শীত মানেই চিড়িয়াখানা! কলকাতায় চিড়িয়াখানা তৈরির ইতিহাস জানলে তাজ্জব হতে হয়

History of Kolkata Zoo: ১৮৭৬ সালে ১ জানুয়ারি প্রিন্স অব ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড কলকাতার আলিপুরে এই চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করেন।

এ (A) ফর অ্যাপেল থেকে জ়েড (Z) ফর জু কিংবা জেব্রা তে শেষ হয় শিশুকালের ইংরেজি ওয়ার্ডবুক। আর সেই বয়েসেই জু অর্থাৎ চিড়িয়াখানার প্রতি তৈরি হয় এক অমোঘ আকর্ষণ। অল্প বয়সে পশু পাখি দেখার উত্তেজনা তো আর কেবল মানুষের চেয়ে আলাদা প্রাণী দেখার নয়; বন্যপ্রাণীদের স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো, যা খুশি তাই করার হাতছানি শিশুমন কি এড়াতে পারে? শিম্পাঞ্জির খেলা, বাঘের গুরুগম্ভীর ডাক, সিংহের কেশর নাড়া দিয়ে ওঠা, রংবেরঙের পাখির কিচিরমিচির- এসব বইয়ের পাতা কিংবা টিভির পর্দা ছাড়িয়ে চোখের সামনে দেখার মধ্যে রোমাঞ্চ অনেক বেশি। আবার পুরনো কলকাতা শহরের কথাই যদি ওঠে তবে, ভিক্টোরিয়ার পরেই আসে চিড়িয়াখানার নাম। তাই, পোড়া বঙ্গদেশে শীত পড়ুক বা না পড়ুক, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আলিপুর চিড়িয়াখানা যাওয়া চাই। ছোটরা, সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা, কখনও সখনও মধ্যবয়সীরাও সেখানে ভিড় জমান। শহরঘেঁষা অঞ্চল, দূরের জেলা, এমনকী অন্য প্রদেশের বাসিন্দারও শীতের সময় কলকাতায় বেড়াতে এলে ঢুঁ মারেন চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানার মাঠে বসে কেক, কলা, কমলালেবু খাওয়ার দিন ছিল একসময়। আজকাল অবশ্য হরেক রকম ফাস্টফুডের পসরা জমেছে চিড়িয়াখানার ভিতরে ও বাইরে। কিন্তু, কলকাতায় চিড়িয়াখানা তৈরি হল কীভাবে? কোথায় তৈরি হয়েছিল দেশের প্রথম চিড়িয়াখানা? তা জানতে একটু পিছনে হেঁটে আমাদের পৌঁছে যেতে হবে সেই উনবিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে।

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে দেশিয় রাজা বা জমিদারদের মধ্যে ব্যক্তিগত পশু সংগ্রহশালা তৈরির চল ছিল। মূলত সামরিক প্রয়োজনে সেখানে হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি রাখা হত। তাছাড়া, সেই সময় যাতায়াত করার জন্য হয় হেঁটে, নাহলে পশুর পিঠে চড়ে যাওয়াই একমাত্র ভরসা ছিল। রাজ-রাজাদের অনেকেই নিছক শখ মেটাতে বাঘ, সিংহর মতো বন্যপ্রাণী এবং দেশ-বিদেশের পাখি রাখতেন নিজেদের সংগ্রহশালায়। তবে, ১৮০২-১৮০৩ সাল নাগাদ কলকাতার কাছেই গঙ্গার পাড়ে সেনা ব্যারাক অধ্যুষিত অঞ্চলে তৈরি হল ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা। ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলি এই অঞ্চলে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে একটি বাগানবাড়ি তৈরি করেন। বাগানবাড়ির মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন তিনি। একসময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য গার্ডেনরিচ অঞ্চলে যে পশু সংগ্রহশালা গড়ে উঠছিল তাকেই ব্যারাকপুরে তুলে এনে আধুনিক চিড়িয়াখানার রূপ দিলেন ওয়েলেসলি।

আরও পড়ুন- ঘুরে বেড়াত ক্যাঙারু থেকে কালো চিতাবাঘ! কলকাতার কাছেই গড়ে উঠেছিল এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা

Colesworthy-র আঁকা ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানার ছবি

এই অঞ্চলকে এখন আমরা ব্যারাকপুর নামে চিনি। আরেকটু পরিস্কার ভাবে বললে, ব্যারাকপুর চিড়িয়া মোড় নামে যে জায়গাটি পরিচিত ঠিক সেখানেই ছিল লাটসাহেবের বাগানবাড়ি লাগোয়া এই চিড়িয়াখানা। আজ অবশ্য সেখানে কংক্রিটের বেড়াজালে বন্য জীবনের লেশমাত্র নেই। ওয়েললেসলির হাতে যে চিড়িয়াখানা তৈরি হল তার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত হলেন পশুতত্ত্ববিদ ডঃ ফ্রান্সিস বুকানন। পাশাপাশি, চিত্রকর নিযুক্ত করা হল নতুন নতুন জীবজন্তুর ছবি সহ বর্ণনা লিখে রাখার জন্য। অনতিকাল পরেই ওয়েলেসলি বড়লাটের দায়িত্ব ছাড়লেন। চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়করাও সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেলেন। ১৮২৩-এ বড়লাট হয়ে আসেন লর্ড আমহার্স্ট। তাঁরই একটি চিঠির থেকে জানা যায়, সেখানে নাকি আফ্রিকার সিংহ, তিব্বতের বাইসন এবং ক্যাঙ্গারু পর্যন্ত থাকত। ১৮৩৭ সালে এমিলি ইডেনের (যাঁর নামেই তৈরি হয়েছিল কলকাতার বর্তমান ইডেন গার্ডেন্স) বর্ণনায় ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানায় বেবুন, জিরাফ, বাঁদর, গণ্ডারের উল্লেখ পাওয়া যায়। চিড়িয়াখানার ছবিও এঁকেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ব্রিটিশ চিত্রকর কলসওয়ার্দি (Colesworthy)।

চিড়িয়াখানা গড়ার কাজে পিছিয়ে ছিলেন না দেশিয় জমিদাররা। ঊনবিংশ শতকে উত্তর কলকাতার ছোট-বড় জমিদারবাবুদের ছিল আলো ঝলমলে জীবন। বিত্তবান হওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। তেমনই, কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের শিক্ষিত, শিল্পানুরাগী এবং পশুপ্রেমী জমিদার ছিলেন রাজেন্দ্র মল্লিক। ১৮৩৫ সালে এই রাজেন মল্লিক বানালেন চোখ ধাঁধানো এক রাজবাড়ি- মার্বেল প্যালেস। এই প্যালেসকে তিনি পাথরের কারুকার্য, দুষ্প্রাপ্য চিত্রকলা দেশ-বিদেশের অসাধারণ সব শিল্পকর্ম দিয়ে সাজিয়ে তুললেন। বর্তমান মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে অবস্থিত মার্বেল প্যালেসে ঢোকার মুখে যে বিশালকার ফোয়ারা রয়েছে তার গঠনশৈলী দেখে আজও তাক লেগে যায়। প্যালেসের বাগানেই ১৮৫৪ সালে মল্লিক বাবুর উদ্যোগে গড়ে উঠল পশু সংরক্ষণশালা ও পাখিরালয়।

আরও পড়ুন- অবাক করা এই দুই চিড়িয়াখানা চিরতরে হারিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ থেকে

ছবিতে মার্বেল প্যালেস

নিতান্তই শখ-সৌখিনতা নয়, রীতিমতো পশু-পাখি সম্পর্কে পড়াশোনা করে সচেতনভাবে যত্ন নিয়ে তিনি এই সংরক্ষণশালা তৈরি করলেন। এখানে পশুপাখি রাখার জন্য যে খাঁচাগুলি ব্যবহার করা হত তার গঠন যথেষ্ট আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক। জানা যায়, তাঁর চিড়িয়াখানার অন্যতম আকর্ষণ ছিল সাদা ময়ূর। এই ময়ূর তিনি নাকি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের কাছ থেকে। পশুপ্রেমী রাজেন মল্লিক উৎসাহী ছিলেন জনসাধারণের মধ্যে পশুপাখি এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করায়। এই উদ্দেশ্যেই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার দরজা খুলে দেন সর্বসাধারণের জন্য। যদিও বর্তমানে এই চিড়িয়াখানার কিছুটা অস্তিত্ব রয়েছে। চাইলে ঘুরে আসাই যায়। ময়ূর, পেলিকান, অ্যান্টিলোপ, পাহাড়ি ময়না সহ প্রচুর পাখ-পাখালি এবং হরিণ, ভালুক, মোঙ্গুস প্রভৃতি জন্তু-জানোয়ার রয়েছে। তবে, চিড়িয়াখানার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হলেও ভারত সরকারের প্রাইভেট জু অ্যাক্ট মেনেই তা নিয়ন্ত্রিত হয়।

১৮৭৩ সালে স্যার রিচার্ড টেম্পল নামক জনৈক লেফটেন্যান্ট গভর্নর কলকাতায় চিড়িয়াখানা গড়ার প্রস্তাব দেন। ১৮৭৬ সালে ১ জানুয়ারি প্রিন্স অব ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড কলকাতার আলিপুরে এই চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করেন। রাজেন্দ্র মল্লিক সহ বাংলার অনেক ছোট-বড় জমিদারবাবুরা চিড়িয়াখানা তৈরিতে সহায়তা করেন। ওই সময় ব্যারাকপুরের চিড়িয়াখানার অবস্থান করুণ হয়ে পড়েছিল। সেখানকার পশু-পাখিদের নিয়ে আসা হয় এই নতুন তৈরি হওয়া আলিপুর চিড়িয়াখানায়। জার্মান ইলেকট্রিশিয়ান কার্ল লুইস সোয়েন্ডলার যিনি তৎকালীন ভারতীয় রেলওয়ে স্টেশনের বৈদ্যুতিকরণের দায়িত্বে ছিলেন তিনিও বহু পশু দান করেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। রবার্ট ক্লাইভ উপহার পাওয়া অ্যালড্রাবা প্রজাতির একটি দৈত্যাকার কচ্ছপ এনে রেখেছিলেন এখানেই, যা সেই সময় পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণী ছিল। এই চিড়িয়াখানায় সাদা বাঘও ছিল একসময়। বাঘ ও সিংহের শংকর প্রজাতির টাইগন তৈরি করা হয় এই পশুশালায়। এছাড়াও অনেক অবলুপ্তপ্রায় পশু-পাখির ঠাঁই হয়েছে। আলিপুর চিড়িয়াখানা বর্তমানে ভারত সরকারের সেন্ট্রাল জু অথরিটির নিয়ন্ত্রণাধীন।

আলিপুর চিড়িয়াখানা

আজকাল বন্য পশু পাখিকে আটকে রেখে প্রদর্শন করার পদ্ধতি নিয়ে পশুপ্রেমীরা সওয়াল তুলছেন। জীবনকে তার শিকড় থেকে আলাদা করলে বেঁচে থাকায় সার্থকতা থাকে না। কিন্তু, এসব সওয়াল-জবাবের তোয়াক্কা না করেই প্রতি শীতে রেসকোর্সের উল্টোদিকের ফুটপাত ধরে মানুষের ঢল পৌঁছে যাচ্ছে চিড়িয়াখানায়। বন্য প্রাণীদের সঙ্গে মোলাকাত করার এই তো সুযোগ। কেউ শিম্পাঞ্জিকে ছোলা খাওয়াচ্ছেন, কোনো শিশু বাঘিনীর গর্জন শুনে ভয় পাচ্ছেন, কেউ আবার লম্বা গলার জিরাফকে ক্যামেরাবন্দি করতে নাজেহাল। তারপর, সারাদিনের আনন্দ উত্তেজনায় ক্লান্ত হয়ে সন্ধেবেলা যে যার মতো ফিরতি পথ ধরেছে।

 

More Articles