বিপদের নাম 'লেজি আই', সন্তানের দৃষ্টিশক্তি বাঁচাতে কী করবেন
শৈশবের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের বীজ। কাজেই আপনার বাচ্চার দেখতে অসুবিধা হলে গাফিলতি নৈব নৈব চ।
সন্তানকে সুন্দর শৈশব দিতে কে না চায়? কিন্তু শিশুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলে ঝাপসা হতে পারে তার ভবিষ্যত। রোগ যদি চোখের হয়, তা কখনওই গাফিলতি করার নয়। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ ডেকে আনতে পারে ভয়ংকর বিপদ। হারাতে পারে দৃষ্টিশক্তি। বিপদের নাম 'লেজি আই'। চোখের একটি বিশেষ সমস্যাকে 'লেজি আই' বলা হয়ে থাকে। আজকের দিনে লেজি আই-এর সমস্যা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে চোখের এই সমস্যা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। লেজি আই-কে অ্যামব্লিওপিয়া-ও বলা হয়ে থাকে। জন্ম থেকেই চোখের এই সমস্যা থাকতে পারে। যদি সঠিক সময় রোগের সঠিক চিকিৎসা না হয়, তাহলে এর পরিণাম ভয়ংকর। একেবারে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে শিশু। কাজেই জেনে নিন, শিশুর মধ্যে কী লক্ষণ দেখলে আপনি সতর্ক হয়ে যাবেন। কী ধরনের চিকিৎসার আশ্রয় নেবেন, তাও জেনে নিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে।
চোখের পাতা যদি ভারী হয়, তাহলে চোখের দৃষ্টি অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। এর থেকে লেজি আই হতে পারে। লেজি আই-এর সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হল মাসল ইমব্যালান্স। চোখের মাসলের মধ্যে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ না থাকলে দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা হতে পারে।
লেজি আই বা অ্যামব্লিওপিয়ার লক্ষণ
ছোটবেলায় বাচ্চার দেখতে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, তা নজর রাখা প্রয়োজন। যদি আপনার সন্তান খুব ঘন ঘন চোখ পিটপিট করে এবং রোদে বেরনোর সময় একটা চোখ বন্ধ করে ফেলে, তাহলে হয়তো তার লেজি আই রয়েছে। হতে পারে, আপনার সন্তানের একটা চোখের দৃষ্টিশক্তি অন্যটার চেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন: অবসাদ আসলে বড় বিপদের সংকেত! সতর্ক হওয়ার সময় এখনই, বলছে গবেষণা
লেজি আই থাকলে আপনার সন্তানের বই পড়তে সমস্যা হবে। সে যদি একটা শব্দ বারবার পড়ে বা কোনও কোনও শব্দ বাদ দিয়ে পড়ে বা জানা শব্দ ভুলভাবে উচ্চারণ করে, তাহলে হতে পারে ওর লেজি আই রয়েছে। দুর্বল চোখে পড়ার জন্য বেশি এফর্ট দিতে হয়, তাই পড়ায় সমস্যা হতে পারে। আপনার সন্তান যদি বারবার পড়ে যায় বা বারবার কোনওকিছুতে ধাক্কা খায়, তাহলে ওর লেজি আই থাকতে পারে। একটা চোখ দুর্বল হওয়ায় ও কোথায় কোনও জিনিস রয়েছে, তা ও ভালোভাবে সব সময় বুঝতে পারে না। চোখ ও হাতের কো-অর্ডিনেশন ঠিক না থাকায় এই ধরনের শিশুরা বাইরে গিয়ে খেলাধুলো করতে পারে না। টিভি দেখার সময় আপনার সন্তান কি বারবার মাথা এদিক-ওদিক ঘোরায়? এর কারণ হতে পারে লেজি আই। সক্রিয় চোখ দিয়ে দ্রষ্টব্য বস্তুকে ফোকাস করার জন্য মাথা বারবার এদিক-ওদিক ঘোরাতে হয় ওকে।
কী কারণে লেজি আই হয়?
