Indian Rail Pod Hotel| রেল স্টেশনেই এবার শান্তির ঘুম! অভিনব উপহার ভারতীয় রেলের

এ যেন প্রত্যেকটি রেল স্টেশনের প্রতিদিনের ছবি। ভারতীয় রেলের কাছে এই নিয়ে আমাদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু এই ছবিটা এবার বদলাতে চলেছে। ভারতীয় রেল এবার যাত্রীদের সুবিধার্থে অন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ভারতের মতো জনবহুল দেশে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার হলেই রেলযাত্রার কথা সবার প্রথম চয়েস। রেলের কামড়ায় বসে বাইরের দৃশ্য উপভোগ আমাদের চোখ আর মনকে শান্তি দেয়। ভারতের প্রতিটি বড় শহরেই রেল স্টেশনে আরাম করার জন্য রেস্ট রুম বা রিটিয়ারিং রুম আছে। কিন্তু আমি আপনি হামেশাই দেখতে পাই রেস্ট রুম ভিড়ে উপচে পড়ছে, বাথরুমের দশা আরও খারাপ, কেউ মগ নিয়ে চলে গেছে, কেউ জলের কলটাই উপড়ে নিয়েছে এই নিয়ে অভাব অভিযোগ আছেই। তার ওপর প্লাটফর্মে গেলে আরেক দৃশ্য চোখে পড়ে। ভিড়ে ভিড়াক্কার প্লাটফর্ম চত্বর, কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই, কেউ চাদর পেতে বসে আছে ৫ ঘণ্টা ধরে অন্য ট্রেনের অপেক্ষায়, কেউ পরের দিনের জন্য অপেক্ষারত। এ যেন প্রত্যেকটি রেল স্টেশনের প্রতিদিনের ছবি। ভারতীয় রেলের কাছে এই নিয়ে আমাদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু এই ছবিটা এবার বদলাতে চলেছে। ভারতীয় রেল এবার যাত্রীদের সুবিধার্থে অন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ধরুন আপনি মুম্বই গিয়েছেন কিন্তু হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়ে ওঠেনি। একদিনের ব্যাপার ভেবেছিলেন প্লাটফর্মেই কাটিয়ে দেবেন কারণ যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে আধুনিক হোটেলে ওঠা পকেট ফাঁকা হওয়ার সামিল। কিন্তু প্লাটফর্মে নেমে দেখলেন কোথাও ব্যাগ রাখার জায়গা নেই। আর থাকলেও আপনি ভরসা পাচ্ছেন না রাখার, ব্যাগে যে জরুরি কাগজপত্র আছে সেগুলো হারালে মুশকিল। কি করা যায় এইসব চিন্তা করছেন তখন দেখলেন রেলের ওয়েটিং রুমের সামনে এক রিটিয়ারিং রুম তবে তা সাধারণ রিটিয়ারিং রুমের মতো নয়। একটু অন্যরকম। ঝাঁ চকচকে রুম, এসি, ফ্রি ওয়াই ফাই বলতে গেলে আধুনিক হোটেলে যা থাকে তাই আছে। তাহলে কেমন হয় যদি একবার ঢুঁ মারা যায় তাতে। 

পড হোটেল বা ক্যাপসুল হোটেলের নাম হয়তো অনেকেই শোনেননি। ভারতীয় রেলের এক অভিনব প্রয়াস এই ক্যাপসুল হোটেল। যাত্রীদের উন্নতমানের সুবিধা প্রদান করতে তাদের এই উদ্যোগ। ভারতে প্রথম পড হোটেল চালু হয় মুম্বইতে ২০২১ সালে।


কী এই পড হোটেল?

একটি বড় ঘর তার মধ্যে কিছু ড্রয়ারের মতো অংশ। ড্রয়ারের মধ্যে একটি দরজা, তা খুলে ভেতরে ঢুকলে একটি খাট, তাতে বসাও যায় আবার শোয়াও যায়। সেই ড্রয়ারের ভিতরে বালিশ, কম্বল, এসি, জলের বোতল, টিভি, চার্জার পয়েন্ট সবই আছে। দুই থেকে তিনটি থাকে এই পডগুলি হয়। কোনো কোনো পডে আবার লাইব্রেরির ব্যবস্থাও থাকে। পড হোটেলের প্রথম কনসেপ্ট পাওয়া যায় জাপানে। সালটা ছিল ১৯৭৯। জাপানেই প্রথম এই ক্যাপসুল হোটেল বানানো হয়। তখন হোটেলের নাম ছিল ‘দ্য ক্যাপসুল ইন ওসাকা’, কিসো কুরোকাওয়া নামে এক ইঞ্জিনিয়ার এই ক্যাপসুল হোটেলের নকশা বানিয়েছিলেন। এই হোটেলের বৈশিষ্ট্য ছিল কম জায়গায় অনেক কিছুর সুবিধা দেওয়া। এক জনপ্রিয় পত্রিকার প্রতিবেদনের মতে, জাপানিরা উচ্চতায় একটু ছোটোখাটো হয় এবং অল্প জায়গায় কীভাবে বেশি জিনিস আঁটানো যায় তাই নিয়ে তাদের সবসময় পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে। এই ধারণা থেকেই ক্যাপসুল হোটেল তৈরি হয়।

