কয়েকটি 'ক্লিক'-এই রোগ নিরাময়! রসায়নে নোবেল এনে দিল যে যুগান্তকারী আবিষ্কার
Nobel in Chemistry: সাড়াজাগানো আবিষ্কারের জন্য তিন গবেষক যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
পাঁচ অক্টোবর ভারতীয় সময় দুপুর সোয়া তিনটে নাগাদ ২০২২ সালের রসায়নে নোবেল পুরষ্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করল 'দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস'। পুরষ্কার পেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ক্যারোলিন বার্তোজি়, ডেনমার্কের ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেনের গবেষক মর্টেন মেলডাল, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর স্ক্রিপস রিসার্চের গবেষক কে. ব্যারি শার্পলেস। 'ক্লিক কেমিস্ট্রি' এবং বায়ো-অর্থোগোনাল কেমিস্ট্রির ওপরে সাড়াজাগানো আবিষ্কারের জন্য এই তিন গবেষক যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
তবে ব্যারি শার্পলেস এই প্রথমবার নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন না। ২০০১ সালে তিনি 'স্টিরিওসিলেক্টিভ রিয়্যাকশন'-এর ওপর কাজ করে প্রথমবার নোবেল পান (এবং সেই বছরেই তিনি 'বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন মেডেল ইন কেমিস্ট্রি' এবং 'উলফ প্রাইজ় ইন কেমিস্ট্রি'-ও পেয়েছিলেন)।
ক্লিক... ক্লিক... ক্লিক... আর তাতেই তৈরি সম্পূর্ণ নতুন মৌল!
৫ অক্টোবর নোবেল পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করার সময় 'দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস'-এর সাধারণ সচিব ড. হন্স এলেগ্রিয়ান জানান, "অণু নির্মাণের স্বার্থে তৈরি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির জন্য এই বছর রসায়নে নোবেল দেওয়া হচ্ছে।" 'ক্লিক কেমিস্ট্রি' এবং বায়ো-অর্থোগোনাল কেমিস্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ঠিক সেরকম হাতিয়ার বা 'ইঞ্জিনিয়ারিং টুল'।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় মাউসে 'ক্লিক' করতেই মনে পড়ল 'ক্লিক কেমিস্ট্রি' নাম কেন হলো, বলা দরকার। নোবেল কমিটি ফর কেমিস্ট্রি-র সভাপতি ইওভান অকভিস্ট এইদিন নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়ে জানান, "ক্লিক কেমিস্ট্রি বিষয়টা সেরকমই, খানিকটা যেভাবে 'ক্লিক' শব্দটা হয়। দুটো অণুকে খুব সহজে জোড়া লাগানোর মতো। যেন দু'টি chemical buckle-কে জোড়া লাগানো হচ্ছে।" এইভাবেই ছোট ছোট কেমিক্যাল বাকল-কে জুড়তে জুড়তে অনেক বড় এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৌল বানানো যেতে পারে, জানাচ্ছেন তিনি।
রসায়নের একটি কার্যকর অংশ এই ক্লিক কেমিস্ট্রি। যেখানে একাধিক আণবিক গঠনগত অংশ পরস্পরের সঙ্গে খুব সহজে জোড়া লাগে। তবে শুধু সহজে জোড়া লাগলেই হবে না, সহজে যাতে তাদের রাসায়নিক বন্ধন না ভেঙে যায়। তাই তাদের মাঝে ঠিকমতো বাঁধুনি তৈরি করাও ক্লিক কেমিস্ট্রির একটি অংশ।
ক্লিক কেমিস্ট্রির এই মূল ধারণা ব্যারি শার্পলেসের মাথায় কুড়ি বছর আগেই এসেছিল। ক্লিক কেমিস্ট্রি এই মুহূর্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজেও লাগানো হয়। তবে অভাব ছিল উপযুক্ত কেমিক্যাল বাকলের। যে কেমিক্যাল বাকলগুলি সহজে পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগতে পারবে।
ব্যারি শার্পলেস এবং মর্টেন মেলডাল ক্লিক কেমিস্ট্রি নিয়ে কাজ করছেন বহুদিন যাবৎ। দীর্ঘদিন যাবৎ আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে তাঁরা অবশেষে উপযুক্ত সেই কেমিক্যাল বাকল খুঁজে পেয়েছেন, যারা সহজেই পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগতে পারে। আর সেই উপযুক্ত দু'টি মৌল হলো অ্যাজা়ইড এবং অ্যালকাইন। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই দু'টি মৌল (পড়ুন কেমিক্যাল বাকল) নির্দিষ্টভাবে কেবল পরস্পরের সঙ্গেই জোড়া লাগবে।
তবে এখানে রয়েছে একটি সমস্যা। অ্যাজা়ইড এবং অ্যালকাইন বিক্রিয়া করলে একাধিক বাই-প্রোডাক্ট তৈরি হয়। এবং বিক্রিয়াও ঠিকভাবে হয় না। তাই তামা বা কপারের উপস্থিতিতে এই বিক্রিয়া তাঁরা সফল করেন। পাশাপাশি প্রমাণ করেন সামান্য তামার উপস্থিতিতে বিক্রিয়ার গতি কেবল বাড়েই না, বিক্রিয়ার শেষে কেবল কাঙ্ক্ষিত মৌল ট্রায়াজো়ল-ই (Triazole) তৈরি হয়।
বায়ো-অর্থোগোনাল কেমিস্ট্রি কী?
