সেলিব্রিটিদের পছন্দ, মল থেকে তৈরি এই কফির নেপথ্য ইতিহাস জানলে শিউরে উঠবেন
প্রাণীর মল থেকে কফি! তা-ও আবার এত দাম? কী ভাবে তৈরি করা হয় এই কফি?
কপি লুয়াক - পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি। তৈরি হয় সিভেট নামের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মল থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কাপ কফি আশি ডলারে বিক্রি হত মহামারী পূর্ববর্তী সময়ে। সংবাদমাধ্যম জানান দিচ্ছে, করিনা কাপুর থেকে আলিয়া ভাট, এমনকী বাংলার নুসরত জাহান এবং যশও নিয়মিত পান করেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি। কিন্তু প্রাণীর মল থেকে কফি!
তা-ও আবার এত দাম? কী ভাবে তৈরি করা হয় এই কফি?
শুরুতেই কিছু কথা বলা যাক সিভেট জাতীয় এই প্রাণীটি সম্পর্কে। এই প্রাণীটিকে পাওয়া যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু দেশে। বেড়াল-সদৃশ্য প্রাণীটির মুখে আবার রেকুনের মত দাগ দেখা যায়, এদিকে বাঁদরের মত লম্বা লেজও রয়েছে তার।পতঙ্গ এবং ছোটো ছোটো সরীসৃপ প্রাণীকে খাওয়ার পাশাপাশি, এরা কফির ফলও খায়। কিন্তু কফির ফলের ত্বক এরা খেয়ে হজম করতে পারলেও, কফির ভেতরের বীজ, যেটি আদতে গুঁড়ো করে কফি হিসেবে বিক্রি করা হয়, সেটিকে এরা একেবারেই হজম করতে পারে না। এই অপাচিত বীজটি সিভেটদের মলের সাথে নির্গত হয়। সেটিকে আবার ধুয়ে, গুঁড়ো করে তৈরি করা হয়
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি।
সিভেট কফির ফলগুলিকে খাওয়ার ফলে কফির বীজে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে অন্যতম কফির অ্যাসিডিক ভাব কমে যাওয়া; অ্যাসিডিক ভাব কমে গেলে, কফির স্বাদ হয়ে ওঠে আরও মসৃণ। সিভেটের খাদ্যনালী থেকে নি:সৃত উৎসেচকের ফলেই এই পরিবর্তন আসে।
কিন্তু এত দামী, সেলিব্রিটিদের গ্রহণ করা কফি তৈরির অন্তরালে যে এক অন্ধকার ইতিহাস আছে, সে সত্য আর কতজনের সামনে এসেছে? একদম প্রথম দিকে অত্যন্ত দামী এই কফি উৎপাদনের ব্যবসা সিভেটদের কোনো ক্ষতি করেনি। ইন্দোনেশিয়াতে ব্যবসারস্বার্থে তৈরি কফির খামারে ঘুরে বেড়াতো সিভেট। কফি গাছ থেকে পেড়ে খেত সবচেয়ে ভালো
এবং পাকা ফলগুলিকে। কিন্তু সমস্যা হল, যখন এই কফির চাহিদা বাড়তে শুরু করলো। শিকারীরা শিভেট ধরে আনা শুরু করল কফির খামারে। তাদের বন্দি করে রাখা শুরু হল খুব ছোটো ছোটো খাঁচায়, যেখানে টেনেটুনে একটা খরগোশ থাকতে
পারে। আকারে কিন্তু সিভেট খরগোশের চেয়ে বড়।
এদিকে তখন ইন্দোনেশিয়াতে পর্যটন শিল্পের রমরমা। পর্যটকরা প্রায়ই এই কফির ফার্মগুলিতে বেড়াতে আসেন এবং অবশ্যই
খাঁচাবন্দী সিভেটরা তাঁদের অন্যতম আকর্ষণ। সিভেট আদতে নিশাচর প্রাণী, উপরন্তু লাজুক। দল বেঁধে এদের ঘুরতে দেখা যায় না। এত পর্যটকদের সামনে দেখতে পেয়ে এরা ভয় পায়। একা চলাফেরা করা, লাজুক এই প্রাণীরা মানুষ তো বটেই, ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা অন্যান্য সিভেটদেরকে দেখেও ভয় পায়। যার ফলে বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তন দেখা যায় এসের শরীরে, যা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক নয়।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়াইল্ডলাইফ কনজা়র্ভেশন রিসার্চ ইউনিট এবং লন্ডনের ওয়ার্ল্ড অ্যানিম্যাল প্রোটেকশন এইরকম পঞ্চাশটি খাঁচাবন্দি বন্য সিভেটের অবস্থা খতিয়ে দেখেন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। তাঁদের মতে এই কফির খামারগুলিতে সিভেটদের কেবল জোর করে খাঁচাবন্দf করে রাখা হয় এমনই নয়, খুব ছোটো ছোটো খাঁচার থাকার ফলে এরা নড়াচড়াও
করতে পারে না। একটির উপর আরেকটি খাঁচা রাখার ফলে, বন্দি সিভেটগুলি মল-মূত্র ত্যাগ করলে আরেকটি সিভেটের গায়ে এসে পড়ে। সিভেটগুলি প্রায়ই মূত্রে ভিজে থাকে।
পাশাপাষি জোর করে এদের কফি বীজ খাওয়ানো হয়, অন্য খাবার দেওয়া হয় না তেমন একটা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তারা অপুষ্টির শিকার হয়। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, এরা সবথেকে ভালো কফির ফলটিকে নিজেরা গাছ থেকে বেছে
খায়। কফির খামারগুলিতে কিন্তু তা করা হয় না। এখানে সিভেটগুলিকে জোর করেই পুরোনো বা নিম্ন মানের ফল খেতে দেওয়া হয়।
কিছু কিছু সিভেট আবার নড়াচড়া করতে না পারায় স্থূলকায়ত্বে ভোগে। কেউ কেউ আবার ক্যাফিনের প্রভাবে অত্যধিক উত্তেজিত হয়ে পড়ে। নিশাচর এই প্রাণীগুলিকে দিনের জাগিয়ে রেখে, রাত্রে জোর করে ঘুম পাড়ানো হয়।
কফি কন্সালট্যান্ট এবং "কফি: আ ডার্ক হিসট্রির" লেখক টনি ওয়াইল্ড দ্য গার্ডিয়ান-এ জানাচ্ছেন, "কপি লুয়াক" বিক্রি
করার সময় দাবি করা হয়, যে তা আদ্যপান্ত প্রাকৃতিক উপায়ে বন্য সিভেটের মল থেকে বানানো। কিন্তু বিত্তবানরা যখন এই বিরল
এবম দুর্মূল্য কফি কেনেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন না সেই কফি বন্য সিভেট নাকি অত্যাচারিত খাঁচা-বন্দি সিভেটের মল থেকে বানানো। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়টি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
তবে কেবল ইন্দোনেশিয়া নয়, এখন পিছিয়ে নেই ভারতও। কর্ণাটকের কুর্গ এমনিতেই কফি উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত। কুর্গ কনসলিডেটেড কমোডিটিজ় ২০১৭ সালে থামু পুভাইয়ার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে দামী এই কফি উৎপাদন শুরু করেছে কর্ণাটকে। বিশেষ এই কফি বিক্রির উদ্দ্যেশ্যে কুর্গে ক্যাফেও চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কফি নির্মাতারা।
এত আলোচনার পরে একটি প্রশ্ন মাথায় খেলা করে, এই কফির স্বাদ আসলে কেমন?
স্পেশালটি কফি অ্যাসোশিয়েশন অফ আমেরিকার এক কফি বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, কপি লুয়াক মোটেই আহামরি খেতে
নয়। সাংবাদিক এবং খাদ্যরসিক হ্যারিসন জ্যাকবস "বিজ়নেস ইনসাইডার, ইন্ডিয়া"-তে জানাচ্ছেন, পৃথিবীর সমস্ত অদ্ভুত এবং বিরল খাবারের স্বাদ উনি পেতে চান। বেশ কিছু খাবার ইতিমধ্যেই তিনি খেয়ে দেখেছেন, যার মধ্যে কপি লুয়াক একটি। তাঁর মতে এর স্বাদে বিশেষত্ব নেই বললেই কম বলা হবে, কেবল প্রাকৃতিক বলে দাগিয়ে পর্যটকদের ঠকানোর একটি কৌশল মাত্র, যার নেপথ্যে ছোটো ছোটো প্রাণীদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে।