ভেলানকান্নি মাতা ও বড়দিনের প্রসাদি
Our Lady of Vailankanni: মা মেরি স্বয়ং এসেছেন ভেলানকান্নিতে। তৈরি হল ‘আওয়ার লেডি অব ভেলানকান্নি’ চার্চ। তবে মা মেরির পরিচিত সাদা গাউনের বদলে এখানে তিনি পরে থাকেন সোনালি শাড়ি। কোলে বালক যিশু।
তামিলনাডুর সমুদ্রপাড়ে ছোট্ট এক শহর নাগাপাত্তিনাম। শান্ত শহরের মানুষ চাষাবাদ, মৎস বিক্রি আর পশুপালন করে জীবন কাটাচ্ছিল। এ শহরে বড়দিনের আগে (নাগাপাত্তিনামে তখনই বেশ কয়েকঘর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের বসবাস ছিল, কাজেই বড়দিন পালনে অবাক হওয়ার কিছু নেই) দুধ ফেরি করে ক্লান্ত এক গোয়ালা বালক গাছের তলায় সবে একটু জিরোতে বসেছে। শীতের আলসেমিতে ঢু্লুনি এসেছে আর কী! এমন সময় এক শিশুকে কোলে নিয়ে বালকের সামনে এলেন এক মা। তাঁর ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য একটু দুধ চাইলেন। গোয়ালা বালক কিছুতেই 'না' বলতে পারল না। স্নিগ্ধ দেবী প্রতিমার মতো দেখতে এক মা। এরপর যথারীতি বালক গেল তার খদ্দেরের বাড়িতে। ক্ষমা চাইতে যাবে সবে, ওমা! তার পাত্র ভরতি গরম দুধ। একই ঘটনা ঘটল নাগাপাত্তিনামের এক গরিব বিধবার সন্তানের সঙ্গে। সে বেচারা চলতে পারত না বলে এক গাছের তলায় বসে ক্ষীর বিক্রি করছিল। আবার বড়দিনের আগে বাচ্চা কোলে নিয়ে এলেন এক মা। তাকে বললেন, নাগাপাত্তিনামের এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রজনকে একটা খবর দিয়ে আসতে। বালক সাফ জানাল রাস্তা বলে দিতে পারলেও সে ভদ্রজনের বাড়ি যেতে অপারগ। সে চলতে পারে না। এরপর সেই আন্নাই তাকে বললেন উঠে দাঁড়াতে। বালকের পায়ের অসুখ ঠিক হয়ে গেল। একছুটে সে গেল সেই ভদ্রজনের বাড়ি। মা মেরি স্বয়ং এসেছেন ভেলানকান্নিতে। তৈরি হল ‘আওয়ার লেডি অব ভেলানকান্নি’ চার্চ। তবে মা মেরির পরিচিত সাদা গাউনের বদলে এখানে তিনি পরে থাকেন সোনালি শাড়ি। কোলে বালক যিশু। দিল্লির খান-মার্কেটে রয়েছে একটি ছোট্ট অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান চার্চ। এখানে মা মেরির পরনে নীল কাঞ্জিভরম শাড়ি।
তবে এই শাড়িপরা মা মেরি কী করে এলেন কলকাতায়? 'আওয়ার লেডি অব ভেলানকান্নি’ অন্ন ও সমৃদ্ধির দেবী। ঠিক যেমন বঙ্গদেশের মা লক্ষ্মী। অন্ন ও সমৃদ্ধি। এর চেয়ে বেশি কী-ই বা চাহিদা থাকে এক স্বল্পোন্নত দেশের মায়ের? তাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মা মেরির হাতে থাকে ক্ষুধার পাত্র। তার বালক যিশুর জন্য একটুখানি দুধ প্রার্থনা তার। ৩০ অগাস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর অবধি চলে মা মেরির ‘নভীনা’। ৭ দিনের ফিস্ট। ফিস্ট শেষে প্রার্থনা। আর এই মা মেরির ফিস্ট পালন হয় কলকাতার প্রত্যেকটি চার্চেই। এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলার কথায়, প্রার্থনা সেই একই─‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। কলকাতার পিকনিক গার্ডেনে রয়েছে ‘আওয়ার লেডি অব ভেলানকান্নি’ চার্চ। সেন্ট ইগনেসিয়াস চার্চ, খিদিরপুরেও মা মেরিকে পরানো থাকে এই সোনালি শাড়ি। চার্চে এই সময় মা মেরির অন্য ‘প্রসাদি’র সঙ্গে থাকে মুড়ি। মা মেরির উপাসনায় জ্বলে ধূপকাঠিও। প্রার্থনার সময় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলারা অনেকে মাথায় নেন ওড়নাও। কারণ তারা অনেকেই এখন অভ্যস্ত সালোয়ার কামিজে।
আরও পড়ুন: হাতে সংবিধান, মাথায় হ্যাট || কে এই দলিত দেবী ইংলিশ মাতা
যিশুর কথা জানার আগে একটু জেনে নিতে হবে কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ইতিহাসের কথা। ব্রিটিশ পিতা ও ভারতীয় নারীর সন্তানেরাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। Younger তাদের বলেছেন “The Neglected Children of British Raj”। উপনিবেশিকতার অজস্র সন্তানের মধ্যে একদল হল এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। ১৭৭২ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ব্রিটিশ সৈনিক ও ভদ্রজনেরা অনেকসময়ই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন ভারতীয় মহিলাদের সঙ্গে। বেশিরভাগই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। তবে বাদামি বউ ও সন্তানদের কোনোদিনই ইংল্যান্ড নিয়ে যেতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না সাদা সাহেবরা।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা রয়ে গেল এই ‘হাফ অ্যান্ড হাফ’ অবস্থাতেই। আবার কলকাতার বাঙালি ভদ্রলোকেরা কিছুতেই ভালো চোখে দেখলেন না ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের রেখে যাওয়া সন্তানদের। আমাদের মনে আছে, সত্যজিৎ রায়ের 'মহানগর' সিনেমায় এডিথ সিমন্স নামে অ্যাংলো মহিলার সঙ্গে বাঙালি ভদ্রমহিলার বন্ধুত্ব নিয়ে তার পরিবারের বিরক্তির কথা। কলকাতার সিনেমা, সমাজ ও সাহিত্যে কোনওদিনই ভালো চোখে দেখা হল না অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলাদের। বাঙালি সমাজ মেনে না নেওয়ায় ব্রিটিশদের সঙ্গেই চলে যেতে রাজি ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। সে দেশেও মিলল না প্রবেশাধিকার। “I terribly miss the lost white glory. I believe I am the white.” অনেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানই নিজেদের 'হোয়াইট' ভাবতে ভালোবাসে।
এই কারণেই হয়তো কলকাতায় সাদা যিশুর সামাজিক নির্মাণ। মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত যিশুর গায়ের রং কেন সাদা? আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষরা উপাসনা করে বাদামি যিশুর। সারা পৃথিবী জুড়ে অ-ইউরোপিয় মানুষদের মধ্যে বাদামি যিশুর উপাসনার প্রচলন থাকলেও কলকাতার যিশু কেন রয়ে গেলেন সাদা? অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজের ইতিহাস ঘাঁটলে খানিকটা আন্দাজ করা যায়। ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ায় খুব বেশি সুবিধা হল না তাদের। অনেকেই কাজ হারাল। আর উপনিবেশবাদের বর্জ্য হিসাবে বাঙালি সমাজ তাদের দূরেই ঠেলে রাখল। "The Britishers were more disciplined. People were safe in their time. Its better for us to get them back.” তাই তারা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইল সেই 'লস্ট হোয়াইট গ্লোরি'ই।
তবে তফাৎ আছে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয় যিশুর মূর্তিতে। কলকাতার যিশুর মূর্তির পাশে প্রায়ই দেখা যায় শেফার্ড বা পশুপালক রাখালদের সঙ্গে মেষশাবক। থাকে ছোট ছোট মেষশাবক ও রাখালের পুতুল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যিশুর উপাসনা অনেকটাই 'পেগান' উপাসনা পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত। ক্রিসমাসের সময় বো ব্যারাকের প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যায় হাতে বানানো টুটি-ফ্রুটি বা রেসিন কেক। কেক আর বাড়িতে বানানো ওয়াইন দিয়েই চলে অতিথি আপ্যায়ন। ডিসেম্বরের রোদে কলকাতার নিউমার্কেট বড় রঙিন হয়ে থাকে। কাচের বয়ামে আমন্ড, শুকনো কিসমিস, চেরির টুকরো আর লাল-সবুজ ক্যান্ডি।