ক্যারোলিন খুঁজে বের করল এমন একটি ক্লিক রিয়্যাকশনের পদ্ধতি, যা জীবন্ত কোশের ওপর কুপ্রভাব ফেলবে না বা জীবন্ত কোশের ভেতরকার পরিবেশ তাকে প্রভাবিত করবে না। ক্যারোলিন এই পদ্ধতিকে নাম দিলেন, বায়ো-অর্থগোনাল কেমিস্ট্রি।
আরও বিস্তারিতভাবে বলা যাক। অ্যাজা়ইড এবং অ্যালকাইনের বিক্রিয়া সফল করতে তামার প্রয়োজন। কিন্তু বিক্রিয়ার জন্য যে পরিমাণ তামা প্রয়োজন, তা জীবন্ত কোশের জন্যে ক্ষতিকর।
ছবিতে ক্যারোলিন বার্তোজি়
তামা বা কোনও অণুঘটকের ওপর নির্ভর না করে কীভাবে ক্লিক কেমিস্ট্রি-কে সফল করা যায়, ক্যারোলিন তা পরীক্ষা করে দেখছিলেন নয়ের দশক থেকেই। এবং অবশেষে জীবন্ত কোশের মধ্যেই তিনি ক্লিক কেমিস্ট্রি সফল করে দেখান। শুধু তাই নয়, তিনি দেখালেন ক্লিক কেমিস্ট্রি জীবন্ত কোশকে প্রভাবিত করবে না এবং জীবন্ত কোশের নিজস্ব পরিবেশের কারণেও বিক্রিয়া প্রভাবিত হবে না।
এই বিক্রিয়াটি সফল করার জন্য ক্যারোলিন মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্য নিয়েছিলেন। মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি পদ্ধতি, যার সাহায্যে শরীরের বিভিন্ন জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে শরীরে নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়িয়ে তোলা।
এই গবেষণা মানুষের কল্যাণে কতটা সাহায্য করবে?
ইওভান অকভিস্ট সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, ক্লিক কেমিস্ট্রির সাহায্যে নতুন একাধিক রোগ নিরাময়ের ওষুধ বানানো যাবে। বানানো যাবে বিভিন্ন ধরনের পলিমার। ক্লিক কেমিস্ট্রি ইতিমধ্যেই ডিএনএ ম্যাপিং, রোগ নির্ণয়ে বিপুলভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
কিংবা ধরা যাক, কোশের মধ্যে নির্দিষ্ট ধরনের রাসায়নিকের উপস্থিতি এবং অবস্থান জানতে হবে। রোগ-ব্যধির চিকিৎসার সময় ভীষণভাবে এই বিষয়গুলি জানার প্রয়োজন পড়ে। তাদের অবস্থান জানতে তাদের দাগিয়ে দেওয়া বা 'মার্ক' করা সবার আগে প্রয়োজন। যাদের দাগিয়ে দেওয়ার জন্য আবার বিভিন্ন চকচকে অণু (ফ্ল্যুরোসেন্ট মলিকিউল) ব্যবহার করা হয়। আর তখনই কাজে লাগে ক্লিক কেমিস্ট্রি- যার ফলে ওই চকচকে অণুটি আরেকটি অণুর সঙ্গে জোড়া লাগতে পারে।
দ্বিতীয় এই কাজটি করে দেখিয়েছেন ক্যারোলিন।
১ম ছবিতে জীবন্ত কোশের পর্দায় আটকে থাকা গ্লাইকেনে আবদ্ধ হচ্ছে চকচকে মলিকিউল। সেখানেও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে ক্লিক কেমিস্ট্রির। দ্বিতীয় ছবিতে সেই রকম চকচকে মলিকিউলই কোশের পর্দায় গ্লাইকেনের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিতে লাল রঙ নতুন তৈরি গ্লাইকেনের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। অন্যদিকে পুরনো গ্লাইকেন সবুজ রং ধারণ করেছে চকচকে মলিকিউলের প্রভাবে। প্রথম ছবিটির উৎস নোবেল প্রাইজ় কমিটি। অন্যদিকে দ্বিতীয় ছবিটি PNAS জার্নালে (২০১০) ক্যারোলিন বার্তোজি় এবং তাঁর সহকর্মীদের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ দেহে সরবরাহ (ড্রাগ ডেলিভারি) করার সময়েও প্রয়োজন হতে পারে এই পদ্ধতির। ড্রাগ ডেলিভারির একটি অন্যতম গুণ হলো, শরীরের ঠিক জায়গায় ড্রাগটিকে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু সমস্ত গবেষণার মতো ড্রাগ ডেলিভারির কিছু খামতি আছে। ড্রাগ কিন্তু টার্গেট অর্গ্যান, অর্থাৎ ঠিক যে অংশে পাঠাতে চাইছি, সেই অংশ ছাড়াও অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এবং তা কেবল অনাবশ্যকই নয়, বেশ কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই অবাঞ্ছিত এবং ক্ষতিকরও। আর সেজন্যই ড্রাগ ডেলিভারির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো শরীর বা কোশের মধ্যে ড্রাগ সঠিক পথে, সঠিক জায়গায় পৌঁছচ্ছে কি না, তা নজরে রাখা। আর সেখানেই ড্রাগের সঙ্গে 'মার্ক' করতে হতে পারে 'চকচকে পদার্থ'-কে। যা শরীর বা কোশের মধ্যে ড্রাগের উপস্থিতি আর অবস্থান জানান দেবে। আর তখনই তাদের 'মার্ক' করার জন্য ক্লিক কেমিস্ট্রির আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে।