সেতুর পর সেতু, বাড়িঘর ভাসিয়েও ফুঁসছে তিস্তা! কোন ভুলের মাশুল দিচ্ছে সিকিম?
Sikkim Flood: এই মুহূর্তে সিকিমে আটকে বাংলার অন্তত ২ হাজার পর্যটক। শিলিগুড়ি-কালিম্পং-সিকিমের বিকল্প পথেও ধস নামায় বন্ধ ফেরার সমস্ত পথ।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় না প্রকৃতির প্রতিশোধ! সিকিম বিপর্যয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে কেদারনাথের ছায়া। মঙ্গলবার থেকেই প্রবল বৃষ্টি, মধ্যরাতে আচমকা ভাঙে মেঘ। হ্রদ ফাটিয়ে নামে হড়পা বান। বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করে তিস্তা নদী। ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে সেতু, ভেসে গিয়েছে জাতীয় সড়ক। হিমালয়ের কোলের বিস্তীর্ণ এলাকা কার্যত যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। বিপাকে পড়েছেন বাসিন্দারা, বিপাকে পড়েছেন সিকিমে ঘুরতে আসা হাজার হাজার পর্যটক।
সামনেই পুজো। অনেকেই হয়তো পুজোর ছুটিতে সিকিমে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। টিকিট, হোটেল সবই হয়তো সারা হয়ে গিয়েছে। তবে প্রকৃতি বড় বালাই। ছোটখাটো ধস, হড়পা বান- একরকম। তবে এবার যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সিকিম, সেই দুর্ঘটনার সঙ্গে অনেকেই তুলনা করেছেন কেদারনাথ বিপর্যয়ের। মঙ্গলবার রাত থেকেই ভয়ঙ্কর বৃষ্টি শুরু হয়েছে সিকিম সংলগ্ন একাধিক এলাকায়। ভোররাত নাগাদ উত্তর সিকিমের লোনাক লেকের উপরে মেঘ ভাঙে। শুরু হয় ভয়ঙ্কর বৃষ্টি। সে সময়েই তিস্তার জল বিপদসীমা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিপদসীমা পেরিয়ে যায় নদীর জল। ইতিমধ্যেই একাধিক রাস্তা ভাসিয়ে ফেলেছে সে। ভেসে গিয়েছে সেতুও। কার্যত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে তিস্তা। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে বাড়ি-ঘর-গাছপালা। সিকিমের চাংথামে ভেঙে পড়েছে লেক। সেই জল গিয়ে পড়েছে তিস্তায়। জলের চাপ সামলাতে তিস্তা থেকে ছাড়া হয়েছে ৩৪৮৪ কিউসেক জল। অন্তত আট থেকে ন'টি সেতু ভাসিয়ে নিয়েছে ভয়াবহ বন্যা।
আরও পড়ুন: মেঘ ভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বান! বিপর্যস্ত সিকিমে বাড়ছে মৃত্যু, খোঁজ নেই ২৩ সেনাজওয়ানের
ভয়াবহ বিপর্যয়ে ভেসে গিয়েছে সিকিমের উঁচু এলাকাও। সবদিক থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চাংথাম। পাশাপাশি মাঙ্গান জেলারও একই অবস্থা। শুধু সিকিমই নয়, শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং ও দার্জিলিং যাওয়ার বিকল্প রাস্তাও ভেসেছে তিস্তার জলে। মঙ্গলবার রাত থেকেই হু হু করে জল বাড়তে শুরু করে। একটা সময় প্রায় দোতলা বাড়ির সমান হয়ে যায়। ক্ষতি হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের। হাইড্রো ড্য়াম থেকে জল ছাড়ার কারণে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিকিমের বিস্তীর্ণ অংশ। জানা গিয়েছে, সিকিমের ১২০০ মেগাওয়াটের মেগা তিস্তা তৃতীয় স্টেজের হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে এই বাঁধটি। যার উচ্চতা প্রায় ৮১৭ মিটার। তবে প্রবল বৃষ্টির ফলে সেই হাইড্রো রিজার্ভার থেকেও ৫.০৮ মিলিয়ন কিউবিক মিটার জল। যার ফলে ভেসে গিয়েছে সিকিম ও উত্তপবঙ্গের একাধিক এলাকা।
Terrible footages coming out of #Sikkim of the 1200 MW #ChungthangDam being breached.
