বৌদ্ধ ধর্ম নেওয়ার পরেও নৃশংস ছিলেন সম্রাট অশোক! আজও ফুরোয়নি যে বিতর্ক
Samrat Ashoka: তাঁর শিলালিপির পাঠোদ্ধারের প্রায় দুশো বছর পরেও বিতর্ক সম্রাট অশোককে ছাড়েনি।
ব্রায়েন হজসন নেপালের রাজার সভায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-র দূত ছিলেন। নেপালে থাকাকালীন তিনি উত্তর বিহারে একটি স্তম্ভের খোঁজ পেয়েছিলেন। এই স্তম্ভের গায়ে কোনও অচেনা ভাষার লিপি খোদাই করা ছিল। তিনি সেই অচেনা লিপির একটা প্রতিলিপি তৈরি করে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি-র দফতরে পাঠিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এশিয়াটিক সোসাইটি-র নতুন প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক এই ধরণের অচেনা লিপির খোঁজ সম্পর্কে উৎসাহী। সম্পাদক সেই প্রতিলিপি নিরীক্ষন করে জানতে পারেন যে, এই একই ধরনের লিপি ভারতীয় উপমহাদেশে আগেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। প্রথমে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা-য় এবং পরে এলাহাবাদ ফোর্ট চত্বরে। যদিও দুই ক্ষেত্রেই কেউ এই লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারেনি। এই ভাষা স্থানীয় মানুষের বলা চলিত ভাষা নয়, এমনকী, এই ভাষা কোথাও লেখা হয় না।
পরবর্তী চার বছর এশিয়াটিক সোসাইটি-র পত্রিকার সম্পাদক দিন-রাত পরিশ্রম করে এই অচেনা লিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব না হলেও আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, তিনটে আলাদা এলাকায় পাওয়া তিনটে স্তম্ভের গায়ে লেখাগুলো একই ছিল। এই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ধরনের লিপির খোঁজ মিলতে শুরু করে। এশিয়াটিক সোসাইটি-র পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ মধ্যপ্রদেশের সাঁচি-র উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাঁচি-তে একটি বহু প্রাচীন স্তূপ ছিল, যাকে ঐতিহাসিকরা একটি সম্ভবত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে গণ্য করতেন।
আরও পড়ুন: ‘আমাকে বাঁচাও’! আজও রাতের আঁধারে আর্তনাদ ভেসে বেড়ায় এই রহস্যময় প্রাসাদে
ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড সম্পাদকের নির্দেশমতো সাঁচির সেই স্তূপের গায়ে এবং তার আশপাশের দেওয়ালে লেখা লিপির প্রতিলিপি কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতায় বসে সম্পাদক এইসব লিপির পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন যে, সব লেখার শেষটা এইরকম দু'টি অক্ষর দিয়ে শেষ হয়েছে। এই অক্ষরদুটো একসঙ্গে 'দান' শব্দ তৈরি করে। এই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের এক অধ্যায় যেন হাজার বছরের ঘুম কাটিয়ে উঠে আসে। সম্পাদক তাঁর সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্য এশিয়াটিক সোসাইটি-তে জমা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্তম্ভ এবং স্তূপের ওপর পাওয়া অচেনা ভাষায় লেখা এই নির্দেশ অথবা রীতি প্রাচীন ভারতের এক রাজার আদেশে লেখা হয়েছিল। এইসব লেখায় সেই রাজা নিজেকে 'ভগবানের প্রিয়' বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি নিজের জীবনে একটা সময়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
এশিয়াটিক সোসাইটি-তে যখন এই তথ্য জমা পড়েছে, তখন শ্রীলঙ্কায় জর্জ টার্নার নামে এক ঐতিহাসিক বৌদ্ধদের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন। তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে জানান যে, ভারতীয় উপমহাদেশে এক শক্তিশালী রাজার কথা বৌদ্ধদের ইতিহাসে পাওয়া যায়। সেই রাজা নিজেকে 'ভগবানের প্রিয়' বলে নিজের শিলালিপিতে পরিচয় দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। সেই রাজার নাম ছিল অশোক। তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-র নাতি ছিলেন। এই শিলালিপির পাঠোদ্ধারের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে প্রায় কেউই সম্রাট অশোকের সম্পর্কে জানত না। তার লেখা লিপি মানুষের চোখের সামনে থাকলেও সেই লিপি পড়তে না জানার কারণে মানুষ সেই লিপি অথবা স্তম্ভের গুরুত্ব বুঝতে পারেনি।
