মমতার অপরাজিতা বিলে ধর্ষকদের দোষী সাব্যস্ত করাই কঠিন হবে! কেন বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
Aparajita Anti Rape Bill: গত দশ বছরে ভারতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে মাত্র পাঁচজনের। ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী, ভারতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি ছিলেন মোট ৪৮৮ জন।
আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে যখন সারা রাজ্য উত্তাল, তখন জনতার সেই ব্যাপক ক্ষোভের মধ্যেই তৃণমূল সরকার বিধানসভায় ধর্ষণবিরোধী একটি বিল পাশ করে। রাজনৈতিক দলগুলি তথা আমজনতার একাংশ বলছে, রাজনৈতিক স্টান্ট ছাড়া এই বিল আর কিছুই নয়। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা সতর্ক করছেন, রাজ্যের আনা এই নয়া বিলের ফলে আসলে ধর্ষণের মামলায় কাউকে দোষী সাব্যস্ত করাই কঠিন হয়ে উঠবে। এই অপরাজিতা বিলে, ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মহিলাদের ধর্ষণ এবং অ্যাসিড হামলার তদন্ত ও বিচার করার জন্য রাজ্যের প্রতিটি জেলায় বিশেষ টাস্ক ফোর্স এবং বিশেষ আদালতের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে এই বিলে। এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ ২১ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করবে এবং অভিযুক্তদের ৩০ দিনের মধ্যে বিচার করবে, এমন কঠোর নির্দেশও রয়েছে তাতে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিল্লি গণধর্ষণ মামলার পরে ২০১৩ সালে এই ধরনের অপরাধের জন্য শাস্তি আরও কঠোর করা হয়েছিল। তবে প্রায় দশ বছরেও শাস্তির আইন, কঠোর বিধি মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের হার কমাতে পারেনি মোটেও। পুলিশের দক্ষতা, টহলদারি বাড়লে, ফৌজদারি বিচার পরিকাঠামোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে এবং অন্যান্য আইন বহির্ভূত পদক্ষেপ সঠিকভাবে করা হলে তাও মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ রোধ করার সম্ভাবনা বাড়ত। সেসব জানা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সরকার একটি নয়া বিল আনল। ৯ অগাস্ট আরজি কর হাসপাতাল থেকে তিলোত্তমার দেহ উদ্ধার হয়। তার কিছুকাল পরে অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪ পাশ করা হয়েছিল। এই আইনে শিশুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং যৌন অপরাধের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথাও উল্লিখিত হয়েছে। কেন আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই আইনে দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন?
বর্তমানে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার অধীনে, মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের মধ্যে, শুধুমাত্র ১২ বছরের কম বয়সি কোনও মেয়েকে ধর্ষণ, ১৮ বছরের কম বয়সি কোনও মেয়েকে গণধর্ষণ, ধর্ষণের সময় আঘাতের জন্য যদি নির্যাতিতার মৃত্যু ঘটে বা নির্যাতিতা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যান, বা ধর্ষণের জন্য দ্বিতীয়বার দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা এবং যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইনের অধীনে অন্যান্য ধর্ষণ-সম্পর্কিত অপরাধগুলিতে দোষীদের বাকি জীবনের জন্য সর্বোচ্চ কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় করার বিধি রয়েছে। বাংলার অপরাজিতা বিলে ধর্ষণ এবং গুরুতর আঘাত যাতে নির্যাতিতা অক্ষম হয়ে যান বা তাঁর মৃত্যু ঘটে এমন অপরাধের জন্য বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এটি অভূতপূর্ব কারণ অন্য কোনও আইনে অন্য কোনও অপরাধের জন্যই বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড নেই।
আরও পড়ুন- মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন মমতা
অপরাজিতা বিলে মহিলাদের ধর্ষণ এবং শিশুদের যৌন নিপীড়নের তদন্তের সর্বোচ্চ সময়কে এফআইআর দায়েরের পর থেকে দুই মাস থেকে কমিয়ে ২১ দিন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ এবং অ্যাসিড হামলার মামলার বিচার শেষ করতে বলা হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারকে সারা দেশে একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানও জানিয়েছে।
কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিল আসলে রাজনৈতিক কৌশল। বিরলতম বিরল ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যদি একজন বিচারকের কাছে কেবল মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই একমাত্র বিকল্প হয়, তাহলে আরও উচ্চমানের প্রমাণ প্রয়োজন। কারণ মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হচ্ছে মানেই 'শর্টকাট' ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে, অনেক পোক্ত প্রমাণ, ব্যাপক প্রমাণ লাগে, যাতে সময়ও লাগে। বিচারকরা কম সময়ে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে দ্বিধা বোধ করতে পারেন, যার ফলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার কমে যেতে পারে হয়।
মহিলাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে, মৃত্যুদণ্ড এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত এবং বিচারের দাবি সবসময়ই করা হয়। কিন্তু তা কতখানি কার্যকর হয় তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কত ক্ষেত্রেই বা কতজনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়? গত দশ বছরে ভারতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে মাত্র পাঁচজনের। ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী, ভারতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি ছিলেন মোট ৪৮৮ জন।
২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়ার গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে পাশ হওয়া ফৌজদারি আইন সংশোধনী। এই সংশোধনীতে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের পরিধি প্রসারিত হয় এবং শাস্তিও বাড়ে। তাতেও, এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়নি। উল্টে দিল্লির ট্রায়াল কোর্টগুলির একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই সংশোধনীর পরে দোষী সাব্যস্ত করার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
আরও পড়ুন- আরজি কর ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদ কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহিলা ভোট কমিয়ে দেবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করার জন্য বিলে যে সময়সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাও অবাস্তব। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা বা বিচার শেষ করা তখনই সম্ভব যখন আমাদের সেই পরিকাঠামো থাকবে। জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে এই ধরনের বিল রাতারাতি পাশ করিয়ে দায়িত্ব পালন করা যায় ঠিকই কিন্তু আখেরে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতাই থাকে না কারণ তা অবাস্তব। রাজ্য তথা ভারতীয় পুলিশের দ্রুত প্রমাণ সংগ্রহে দুর্দান্ত কোনও ট্র্যাক রেকর্ডও নেই। এমন বহু বহু অপরাধ আছে যাতে পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহ কঠিন এবং কষ্টকর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অযৌক্তিক সময়সীমা নির্ধারণের পরিবর্তে, পুলিশ কর্মীদের আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রমাণ সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। সময়সীমার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ফরেনসিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা উচিত যাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টোরেজ সুবিধা থাকবে। ২১ দিনের মধ্যে প্রমাণ সংগ্রহের চাপ থাকলে পুলিশ যে নিরপরাধ ব্যক্তিদের উপর দোষারোপ করে নির্দোষদের জেলে ভরবে এমন আশঙ্কা অমূলক না। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য প্রথমেই মৃত্যুদণ্ড ধর্য করার পথে হাঁটার পরিবর্তে, এই আক্রমণগুলি ঠেকাতে বেশ কিছু পদ্ধতিগত এবং কাঠামোগত সমাধানের দরকার বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে ফাস্ট-ট্র্যাক আদালতের পরিবর্তে প্রশিক্ষিত বিচারক সহ আরও নিয়মিত আদালতের প্রয়োজন। শাস্তি হবে এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, কত কঠিন শাস্তি হচ্ছে তা নিশ্চিত করা সরকারের লক্ষ্য হতে পারে না। বিচারের পাশাপাশিই প্রতিরোধের দিকেও জোর দিতে হবে। মহিলাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করি আমরা এবং কেন মহিলারা বারেবারে এই ধরনের আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছে সে সম্পর্কে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কথোপকথন হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।