— kaustubh (@kaustubhdeka) October 4, 2023
Precisely why many have warned about the #Himalayan zone not being suitable for big dams & heavy #infrastructure. But a certain model of 'development' burries such cautions, putting all at risk! pic.twitter.com/U7Y8vgiIlr
তিস্তার স্রোতে ভেসে আসছে একাধিক মৃতদেহ। মেখলিগঞ্জের তিস্তার ফকতের চর, ৭২ নিজতরফ চরের মতো এলাকাগুলিতে উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। গৃহপালিত পশু-সহ উচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় শতাধিক পরিবার। মাথাভাঙা ১ ব্লকের কেদারহাট এলাকায় জল বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাইড বাঁধ। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মেরামতির কাজও শুরু হয়ে দিয়েছে সেচ দফতর। মেরামতির কাজে হাত লাগিয়েছেন বাসিন্দারাও। এমনকী তিস্তা নদীর উপর যানচলাচলের উপরেও বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করেছে প্রশাসন। কারণ জলস্তর বেড়ে ইতিমধ্যেই সেতু ছুঁই ছুঁই।
National Highway 10 washed away at Melli#Teesta #Sikkim #DamBurst pic.twitter.com/WoYHinlVLS
— The Darjeeling Chronicle (@TheDarjChron) October 4, 2023
এরই মধ্যে আবার শিলিগুড়ি-কালিম্পং-সিকিমের বিকল্প পথেও নেমেছে নতুন করে ধস। ধস নেমেছে কাটারাতেও। এই পথ ধরেই রেনক হয়ে সিকিম যাওয়া যায়। সেই বিকল্প পথেও ধস নামায় আটকে পড়েছেন পর্যটকেরা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কোনও সময় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে জলপাইগুড়িও। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে সিকিমে আটকে বাংলার অন্তত ২ হাজার পর্যটক। এদিকে তিস্তার জল ভাসিয়ে দিয়েছে জাতীয় সড়কের একাংশ। ফলে ওই রাস্তা বন্ধ। বন্ধ পর্যটকদের ফেরার পথ। রাজ্যের তরফে সিকিম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। বাংলার তরফেও চলছে উদ্ধারের চেষ্টা। এই বিপর্যয়ে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকিয়ং, গ্যাংটক, নামচি এবং মঙ্গন জেলা। ভেসে গিয়েছে বহু সেতু। জলমগ্ন বাড়িঘর। কিছু জায়গায় জলের তোড়ে সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছে বড় বড় বিল্ডিং। কাদাস্রোতের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে বহু বসতি, রাস্তাঘাট, সেনাছাউনি। এই সব কটি জায়গাতেই পর্যটকদের ভিড়। এখনও পর্যন্ত কত লোক এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বলি ঠাওর করা যাচ্ছে না। আগামী ৮ অক্টোবর পর্যন্ত পাকিয়ং, গ্যাংটক, নামচি এবং মঙ্গনের সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চালু করা হয়েছে একাধিক জরুরি পরিষেবার নম্বর। জলপাইগুড়ির সমস্ত স্কুল বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক।
আরও পড়ুন:পুজোর বাজার মাটি, ছোট ব্যবসায়ীদের চরম দুর্ভোগ, কবে থামবে বৃষ্টি?
সিকিমে আটকে পড়া পর্যটকদের নিয়ে উদ্বেগে রাজ্য প্রশাসন। ঠিক কত জন পর্যটক কোথায় কোথায় আটকে রয়েছেন, তা এখনও আঁচ করা যাচ্ছে না। সিকিম ও উত্তরবঙ্গের এই সংকটে কার্যত উত্তরাখণ্ডের ছায়াই দেখতে পাচ্ছেন পরিবেশবিদদের একাংশ। সিকিম, দার্জিলিং বা কালিম্পংয়ের মতো পর্যটনস্থলগুলিতে মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়ছে নগরায়ন। তার উপর অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়েছে নদীগুলির উপরে বাঁধ দেওয়ার প্রবণতা। যার ফলই ভুগছে সামগ্রিক উত্তরবঙ্গ। পরিবেশ নষ্ট করে নগর গড়ে ওঠার মাশুল বোধহয় এভাবে বুঝে নিচ্ছে প্রকৃতি। যেমনটা ঘটেছে কেদারনাথে, যেমনটা ঘটছে হিমাচলে, এবার সেই খাতায় নাম লেখাল উত্তরবঙ্গ ও সিকিমও।