রণক্ষেত্রে যেমন করে দিন কাটছে ইজরায়েলের বাসিন্দা ও অভিবাসীদের

Israel Palestine Conflict: রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়াদের প্রাণ যাওয়াটাই দস্তুর। আগেও সেই লড়াইয়ে প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য নিরপরাধ বাসিন্দার। সাম্প্রতিক এই লড়াইয়ে ফের সবচেয়ে বড় বলি তাঁরাই।

তখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি শহরটার।  সকাল হতে না হতে ফের বেজে উঠল সাইরেন। ততক্ষণে বাসিন্দা থেকে অভিবাসী, সকলেই জানেন, সাইরেন বাজলে কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজতে হয়। প্রাণপনে সেদিকে ছুট লাগাচ্ছেন বাসিন্দারা। আতঙ্কে সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। ৭ তারিখ সকাল সাতটা থেকে ধেয়ে আসতে থাকে শহরটার দিকে একের পর এক রকেট। যাকে আটকাতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে সমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ব্যর্থ হয়েছে আয়রন ডোম। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেশের এদিক-ওদিক দিয়ে ঢুকতে শুরু করে হামাস জঙ্গিরা। নির্বিচারে চালাতে থাকে গুলি। পথে জমতে থাকে লাশ। তার পরেও যারা হামাসদের গুলি বোমা বা অপহরণের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে, তাঁদের জন্য এখন প্রতিটা সকাল এখন নতুন লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই।

ঘুমচোখেই সেদিন দৌড়তে শুরু করেছিলেন তাঁরা আশ্রয়গুলির দিকে। আদৌ আপনি বাঁচবেন না যে কোনও মুহূর্তে আপনাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়ে চলে যাবে কোনও রকেট বা ধেয়ে আসা গুলি, তা অনেকটাই নির্ভর করছে আপনার অবস্থানের উপরে। কোথায় থাকেন আপনি! ইজরায়েল-গাজা সীমান্তের যত কাছে আপনি, আপনার মৃত্যুভয় তত বেশি। তত রকেট ধেয়ে আসার ভয়। যে কোনও সময় হামাস জঙ্গিদের দল এসে যে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে না বা পণবন্দি করে রাখবে না, গুলিতে বুক চিরে দেবে না, সেই নিশ্চয়তা ঠিক ততটাই কম।

আরও পড়ুন: বন্ধ বিদ্যুৎ, জল, নির্বিচারে মরছে শিশুরা! প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের পাল্টা হামলার ফল কী?

ইজরায়েলের ওয়েইজমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে কাজ করেন ভারতের বাসিন্দা রাহুল (নাম পরিবর্তিত)। থাকেন রেহভট এলাকায়। গাজা সীমান্ত থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার। ক্ষণে ক্ষণে সাইরেন বেজে উঠছে। এ সাইরেনের শব্দই যেন মৃত্যুভয়কে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। প্রতিটা সাইরেন বেজে বেজে যেন বলে চলেছে, হাতে সময় নেই। প্রাণ রাখতে হলে ছুটতে হবে, প্রাণপন ছুটতে হবে। তখনও কি জানতেন রাহুলরা যে আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই এলাকাটাই রূপ নেবে ভয়ঙ্কর রণক্ষেত্রের। বিস্ফোরণের ধোঁয়ার ঢাকবে আকাশ। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে মৃতদেহের ভিড়। কোনও মতে টিকে গিয়েছেন রাহুল, আর রাহুলের মতো জনাকয়েক ভাগ্যবান। কিন্তু সেই ভাগ্য কতক্ষণ সঙ্গ দেবে বলা কঠিন। ইতিমধ্যেই ইজরায়েলে মৃতের সংখ্যা আটশো ছাড়িয়েছে। আর সে কথা তো বলছে সরকারি হিসেব। বেসরকারি হিসেবে সেই মৃত্য়ুর সংখ্যা যে কত, তা বলা কঠিন।

Civilians are paying the terrible price of the conflict in Israel and Palestine

শনিবারের শান্ত সকালের বুক চিরে নেমে এসেছিল রকেট। রাহুল যেখানে থাকেন, তার চেয়ে এক কিলোমিটারও নয় জায়গাটা। মুহূর্তে উড়ে যায় একটা গাড়ি। অল্পের জন্য প্রাণ যায়নি কারওর। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাহুল কাজ করেন, তাকে এখন দেখে কলেজ ভাবতে কষ্ট হয়। এই মৃত্যুর উপত্যকা দেখে শিউড়ে উঠছেন বাসিন্দারা।

এখনও পর্যন্ত খাবারদাবার, প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে ইজরায়েলে। কিন্তু কতদিন! সকলেই জানে, দু'দেশের যুদ্ধ মানেই খাবার-দাবার শস্যে টান, ক্রমে দুর্ভীক্ষের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর সেদিকেই ক্রমশ হাঁটছে ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে সতর্ক করা হয়েছে, এই যুদ্ধে খাদ্যসমস্যার মুখে পড়তে পারে দেশ। শনিবার প্যালেস্টাইন থেকে ধেয়ে আসা আঘাতের প্রত্যুত্তরে অস্ত্র শানিয়েছে ইজরায়েলও। ইতিমধ্যেই গাজায় আকাশপথে হামলা করেছে নেতানিয়াহুর সেনা। এদিকে হামাস সেনা হুঁশিয়ারি দিয়ে রেথেছে, ইজরায়েলের দিক থেকে একটাও রকেট প্যালেস্টাইনের দিকে গেলে সমস্ত বন্দিদের ধরে ধরে হত্যা করবে তারা। বন্দি হত্যা কি করেনি তারা! একাধিক ভিডিও, ছবিতে দেখা যাচ্ছে লাশের পাহাড়। রাস্তায় কাগজের খোলার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মৃতদেহ। পাশে হামাস সেনার উল্লাস।

Israel,  Palestine, Israel Palestine Conflict, Israel Palestine war, Civilians death, Death, Israel-Hamas war, Hamas, Hamas attack, Gaza border,

আশার কথা একটাই, ইজরায়েল তার ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্র ফেরৎ পেয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আর কোনও নতুন করে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা নেই। তবে হামাস যেভাবে শনিবার ঢুকেছিল ইজরায়েলে, তাতে পুরোপুরি নিশ্চিন্তও হতে পারছে না দেশের বাসিন্দারা। ফলে এখনও তাঁরা ভয়ঙ্কর রকমের আতঙ্কিত। ভয়াবহ যুদ্ধের ভয়, প্রাণ যাওয়ার ভয়, গৃহহীন হওয়ার ভয়, শরণার্থী হয়ে যাওয়ার ভয়, সমস্ত রকম ত্রাস সব দিক থেকে চেপে ধরেছে তাঁদের।

এদিকে, সময় যত এগোচ্ছে, ততই বাড়ছে ইজরায়েলের তরফে প্যালেস্টাইনে আঘাত হানার সম্ভাবনা। জানা গিয়েছে, গাজা উপত্যকায় টানা অভিযান চালাতে পারে ইজরায়েলি সেনা। এদিকে, ইজরায়েল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু অভিবাসীরা। পড়াশোনার জন্যে, কেউ চাকরিবাকরির কারণে সেখানে থাকেন। বাসিন্দাদের পাশাপাশি বিপদে পড়েছেন তাঁরাও। সেইসব অভিবাসীদের মধ্যে রয়েছে রাহুলের মতোই বহু ভারতীয়ই। ইতিমধ্যেই ভারতীয় দূতাবাসের তরফে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কীভাবে তাঁদের নিরাপদে দেশে ফেরানো যায়, শুরু হয়েছে সেই চেষ্টাও।

আরও পড়ুন:নকল বাসিন্দা সাজিয়ে সীমান্তে হত্যার মহড়া! যে ভাবে তিলে তিলে ইজরায়েলে হামলার ছক কষে হামাস

ভূখণ্ডের এই লড়াই বহুদিনের। আগেও সেই লড়াইয়ে প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য নিরপরাধ বাসিন্দার। সাম্প্রতিক এই লড়াইয়ে ফের সবচেয়ে বড় বলি তাঁরাই। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়াদের প্রাণ যাওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু কতদিন! কতদিন কোলাটেরাল ড্যামেজের নামে চলবে এই ধ্বংসলীলা। যারা রাষ্ট্রের প্রধান, তাঁদের শরীরে এইসব যুদ্ধের আঁচটুকু লাগে না। মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে খামোখা মরে যায় আম আদমিরা। ভূখণ্ড পাল্টায়, যুদ্ধের কারণ বদলায়, রাষ্ট্রনেতা পাল্টায়। কিন্তু মরার জন্য সফট টার্গেট-রা কিন্তু পাল্টায় না কোনও খানেই। আর এই বীজসত্য জেনেই অস্ত্র তুলে নেন দেশের মাথারা। কারণ তারা জানেন, বড় বড় যুদ্ধে এমন সব ছোটখাটো বলিদান দিতেই হয়। ওই যাকে বলে কোলাটেরিয়াল ড্যামেজ আর কী!

More Articles