছে। বলছে, তুমি, তুমিই এ সব কিছুর জন্য দায়ী। মাইল-মাইলব্যাপী খননের হাড়-পাঁজরা। শিশুদের গণকবর। ভিতর থেকে উঠে আসছে উপহাস, দীর্ঘশ্বাস, শ্মশানগোঙানি, বুক খালি করা চিৎকার। বলছে, এক বধির পৃথিবীর কথা। এক অন্ধ সমাজলোকের কথা। 'তুমি, তুমি, তোমরা এ সব কিছুর জন্য দায়ী'।
তাই হামজা মালাকা-এর কান্নার পাশে সব সুর স্তব্ধ হয়ে যায়। ঠোঁটের কোনায় রক্তের ধারা। এক মাথা চুল লহুতে ভিজে আঠা হয়ে রয়েছে। হামজা এই পৃথিবীর দিকে বিপন্ন বিষ্ময়ে তাকিয়ে। ছোট দুই মুঠি দিয়ে কখনও নিজের চোখ ঢেকে ঢেকে নিচ্ছে সে। পারছে না। ওর সদ্য ফোটা চোখের তারায় যেন বা বিধ্বংসী আগুনডানার ক্ষত। হামজা মালাকা গাজার এক হাসপাতালে শুয়ে অস্ফুট স্বরে কাঁদছে। বোমা, রকেটের হামলায় বিস্ফোরণে হামজাদের ঘর-বাড়ি সব ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। ২ বছরের হামজা জানেই না, এই পৃথিবীতে ওকে কেউ হয়ত আর আঙুল ধরে হাঁটতে শেখাবে না কোনওদিন। যুদ্ধ কেড়ে নিয়ে নিয়েছে বাবা-মা, ভাই বোন সবাইকে। হামজা একা। কেউ একজন হামজার বুকের উপর হাত রেখে সুরা ইখলাস শোনাচ্ছেন। ঘুম পাড়ানির মতো শোনাচ্ছে সেই সুর। নিরাপরাধ এক অনাথের কান্নার যে স্বর, তার পাশে সেই সুরও যেন ডুকরে ডুকরে উঠে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: Hamas-Israel War: এই যুদ্ধে প্যালেস্টাইনের পক্ষে কারা?
হালেলুইয়া। হালেলুইয়া। ঈশ্বরের নামে শব্দ করুন। কারণ ঈশ্বর খুব পবিত্র, সুন্দর। তাঁর সুন্দর নামের উচ্চারণ করুন। 'ভগবান কত ভালো, অপরের চোখ অন্ধ করেও আমাকে দিলেন আলো। ভগবান কত মিষ্টি, অন্য খামারে আগুন জ্বেলেও আমাকে দিলেন বৃষ্টি'।
জল নেই। জল নেই। এক ফোঁটাও জল নেই। পান করার মত পানীয় নেই। জলের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। যুদ্ধধ্বস্ত একটা গোটা শহরের মানুষ পানীয় জলের জন্য আর্তি জানাচ্ছেন। বুভুক্ষের মতো কাতর প্রার্থনা করছেন। যুতটুকু আছে, রেশন করে মেপে মেপে পান করছেন। জল নেই। বিদ্যুৎ নেই। খাবার নেই। হাসপাতাল গুলোয় মর্গে জায়গা নেই। আইসক্রিমের ট্রাকের ভিতর সার সার মৃতদেহ শুয়ে। ধ্বংসস্তূপের পাথর সরিয়ে সরিয়ে প্রিয়জনের মুখ খুঁজছে মানুষ। গণকবর খোঁড়া হচ্ছে। ডাঁই করে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে মৃতদেহ। গোরের মাটি দিচ্ছে উঁচু ক্রেনের সারস।
হালেলুইয়া। হালেলুইয়া।
'তেরো বছরের মেয়ে আমি। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। আর কিছু না, এখন শুধু তোমাদের কাছে জল চাইছি। অল্প খাবার চাইছি। আমি আর কীই বা করত পারি, একমাত্র টিকে থাকতে পারা ছাড়া। আশা করতে পারা ছাড়া। তোমরা দেখছো তো আমাদের মত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের, দেখছো তো, বলো কী ভাবে টিকে আছে ওরা? কী অপরাধ করেছি আমরা বলতে পারো? আরও অনেক শিশুর মত আমাদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। আমরা কি আবর্জনা, বাতিল কাগজ, জঞ্জালের স্তূপ? বলো একবার বলো? কী ভয়ঙ্কর আতঙ্ক আর ট্রমার ভিতর দিয়ে দিন যাচ্ছে, রাত যাচ্ছে, তোমরা কি তার কিছু আন্দাজ করতে পারছ? আমি দেখেছি চোখের সামনে আমার প্রিয়জন সব একে একা মারা যাচ্ছে। তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। তাঁরা চিৎকার করছে। বাড়িঘরের ধ্বংসের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। এরপরও কী ভাবে শান্তিতে থাকব, বলবেন? কেউ বলবেন'?
আরও পড়ুন: হাসপাতাল থেকে আর কখনও ফিরবে বাবা? গাজায় পথ চেয়ে একরত্তি মেয়ে
টিকে আছি মাত্র এই, একে যদি টিকে থাকা বলো। ডাঁই করা মৃতদেহ, মৃত নয় এখনও জীবিত আছে, এখনও বিষ্ময় দুই চোখে। কোথাও কিছুই নেই শুধু তার জাগরণ আছে। এইখানে উদ্বাস্তু শিবিরে, আলো নেই অন্ধকার নেই। শুধু তীব্র জলকষ্ট, শুধু শীত, শুধু খিদে পেটে দাঁতে দাঁত টিকে থাকা ইঁদুরের মতো...
প্রসূতি সদনের থমথমে করিডর। বিদ্যুৎহীন, নিষ্প্রদীপ। পর পর সাইরেনের শব্দ। স্ট্রেচারে শুয়ে অপেক্ষায় এক সন্তানসম্ভবা। গাজার মা। তাঁর মতোই ৫০ হাজার সন্তানসম্ভবা এক ভয়াবহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পল-অনুপল অপেক্ষায়। প্রসূতি সদনগুলির অবস্থা কল্পনার অতীত। নার্স নেই। চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই অন্তত ৫ হাজার মহিলা সন্তান প্রসব করবেন। তাঁদের মধ্যে কারও কারও আবার শারীরিক জটিলতা আছে। ঠিক পরের ঘণ্টায়, পরের মিনিটে, পরের দিন, পরের মুহূর্তে কী ঘটবে কারও জানা নেই। প্রসবের পর শিশুর জামাকাপড়, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, মানসিক বিকাশ কী ভাবে হবে? কারও জানা নেই।
প্রাণের ভয়ে ছুটতে ছুটতে সে রকমই এক হাসপাতালেই ঢুকে পড়েছে উমর আর তার ছোট বোন সোসো। কেউ জানে না ওদের বাবা-মা কোথায়। সোসো-র পায়ে চোট লেগেছে, রক্ত জমাট বেঁধে। উমর বলছে, সে ভয় পায়নি। সে জানে বোনকে বাঁচাতে হবে। আকাশ থেকে যখন বৃষ্টির মত বোমা পড়ছিল। সোসোর হাত ধরে ছুটতে ছুটতে উমর হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। পায়ে জুতো নেই। এরপর ঠিকানা কি হবে জানা নেই। সোসোকে পাশে নিয়ে উমর হাসপাতালের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে। আপাতত টিকে আছে।
পর পর এ রকম মরবিড দৃশ্যকল্প গুলির সামনে স্থবিরের মত বসে থাকি। লিখতে শুরু করি, ঘৃণা। হিংসা। প্রতিহিংসা। আক্রোশ। এই শব্দ গুলি। চোখ খুবলে নেওয়া কোটরের যে অন্ধকার, তেমনই শব্দ গুলির ভিতর থেকে উঠে আসে মরা শিশুর অসংখ্য হাত। আর তাদের আঙুল তাক করা আমার দিকে। সেই আঙুল যেন বিদ্রুপ করে। বলে, 'তুমি, তুমিই এ সব কিছুর জন্য দায়ী'। উপহাস করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুক খালি করা চিৎকার উঠে আসে দাফনের অতল থেকে।