ভারতীয়দের শরীরে তিলে তিলে বাসা বাঁধছে মারণ রোগ ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি! কে দায় নেবে
প্রকৃতির ধ্বংসলীলা মানেই যে প্রলয় হয়ে যাবে, মেঘ ভেঙে বৃ্ষ্টি হবে, বন্যা হবে-এমনটা নয়। সে ধীরেও আসে। কখনও বিশ্ব উষ্ণায়ন রূপে, কখনও খামখেয়ালি আবহাওয়ার রূপে। কখনও তার নিশ্চুপ হানাদারি দারিদ্রের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের জীবন থেকে এবং দরিদ্র দেশগুলির থেকে। কখনও আবার রোগের প্রকোপও বাড়ছে অজ্ঞাতসারে, আমাদের পাতেও থাবা বসছে।
কিন্তু সমস্যা হল, আপনি-আমি আজ যা দেখছি, সেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে অদূর ভবিষ্যতে আর তার জন্য দায়ী আমরাই। সেই সঙ্কটময়, অনিশ্চিত এক পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়ার দুঃশ্চিন্তা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে জমাট বাঁধছে এখন থেকেই। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই দুঃশ্চিন্তাকে বলা হচ্ছে ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি (Climate Anxiety)। চোখের সামনে তিলেতিলে নিজের বাসের জায়গা ধ্বংস হতে দেখা, দূষণ কিংবা উষ্ণায়ন-জনিত রোগে একের পর এক মানুষকে মরতে দেখা, কিংবা পশুপাখিদের মরতে দেখা, বোধহয় খুব সোজা নয়। আর তাই ছাপ ফেলছে তরুণ প্রজন্মের মনে।
এমনিতেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে খুব সচেতন আপামর জনসাধারণ, তা তো নয়। তা-য় আবার তা যদি মানসিক অসুস্থতার কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের হয় তাহলে তো কথাই নেই। কারণ ইউনিকর্ন থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বলে কিছু হয় আর যেই করুক এখনও বাঙালি বিশ্বাস করে না।
প্রকৃতি যে এই বিধ্বংসী রূপ ধারণ করবে, তা আমাদের অনেক আগেই বলা হয়েছিলো। আমরা কানে কুলুপ এঁটে ছিলাম সেদিন (যদিও পরীক্ষার খাতায় পরিবেশ সংক্রান্ত রচনা লিখে, ভালো নম্বর পেয়ে পাশ-টাশও করেছি আমরা অনেকে), নেতারা আমাদের বিশ্বাস করতে দেননি এই যে এই ব মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। আর তার মাশুল কিন্তু গুনবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্টি হওয়া দাবানল, ঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয় তৈরি করছে তরুণ ও শিশুদের মনে। যারা এই দুর্যোগগুলির পরে কোনো ক্রমে বেঁচে গেছেন, তাঁদের অনেকেই ভুগছে পিটিএসডি (PTSD) বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডারে (Post-traumatic Stress Disorder)। এই মানসিক অসুখ সাধারণত সঙ্কটময় পরিস্থিতি, যেমন যুদ্ধ, হানাহানি, হিংসা প্রভৃতির সম্মুখীন যারা হয়, তাঁদের অনেকের মধ্যে দেখা যায়। ঠিক সেই কারণেই দীর্ঘ ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর পিটিএসডি রোগীদের সংখ্যা বাড়ে বহুগুণ । সম্মুখসমরে লড়ে, যুদ্ধের ভয়াবহতাকে সামনে থেকে দেখতে দেখতে যারা বেঁচে ফেরেন বেশির ভাগই পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হন। এবং তার পরেই পিটিএসডি নিয়ে নড়েচড়ে বসে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা।
দুঃশ্চিন্তা (anxiety), মানসিক অবসাদ (Depression), পুরোনো ভয়াবহতার ইতিহাস মনে পড়লে ভয় পাওয়া, এগুলি পিটিএসডি-র অন্যতম লক্ষণ। আমাদের মতো লেখক-লেখিকা এবং পাঠক-পাঠিকারা আশা করি আঁচ পাচ্ছেন প্রাকৃতিক ভয়াবহতা কী ভাবে পিটিএসডি-এর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু যারা এই ধরনের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থির শিকার সরাসরি হয়নি, তারাও এই গ্রহের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত, তারা চিন্তিত তাদের নিজেরদের ভবিষ্যত এবং নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েও। ক্যালিফোর্নিয়ার হামবোল্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক সারাহ রে ষোলো থেকে পঁচিশ বছর বয়সি ১০,০০০ জনকে নিয়ে একটি সমীক্ষা করেন। পৃথিবীর দশটি দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করে এই সমীক্ষায়, যা থেকে দেখা যায় ৫৯% ছেলেমেয়েই পৃথিবীর ভবিষ্যত নিয়ে প্রবল দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে। মাঝামাঝি রকম দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে ২৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে। আবার দেখা যাচ্ছে এদের মধ্যে পৃথিবীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ৬৮ শতাংশ ভীত, প্রতিনিয়ত দুঃখ পাচ্ছে।
আরও পড়ুন-হাজার বছর ধরে জাগ্রত, বাংলাদেশের যে হিন্দু মন্দিরগুলি এখনও নজর কাড়ে
লজ্জিত হতে হয় ভাবলে এদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ প্রচন্ড ক্ষুব্ধও, আর তার জন্যে দায়ী আমাদের আগের প্রজন্ম, খানিকটা আমরাও। আজকে যুবসমাজের যে অংশ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রকাশ করছে পৃথিবীর ভবিষ্যতের স্বার্থে, তাদের এক বেশিরভাগই দেশের নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ, তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে। ৪৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে তো বলেই দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাদের দৈনন্দিন জীবন কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এদিকে নাইজেরিয়ার তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ প্রবল ভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন দৈনন্দিন জীবনে কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
শুধু কি এখানেই শেষ? সবথেকে বেশি অনিশ্চয়তার মুখোমুখি আদিবাসী জাতি-উপজাতির মানুষরা, যারা পরিবেশের উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকেন। বন্য পশুপাখির পাশাপাশি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন।
তবে কেবল নতুন প্রজন্মই নয়; ক্ষুব্ধ, চিন্তিত, বিষণ্ণ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরাও। অন্তত সায়েন্স কমিউনিকেটর জো ড্যুগান ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল অবধি বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলে সেরকমই জেনেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রচন্ড নিয়ে চরম দুঃশ্চিন্তার মধ্যে যে দেশের ছেলেমেয়েরা রয়েছে তাদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে ফিলিপিন্স, দ্বিতীয় স্থানে ভারত এবং তার পরেই ব্রাজিল। ভারতবর্ষ এই মুহূর্তে দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা বোধহয় অসময়ের বৃষ্টি, ধ্বংসাত্মক সাইক্লোন, আর বাতাসের গুণমান দেখলেই বোঝা যায়। বিশ্ব উষ্ণায়ন কিংবা দূষণের কারণে মৃত্যুর হার কিন্তু প্রান্তিক মানুষের মধ্যে বেশি, আর এখানে পিছিয়ে নেই ভারতবর্ষও। বিশ্বের তাপমাত্রা আর ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে, ভারতে যে ভাবে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হবে তাতে ভারতের জিডিপি ৩ শতাংশ হ্রাস পাবে।
দেখা যাচ্ছে যে সমস্ত দেশে পরিবেশ দূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই দেশগুলিতেই দারিদ্র এবং অশিক্ষা প্রবল, সামাজিক সুরক্ষা সে-সব দেশে তলানিতে ঠেকেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সন্ত্রাসবাদ। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদক অ্যান্টোনিও গুটেরেসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরাক এবং সিরিয়ার কথা, দুই দেশেই জলাভাব প্রবল। অবস্থা আরও প্রকট হচ্ছে জলস্তর যত কমছে এই দুই দেশে। আর এই অবস্থার সুযোগ নিয়েই সন্ত্রাসবাদী দল দায়েশ (বা আই.এস.আই.এল.) জল সরবরাহের উপর নিজেদের ক্ষমতা আরোপ করেছে। এদিকে সোমালিয়ায় চারকোল তৈরির সুবিধা নিচ্ছে সন্ত্রাসবাদী দল আল-শবাব। প্রকৃতি যত সঙ্কটের মুখে পড়বে, দারিদ্র যত বাড়বে, এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর স্বাভাবিক ভাবেই যুবসমাজের একটা বিরাট অংশের ভবিষ্যত আরও অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে যাবে।
এই অবস্থার জন্যে দায়ী যারা, তাদের কিন্তু সেই দিন দেখতে হবে না। ভুগবে জেন ওয়াই, মিলেনিয়াল এবং জেন জি়। এদের বাঁচতে হবে এই দূষিত বায়ু বুকে টেনে, জলাভাবে, খাদ্যাভাবে; পূর্ব প্রজন্মের দায়িত্বহীনতার বোঝা কাঁধে নিয়ে আরও যুদ্ধ এবং আরও মহামারীর সাক্ষী হয়ে। আগের প্রজন্ম এবং ভোট কিনতে আসা জননেতারা কিন্তু মনে রাখবে না এ পৃথিবীকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার তারা কবেই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন।