জলবায়ু পরিবর্তন এবং নিরপরাধ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি
সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছে দেখলাম। সাইমন কোফে, টুভালু দেশের বিদেশমন্ত্রী, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে, ভার্চুয়ালি তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন গ্লাসগোতে চলা কপ 26 সম্মেলনে। টুভালু নামটা অচেনা লাগছে না? লাগার ই কথা। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নয়টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই দেশ। আয়তন শুনবেন? মাত্র পঁচিশ বর্গ কিলোমিটার। আপনি কি এবার বুঝতে পারছেন কেনো ছবি টা ভাইরাল হয়েছে? কেনই বা আমি সেটা নিয়ে কথা বলছি?
আপনি নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও পড়েছেন যে 2050 সালের মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র তিরবর্তী সমস্ত বড় শহর জলের তলায় চলে যেতে পারে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন, এই টুভালুর মত দেশ, যার জনসংখ্যা আপনার বিধানসভা এলাকার দশ ভাগের এক ভাগ, যে দেশ পৃথিবীর সব থেকে ছোট্ট দেশ গুলির একটা, তাদের কপালে ঠিক কী লেখা আছে!
গ্লাসগোতে এই মুহূর্তে চলছে পৃথিবীর ভবিষ্যত নির্ধারণ করার জন্যে এক বিরাট সম্মেলন, যেখানে তাবর তাবর বিশ্বনেতারা ভাষণ দিচ্ছেন, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কার্বন নিঃসরণ কমানোর। সেই নিয়ে আলোচনায় আসবো পরে কোনো লেখায়, আগে আপনাদের এই দ্বীপ গুলির বিষয়ে বলি। মনে হয় বিপদটা আমার, আপনার, আমাদের সবার বোঝার সময় এসে গেছে।
এই টুভালুর মত প্রশান্ত মহাসাগরে অনেক অনেক দ্বীপ আছে, যারা স্বতন্ত্র, দেশ হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু তারা এতটাই ছোটো, যে তাদের নিয়ে বিশেষ কথা হয়না। যেমন কিরিবাতি, বা মার্শাল আইল্যান্ডস। সমুদ্রের জলস্তর এতটাই উঠে এসেছে যে দ্বীপ গুলির অনেক কৃষিজমি আজ নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের সুন্দরবনের মত এদের কোনো জঙ্গলের সুরক্ষাও নেই, যে কারণে সমুদ্র খুব দ্রুতগতিতে এদের গ্রাস করে নিতে পারছে। মার্শাল আইল্যান্ডসের নাম আপনারা একটা কারণে শুনে থাকতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে প্রায় এক ডজন পরমাণু বোমা পরীক্ষা করেছে। এই দ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র 53 হাজার, এবং বিশেষজ্ঞরা বলেই দিয়েছেন, যে হারে জলস্তর বাড়ছে, 2030 সালের মধ্যে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি ম্যাপ থেকে মুছে যেতে চলেছে, এবং এখানকার বাসিন্দাদের তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে হবে।
এই দ্বীপ গুলির ক্ষেত্রে কিন্তু সমুদ্রই সব। তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি বা সংস্কৃতি, সবটাই এই মহাসমুদ্রকে ভীত করে গড়ে উঠেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে পর্যটন, সমুদ্র পরিবহণ, মৎস্য চাষ, এই তিনটি ক্ষেত্র মূলত অর্থনীতির চালক। কিন্তু পরিবেশ দূষণ এবং তার ফলস্বরূপ বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে এই সবকটি ক্ষেত্রই বিপর্যস্ত এবং তার কারণে এই ক্ষুদ্র দেশগুলিতে দরিদ্র বাড়ছে, কমছে সমুদ্রের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষমতা এবং সেই সাথে তারা সম্পূর্ণ ভাবে অন্য দেশের ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।
যত দিন এগোচ্ছে, ততই এই দ্বীপ গুলি থাকার অযোগ্য হয়ে উঠছে, সেই কারণে আরো একটি মারাত্মক চিন্তার বিষয় হল দ্বীপের মানুষদের পুনর্বাসন। টুভালুতে এখন ই বলা হচ্ছে, ওখানের আজকের শিশুরাই হয়তো শেষ প্রজন্ম যারা ওই দেশের মাটিতে বড় হবে। সবাই কে দেশ ছাড়তে হবে, পরিণত হতে হবে "Climate Refugee" তে, অর্থাৎ যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভিটেহারা হবেন। এই এত মানুষ কোথায় যাবেন, কোন দেশ তাদের ঠাঁই দেবে তা এক বিরাট প্রশ্ন হতে চলেছে। কিরিবাতি এবং টুভালু ইতিমধ্যেই তাদের দেশের মানুষের জন্যে ফিজিতে জমি কিনে রেখেছে, যাতে তাদের উদ্বাস্তু না হতে হয়।
ফিজিই বা কিভাবে তাদের আশ্রয় দেবে কে জানে? তারা নিজেরাও তো ভয়ংকর ভাবে আক্রান্ত। 1993 r পর থেকে আজ অবধি প্রায় ছয় মিলিমিটার জলস্তর বেড়ে গিয়েছে, এবং অনেক জমি ইতিমধ্যেই চাষের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে তো ঘূর্ণিঝড় আছেই। গত দুই বছরে চারটি অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় দেখেছে ফিজি, যার জেরে বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের মানুষের জনজীবন, অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
একই অবস্থা আরও এক দ্বীপ সামোয়ার। ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এখানেও বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে ঢেউ এর তীব্রতা। এতটাই যে, অনেক ক্ষেত্রেই তা এক ফুটবল মাঠকে নদীতে পরিনত করে ফেলেছে। কৃষিজমির কথা আর নতুন করে বলছিই না। পাপুয়া নিউ গিনি, ভানুয়াতুতেও এক ই অবস্থা। কোথাও একটু কম, কোথাও একটু বেশি।
সেই সাথে উল্লেখ করি এই দ্বীপ গুলির প্রবাল প্রাচীরের কথা, যেগুলি আজ মৃত। যা আরও এক চিন্তার বিষয়, কারণ প্রবাল প্রাচীর মৃত মানে সমুদ্রের নিচের বাস্তুতন্ত্রও বিপজ্জনক ভাবে আক্রান্ত।
আরো একটি বিষয় যা খুবই উদ্বেগজনক, তা হলো এই বাড়তে থাকা জলস্তরের সাথে আন্তর্জাতিক জলসীমা এবং এই দ্বীপ রাষ্ট্র গুলির সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। নিয়ম অনুযায়ী, একটি দেশের জলসীমা তার দেশের সীমানা থেকে দুশো ন্যটিকাল মাইল পর্যন্ত ধরা হয়। এই ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির অর্থনীতি অনেকটাই এই জলসীমার ওপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে। এই এলাকা গুলিকে "Exclusive Economic Zone" বলা হয়ে থাকে। জলস্তর বাড়লে সেই সীমানা কমতে থাকবে খুব স্বাভাবিকভাবেই, এবং সেই সাথে জমি যতো কমবে তত এই দ্বীপ রাষ্ট্র গুলি তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হারানোর দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ, জলের তলায় যাওয়ার আগেই এই দ্বীপ গুলির যাবতীয় অধিকারের জলান্জলী হবে।
এখনই যদি কার্বন নিঃসরণ না কমানো হয়, তাহলে পৃথিবীতে যতো এই ধরণের দ্বীপ আছে, সব আগামী 50 বছরে একেবারে জলের তলায় চলে যাবে। মুছে যাবে তাদের অস্তিত্ব, আর সবথেকে মারাত্মক বিষয় হল, এই অঞ্চলের মানুষেরা জলবায়ু পরিবর্তনের এই বীভৎসতার জন্যে একেবারেই দায়ী নন, দায়ী ধনী দেশ গুলি, উন্নয়নশীল দেশ গুলি, কিন্তু টুভালুর মত গরীব দেশ গুলিই আজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। এর দায় কি নেবেন গ্লাসগোতে বসে থাকা নেতারা? কার এই দায়? বেশিরভাগ দ্বীপ গুলির ই নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী নেই, অস্ত্র ভাণ্ডার বা পরমাণু বোমা তো দূর সম্পর্কের বিষয়। আর এই দ্বীপ গুলি বাজার হিসেবেও স্বীকৃত নয়, কোনো বড় কোম্পানির বিনিয়োগ নেই এইসব জায়গায়, তাই কারোর কোনও তাগিদ ও নেই। হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম জানবে একদিন, এই মানুষগুলো এবং এই ছোট্ট দ্বীপ গুলোর সাথে কি অন্যায় হয়েছিলো, কিভাবে অন্যের দোষের ফল এই নিরপরাধ মানুষ গুলোকে ভুগতে হয়েছিল।