অশোকের লিপির পাঠোদ্ধারের কৃতিত্ব এশিয়াটিক সোসাইটি-র পত্রিকার সেই সম্পাদককে দেওয়া হয়। তাঁর নাম ছিল জেমস প্রিন্সেপ। কলকাতার জনপ্রিয় প্রিন্সেপ ঘাটের নামকরণ তার নামেই করা হয়েছে। ১৮৩৭-'৩৮ সালের মধ্যে অশোকের লিপির পাঠোদ্ধারের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ঘাটের কাছেই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সৌধ তৈরি করা রয়েছে। ১৮৪০ সালে জেমস প্রিন্সেপ চল্লিশ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে মারা যান, কিন্তু তার আগে ভারতীয়দের হাতে তাঁদের ইতিহাসের একটা অধ্যায় তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন।
বর্তমানে মানুষ সম্রাট অশোকের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় সম্পর্কে অবগত। তাঁর জীবনের প্রথম ভাগের ক্রুরতা থেকে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরিণতি দেখে চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হওয়া- তাঁর জনহিতকর কাজ সম্পর্কে বহু মানুষ অবগত হয়েছে। সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যের চারদিকে চারটি সিংহের প্রতীক আজ স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যদিও তাঁর শিলালিপির পাঠোদ্ধারের প্রায় দুশো বছর পরেও বিতর্ক সম্রাট অশোককে ছাড়েনি। বহু মানুষ মনে করেন যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে নয়, বরং তার বহু আগেই অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার প্রমাণ হিসেবে অশোকের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্ত্রীয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। তাহলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কেন গিয়েছিলেন? বহু মানুষের মতে, অশোক নিজ ব্যক্তিগতভাবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও তাঁর রাজধর্ম পালন করতে ভোলেননি। তাই রাজার ধর্ম পালন করতেই তিনি কলিঙ্গ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বহু মানুষের মতে, কলিঙ্গ যুদ্ধ কেবলমাত্র একটি স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল। সম্রাট অশোক যুদ্ধের আগে থেকেই মানসিকভাবে রক্তক্ষয়ের বিরোধী হয়ে পড়েছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়ানক পরিণতি সেই আগুনে ঘিয়ের কাজ করেছিল।
যদিও এই যুক্তির বিরোধিতা করে বহু মানুষ বলেন যে, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পরেও বহু ক্রুরতার নিদর্শন রেখেছেন। সেক্ষেত্রে পুনরায় রাজধর্মের পাল্টা যুক্তি উঠে আসে। বহু মানুষ এটাও বিশ্বাস করেন যে সম্রাট অশোক হয়তো ততটাও নৃশংস ছিলেন না, যতটা তাঁর শিলালিপি থেকে জানা যায়। শিলালিপির রচয়িতারা তাকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁর জীবনের কিছু অধ্যায়কে অনেকটা বেশ নৃশংস দেখিয়েছিলেন।
মানুষের মধ্যে সম্রাট অশোকের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় এবং সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও একটা কথা সকলেই স্বীকার করে যে, প্রাচীন ভারতের সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী এই রাজার কথা হয়তো মানুষ ভুলেই যেত, যদি জেমস প্রিন্সেপ সেই অচেনা লিপির আকর্ষণ উপেক্ষা করতেন।
তথ্য ঋণ: লাইভ হিস্ট্রি ইন্ডিয়া