মুদির দোকানি থেকে রাজা হওয়া, মুর্শিদাবাদের এই রাজপ্রাসাদ ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অতীতে

এই শহরে বর্তমানে যে দু'টি রাজবাড়ি অবস্থান করছে, সেই দু'টিই কাশিমবাজার রাজবাড়ি নামে পরিচিত।

মুঘল মসনদে তখন সম্রাট ঔরঙ্গজেব বিরাজমান। সুবে বাংলা, অর্থাৎ বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের কাজ দিল্লি থেকে সামলানো কোনওমতেই আর সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। তাই উপায় না পেয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ-কে বাংলায় দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন স্বয়ং সম্রাট ঔরঙ্গজেব। এরপরেই কার্যত ভোল পাল্টে যেতে থাকে মুর্শিদাবাদের। নবাবের আদেশে ১৭০৪ সালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী বাঙ্গাল দেশের ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত করা হয় মুর্শিদাবাদে, দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ তখন রীতিমতো জাঁকিয়ে রাজত্ব করছে বাংলায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই, বাংলার রাজধানী যে স্থানে, সেই স্থানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাঁটি গড়ে উঠবেই। ঠিক সেই কারণেই পরবর্তী সময় এই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কেন্দ্র করে পরাধীন বাংলায় জন্ম নিতে থাকে একের পর এক জমিদার বংশগুলি, যারা আবার পরে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে রাজবংশ হিসেবে। জেনে নেওয়া যাক, মুর্শিদাবাদের কোলে অবস্থিত কাশিমবাজারের তেমনই দু'টি রাজপরিবারের কাহিনি যাদের গড়ে ওঠার পিছনে সম্পূর্ণরূপে কোম্পানির অবদান ছিল।

কাশিমবাজারের উত্থান
প্রশ্ন উঠতেই পারে, গোটা মুর্শিদাবাদ পড়ে থাকতে কাশিমবাজারেই কেন গড়ে উঠল এই দু’টি রাজবাড়ি? ১৭ শতকের আগে কাশিমবাজারের ইতিহাস ঠিক জানা যায় না, তবে এটুকু কথা জানা যায়, শহর মুর্শিদাবাদ গড়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই বাংলায় এই কাশিমবাজার অঞ্চলের বেশ গুরুত্ব ছিল, গুরুত্ব ছিল বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। শোনা যায়, ইউরোপীয় বণিকেরা সর্বপ্রথম তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল এই শহরেই। সরস্বতী নদীর মুখ বুজে গিয়ে সপ্তগ্রামের পতন ঘটার পরেই কাশিমবাজার ইউরোপিয়ানদের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই সময় থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ এবং ফরাসিরা নিজেদের বাণিজ্যিক সুবিধার্থে এই অঞ্চলে তাদের কুঠিগুলি নির্মাণ করে। ১৬৫৮ থেকে ১৬৫৯- এই এক বছরের মধ্যেই ইংরেজরা কাশিমবাজার অঞ্চলে তাদের দু’টি কুঠি নির্মাণ করেছিল। এরপরে মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী হিসেবে স্থান পেলে অর্থনৈতিক দিকটির পাশাপাশি এই অঞ্চল ক্রমশ রাজনৈতিক পরিসরেও গুরুত্ব অর্জন করে।

এবার আসা যাক রাজবাড়ি প্রসঙ্গে। এই শহরে বর্তমানে যে দু'টি রাজবাড়ি অবস্থান করছে, সেই দু'টিই কাশিমবাজার রাজবাড়ি নামে পরিচিত। তবে বোঝার সুবিধের জন্য পুরনো রাজবাড়িটি পরিচিত ‘বড় রাজবাড়ি’ বা শ্রীপুর প্যালেস নামে, এবং অন্যটি পরিচিত ‘ছোট রাজবাড়ি’ হিসেবে। তবে বড় কিংবা ছোট রাজবাড়ি নামগুলো শুনে কিন্তু একদম ভাববেন না যে, এদের ইতিহাস কিংবা মালিকানা একই। দুই রাজবাড়ি গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু'টি গল্প।

আরও পড়ুন: রাজবাড়ির প্রতিটি ইটে জীবিত ইতিহাস, এখনও রোমাঞ্চের ঠিকানা ইটাচুনা

কাশিমবাজার বড় রাজবাড়ি
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষ্ণকান্ত নন্দীর হাত ধরে গড়ে ওঠে এই রাজবাড়িটি। ইতিহাসে তিনি ‘কান্ত মুদি’ নামেও পরিচিত ছিলেন, কারণ তাঁর বাবা রাধাকৃষ্ণ কান্ত ছিলেন কাশিমবাজার অঞ্চলের একজন মুদির দোকানি। সপ্তদশ শতকে গড়ে ওঠা দু’টি ইংরেজ কুঠির মুদি মাল সরবরাহের কাজে যুক্ত ছিল তাঁর পরিবার। সেই সময় থেকেই বাংলায় সদ্য পা রাখা, ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সঙ্গে তাঁর খাতির জমতে শুরু করে। ১৯৫৬ সালে সিরাজ-উদ-দৌল্লা ইংরেজদের ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করলে, ওয়ারেন হেস্টিংসকে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করেছিলেন এই কৃষ্ণকান্ত নন্দী, শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময় তাঁকে বাংলা ছেড়ে পালাতেও সাহায্য করেন তিনি। এই উপকার কিন্তু হেস্টিংস সাহেব ভোলেননি। পরাধীন বাংলায় যখন তিনি গভর্নর নিযুক্ত হয়ে আসেন, তখন তিনি কৃষ্ণকান্তর ছেলে লোকনাথ নন্দীকে, দিল্লির সম্রাটের কাছে বাদশাহ করার সুপারিশ করেন এবং সেই থেকে লোকনাথ নন্দী বনে যায় লোকনাথ রায়বাহাদুর। এরপরেই নির্মিত হয় এই প্রাসাদটি। শোনা যায়, কাশির রাজা চেত সিংহের প্রাসাদ থেকে পাথরের থাম এবং খিলান নিয়ে এসে মুর্শিদাবাদের এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন কৃষ্ণকান্ত, রানি স্বর্ণময়ীর নির্দেশে রাজবাড়িতে তৈরি করা হয়েছিল লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির। এর অনেক পরে আবার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর আমলে প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে লম্বা পিলারযুক্ত অংশটি যোগ করা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ইংরেজ আমল ভারতের ইতিহাসের অংশরূপে স্থান পেয়েছে, তেমনই এই প্রাসাদও অতীতের ভারে নিজের জৌলুস হারিয়েছে। বর্তমানে প্রাসাদটির অবস্থা এতখানি শোচনীয় যে, ভেতরে পা রাখা নিষেধ। রাজবাড়ির সামনের অংশে একটি ভগ্ন, বাঁধানো জলাশয়ের মতো খানিকটা অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। রাজবাড়িকে আড়াল করে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। তবুও যারা ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণে ইচ্ছুক, তারা একবার ঢুঁ মেরে আসতেই পারেন এককালীন জৌলুসপূর্ণ এই রাজবাড়ির সামনে থেকে।

cossimbazar palace

নবাবি চালে ছুটি কাটানোর ঠিকানা

কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ি
এই রাজপরিবারের সদস্যদের মূলত আদি বাস ছিল তৎকালীন সময়ে, মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার ফিরোজপুর নামে এক বন্দর-নগর অঞ্চলে। সেই সময় তারা মূলত রেশম, মশলা, মসলিন শাড়ির রফতানি করে থাকতেন। বাংলার দায়িত্বে তখন রয়েছেন নবাব আলিবর্দি খাঁ এবং এই সময়েই একের পর এক বর্গী হানায় ব্যবসায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন অযোধ্যারাম রায়। ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার কারণে অযোধ্যারাম রায় তাঁর পরিবার নিয়ে চলে আসেন এই কাশিমবাজার অঞ্চলে। একদিকে পুরাতন প্রথা মেনেই চলতে থাকে রেশম ব্যাবসা, আবার অন্যদিকে দীনবন্ধু রায় ইংরেজদের রেশম কুঠিতে নিযুক্ত হন দেওয়ানিরূপে। এরপরে ১৭৪০ সালে দীনবন্ধু রায় এই রাজবাড়ির কিছু ঘর এবং ঠাকুরদালানটি স্থাপন করেন। এই সময় কাশিমবাজার রাজবাড়ির প্রসার যে খুব বেশি ছিল, তেমনটা কিন্তু নয়। লর্ড কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার প্রবর্তন করলে, রায় পরিবার ব্যবসা-বৃত্তি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে জমিদার বংশে রূপান্তরিত হয়। আজ রাজাও নেই, রাজত্বও অতীত, কিন্তু রায় পরিবার অতি যত্নের সঙ্গে তাঁদের পৈতৃক ভিটেখানি আগলে রেখেছে। বর্তমানে রাজপরিবারের সদস্যরা কলকাতার বাসিন্দা। বছরে একবার দুর্গাপুজোর সময় তাঁরা এই কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে আসেন।

কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির একটি ভাগ বর্তমানে খুলে দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। এখন আপনি চাইলেই এই রাজবাড়িতে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও এই প্রাসাদটি কিন্তু স্ব-মহিমায় আজও বিরাজমান। পুরনো দিনের রাজ-রাজড়ার আমলের সব জিনিস দিয়ে প্রাসাদের ভেতরেই স্থাপিত হয়েছে একটি মিউজিয়াম। বাঙালির রসনা তৃপ্তির কথা মাথায় রেখে একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাও করেছেন রায় পরিবার। রাজবাড়ির ঐতিহ্যকে বজায় রেখে কাঁসার থালা-গেলাসে নানা স্বাদের খাবারগুলি পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও বাঙালির ঐতিহ্যপূর্ণ সব আইটেম দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘রাজভোগ’ নামে বিশেষ একটি থালি। গেস্ট হাউজের প্রতিটি ঘরেই যেমন রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া, তেমনই উঁচু উঁচু পালঙ্ক কিংবা ছাদ থেকে ঝুলন্ত বিশালাকার সব ঝাড়বাতি আপনাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে– আপনি আজ রাজ-অতিথি। আধুনিকতার মোড়কে ইতিহাসকে অতি যত্নে বেঁধে রাখার অপরূপ চেষ্টা এই ছোট রাজবাড়িকে মুর্শিদাবাদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান করে তুলেছে।

কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে থাকতে গেলে তিনদিনের প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ পরবে প্রায় ১১,০০০ টাকা। আপনি যদি নবাবের শহরে নবাবিয়ানা উপভোগ করতে চান, তবে আর দেরি না করে, এই পুজোতেই না হয় একবার ঘুরে আসুন এই ঝাঁ-চকচকে প্রাসাদ থেকে। কলকাতা থেকে ২৫১ কিমি দূরে অবস্থিত হওয়ার কারণে আপনি চাইলে দিনের দিন গিয়েও কিন্তু ফিরে আসতে পারেন। রাজবাড়িতে প্রবেশমূল্য মাত্র ৩০ টাকা।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

More Articles