চশমার পাওয়ার যাই-ই থাকুক না কেন, ভিশন বা দৃষ্টিশক্তি সাধারণভাবে থাকা উচিত ৬/৬। অর্থাত্ ৬ মিটার দূরত্ব থেকে ৬ মিলিমিটার হরফ পড়া যাবে। কোনও কারণে একটি চোখে বা দু’টি চোখেই যদি এই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ৬/৬-এর কম হয়ে থাকে, তাহলে এই সমস্যাকে বলা হয় 'লেজি আই' বা অ্যামব্লায়োপিয়া। অনেক সময় দেখা যায়, চোখের ভেতর কোনও সমস্যা নেই, অথচ দেখতে সমস্যা হওয়ার কারণে যতই চশমার পাওয়ার দেওয়া হোক না কেন, রোগীর ভিশন বা দৃষ্টি কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে দৃষ্টিশক্তি ৬/৬-এর কম হওয়ার কারণেই দেখতে সমস্যা হচ্ছে। লেজি আই দুই ধরনের হয়। ইউনিল্যাটেরাল এবং বাইল্যাটেরাল। একচোখে দৃষ্টিশক্তি কম থাকলে তাকে বলে ইউনিল্যাটেরাল অ্যামব্লায়োপিয়া। দুই চোখেই দৃষ্টিশক্তি কম থাকলে তাকে বলে বাইল্যাটেরারাল অ্যামব্লায়োপিয়া।
অনেক সময় একটা চোখের দৃষ্টিশক্তি অন্য চোখের থেকে বেশি হয়। সেক্ষেত্রে যে চোখের দৃষ্টিশক্তি বেশি, হয়, সেই চোখ আরও বেশি করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কারণ একটা চোখ যখন ঝাপসা দেখছে এবং অন্য চোখটা পরিষ্কার দেখছে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ঝাপসা চোখকে আরও বেশি করে উপেক্ষা করবে এবং সক্রিয় চোখটাকে আরও বেশি করে ফোকাস করবে। সময়ে ব্যবস্থা না নিলে এক্ষেত্রে সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জ্যোতির্ময় দত্ত বলেন, "লেজি আই হলো অলস চোখ, অর্থাৎ এর নিজের কোনও কার্যক্ষমতা নেই। এটা একরকম বসে বসে খাওয়ার মতো ব্যাপার। একটা বাচ্চা জন্মানোর পর ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত তার দৃষ্টিশক্তি থাকে না। ৬ সপ্তাহ পর থেকে রেটিনার ম্যাকুলার ডেভলপমেন্ট শুরু হয়। ৬ বছরে ডেভেলপমেন্ট কমপ্লিট হয়। এই সময়কালের মধ্যে যদি রেটিনাতে ছবি পরিষ্কার ফুটে না ওঠে তাহলে চোখ লেজি হয়ে যায়। জন্মগত কারণে চোখে হাই পাওয়ার থাকলে হতে পারে। জন্মগতভাবে ছানি থাকলে হতে পারে। গ্লুকোমা থাকলেও হতে পারে। একটা বয়সের পর তখন পাওয়ার দিয়েও সে আর দেখতে পায় না।"
কী চিকিৎসা
লেজি আই বা অ্যামব্লায়োপিয়া হলে তা কখনও কোনও ওষুধ দিয়ে সারানো সম্ভব নয়। এমন ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে প্লিঅপটিক এবং অর্থোপেডিক চিকিৎসার দরকার হয়। সেই সঙ্গে চালাতে হয় নানা ধরনের ভিশন থেরাপি। এই রোগের চিকিৎসার সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে হাসপাতালে এবং বাড়িতে ভিশন থেরাপি চালাতে হয়। লেজি আই থেকে যে ভয়ানক সমস্যা হতে পারে, তা হলো, চোখ ট্যারা হয়ে যেতে পারে। চোখ ট্যারা দুইভাবে হয়। এতে চোখের মণিদু’টি নাকের দিকে, অর্থাত্ ভেতরের দিকে ঢুকে যেতে পারে। আবার মণি দু’টি বাইরের দিকে অর্থাত্ নাক থেকে দূরের দিকে সরে যেতে পারে। এসব কারণে দু’টি চোখ সমান কাজ করতে পারে না। এর থেকে চোখের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। রোগী বেশিক্ষণ টিভি দেখতে পারে না বা কম্পিউটারে কাজ করতে পারে না। দু’টি চোখ একসঙ্গে কাজ না করতে পারায় চোখ বা চশমার পাওয়ার বেড়ে যায়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে এর থেকে অন্ধত্বও দেখা দিতে পারে।
ডাক্তার জ্যোতির্ময় দত্ত জানিয়েছেন, "বাচ্চা বয়সে এই রোগ হলে পরবর্তীকালে পাওয়ার দিলেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে না। এর চিকিৎসা হলো ভালো চোখকে বন্ধ করে রেখে খারাপ চোখ দিয়ে দেখানো হয়। এখন দৈনিক ৩ ঘণ্টা ভালো চোখ বন্ধ করে রেখে খারাপ চোখ দিয়ে দেখানোর ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্যারা হলেও লেজি আই হয়। ৮ বছর পর অপারেশন করে কোনও লাভ হয় না।"
একটা শৈশবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের বীজ। কাজেই আপনার বাচ্চার দেখতে অসুবিধা হলে গাফিলতি নৈব নৈব চ। আর বিপদ দরজায় কড়া নাড়লে ডাক্তারের পরামর্শ নিন, ক্লিন বোল্ড করুন রোগকে।