আরও পড়ুন: যন্ত্রণা দিয়ে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, তবুও কেন ‘গুড ফ্রাইডে’ বলা হয় এই দিনটিকে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল এই বো ব্যারাক কলোনি। কিন্তু ব্রিটিশ সেনা থেকে যায় 'ফোর্ট উইলিয়ামে'ই। তারপর এই বো ব্যারাকে থাকতে আসে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা─যারা ব্রিটিশ কর্মস্রোতের অন্যতম অংশ। লাল ইটের তৈরি বাড়িতে এখনও দেখা যায় সবুজ ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। বড়দিনের আগমন এখানে সহজ ও নম্র। সবই ঘরোয়া আয়োজন। ক্রিসমাসের দিন সকাল থেকে বাজে ক্রিসমাস ক্যারোল। তারপর 'মাস'। ভাষার সংমিশ্রণে সুর বরাবরই সুমধুর হয়। তাই তো ক্রিসমাসের প্রার্থনায় মাঝে মধ্যে মিশে যায় স্থানীয় ডায়ালেক্ট। লাল বেলুন আর ক্রিসমাস বেল-এ সেজে ওঠে পুরনো কলকাতার ক্ষয় লাগা অ্যাংলো পাড়া। মলিন সুরে বাজে বব ডিলান বা এলভিস! ক্রিসমাসে তৈরি হয় ঝাল ফ্রেজি, পর্ক ভিন্দালু ও সল্টেড বীফ। প্রতিটি রান্নাতেই ভীষণভাবে প্রাধান্য থাকে ভারতীয় মশলার। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মিষ্টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'কুল কুল' এবং 'রোস কুকি'।
সম্প্রতি পার্ক স্ট্রিট ও রিপন স্ট্রিটের বড় বড় আবাসন ভেঙে তৈরি হয়েছে অফিস পাড়া। তাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা সরে আসতে বাধ্য হয়েছে তালতলা বা পিকনিক গার্ডেনে। নতুন কিছু চার্চও হয়েছে এই এলাকায়। পিকনিক গার্ডেনের তাদের নিজেদেরই দেওয়া নাম ‘লিটল অস্ট্রেলিয়া’। আবার তফাৎ আছে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আর ‘বাঙালি ক্রিস্টান'দের মধ্যে। অনেকক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা তাদের চার্চ। আলাদা উপাসনা পদ্ধতি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ধর্মমতে আবশ্যিক ভাবে হতে হয় রোমান ক্যাথলিক। বাঙালি ক্রিস্টানদের আছে আরও আলাদা আলাদা ধর্মমত।
তবে এই শাড়ি পরা মাদার মেরির আবির্ভাবের কারণ কী? অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সামাজ-স্রোতকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে কর্মঠ অ্যাংলো মহিলারা। আমার চেনাজানা প্রায় প্রতিটি অ্যাংলো বাড়ির মহিলারা প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে কর্মরতা। ব্রিটিশ কলকাতায় অ্যাংলো পুরুষেরা কাজ করেছে রেলওয়ে কলোনিতে, জাহাজ ব্যবসায় আর ডকে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর একে একে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে জাহাজ জেটি ও ডক। বাঙালির একচেটিয়া রাজত্বে অনেক অফিস থেকেও বিতাড়িত অ্যাংলো পুরুষরা। কাজের জন্য বেরোতে হয় মহিলাদের। এক মহিলার কথায়, তার প্রিয় পোশাক স্কার্ট-টপ হলেও তিনি ডালহাউসিতে অফিসে কাজ করার সময় শাড়ি ছিল বাধ্যতামূলক। এক ৭৩ বছর বয়সি অ্যাংলো মহিলা আবার জানিয়েছেন তার রিকশায় চেপে যাওয়ার কথা। পিকনিক গার্ডেনে বাড়ি থেকে চার্চে যাওয়ার সময় 'বুড়ি অ্যাংলো' ফ্রক পরে ঘুরলে সবাই হাসাহাসি করে। প্রায়ই কথা শুনতে হয় এই নিয়ে। তাই তিনি শুরু করেছেন শাড়ি পরা। সংস্কৃতি বহমান হয় তার আশপাশের অনুষঙ্গ নিয়েই। ঈশ্বরের কল্পনা আর কী? নিজের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে মিললে তবেই তো কাছের হয়ে ওঠেন সেই ঈশ্বর। অ্যাংলো যিশুর পোশাকেও তাই অনেকটা ভারতীয়করণের ছাপ।
আরও পড়ুন: ‘খ্রিস্ট’ : ঈশ্বর নয়, রোমানদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যিশুর প্রতিবাদের কাহিনি
এই ছন্দ ও ছন্দপতন নিয়েই কলকাতার যিশু। তিনি বেঁচে আছেন লাল বাড়ির নোনা দেওয়ালে, ধূপবাতি জ্বালিয়ে অ্যাংলো মহিলার প্রার্থনায়, নাহুমস-এর কেকে। স্থানীয় ডায়ালেক্টে ক্রিসমাস ক্যারোল এই সর্বমঙ্গলময় প্রভুরই প্রার্থনার কথা। যা উপনিবেশ-সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব পেরিয়ে, সাদা ও বাদামি চামড়ার বিবাদ পেরিয়ে এক মানব-ঈশ্বর। চিরকালের ক্লান্ত, অসহায় সাধারণ মানুষের ঈশ্বর। কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জিসাসের মানব উপাসনা।