জাপানের বহু স্থানে এখন এই পডের ব্যবস্থা আছে। বলাই বাহুল্য আধুনিক হোটেলের তুলনায় এই পড হোটেলের খরচ অনেক কম। তাই জাপানের আদলে আরও অনেক দেশ এই হোটেল তৈরির দিকে ঝুঁকেছে। বেলজিয়াম, সিঙ্গাপুর, হংকং, চিন, ইন্দোনেশিয়া, আইসল্যান্ড এ এমন হোটেল আছে। এবার সেই তালিকায় নাম লেখাল ভারত। বিদেশি ক্যাপসুলের সুবিধা তো শুনেই নিলেন আমাদের দেশীয় ক্যাপসুলে কি কি পাওয়া যাবে তা দেখে নিই। আমাদের দেশীয় পড হোটেলের চেহারা বেশ সুন্দর এবং ছিমছাম, বিলাসবহুল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। শোবার জন্য বিছানা, বালিশ, কম্বল, এবং মালপত্র রাখার জন্য আলাদা জায়গা আছে। জরুরি কাগজ রাখার জন্য আছে লকার। প্রতিটি ক্যাপসুলে আছে ঝাঁ চকচকে বাথরুম, নিজস্ব টিভি, আয়না। আর ব্যক্তিগত পডে থাকছে আলাদা এসি, যা আপনি নিজের ইচ্ছেমতো বাড়াতে কমাতে পারেন। আর আছে প্রতিটি পডে আলাদা আলোর ব্যবস্থা। সেই আলো জ্বেলে কেউ রাতে পড়াশোনা করতে চাইলে করতে পারে তাতে পাশের পডের যাত্রীর কোনো অসুবিধে হবে না।

ভারতের প্রথম পড হোটেল চালু হয় মুম্বইয়ের সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনে। মেজানাইন ফ্লোরের ওপর প্রায় ৩০০০ বর্গকিমি জায়গা জুড়ে আছে এই হোটেল। আইআরসিটিসি মেসার্স আরবান পড প্রাইভেট লিমিটেডকে ৯ বছরের চুক্তিতে এই পড হোটেল পরিচালনা এবং সেট আপের জন্য নিয়োগ করে। আইআরসিটিসি -র অভিনব উদ্যোগ এই হোটেলে ৪৮ টি পড রুম রয়েছে। তার মধ্যে তিনটি ভাগ রয়েছে। ৩০ টি ক্লাসিক পড, ৭ টি মহিলা পড, আর ১০ টি ব্যক্তিগত পড। আর ১টি পড থাকছে বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য। ক্লাসিক এবং মহিলা পডে একজন করে বেশ আরামে থাকতে পারবে। প্রাইভেট পডে বিছানা ছাড়াও একটি আলাদা স্পেসের ব্যবস্থা আছে। অন্যদিকে বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পডে হুইল চেয়ার নিয়ে যাতায়াত করার ব্যবস্থাও আছে।

আবারও এই একই ধাঁচে মুম্বাইতে তৈরি হল দ্বিতীয় পড হোটেল। মুম্বাইয়ের সবথেকে ব্যস্ততম রেলস্টেশন ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাসের ওয়েটিং রুমের সামনে তৈরি হল পড হোটেল। জনগণের জন্য জুন মাসের শেষের দিকে খোলার সিদ্দান্ত নেওয়া হয়েছে। কিছু কর্মকর্তাদের মতে, ছত্রপতি টার্মিনাসে তৈরি এই হোটেলে ৫০ জন মানুষ থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পডগুলির মধ্যে ৩০ টি সিঙ্গেল পড, ৬ টি ডবল পড ও ৪ টি ফ্যামিলি পড। এই পডগুলিতে মোবাইল চার্জিং, লকার রুম, ফায়ার অ্যালার্ম, ইন্টারকম, ডিলাক্স টয়লেট এবং বাথরুমের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সেন্ট্রাল রেলওয়ের প্রধান জনসংযোগ আধিকারিক শিবাজি সুতারের মতে, এই বারের পড হোটেল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নামাহ এন্টারপ্রাইসের হাতে। যারা প্রতি বছর ১০,০৭,৭৮৬ টাকা রেলওয়েকে প্রদান করবে তাদের লাইসেন্স ফি হিসেবে। ১৩১.৬১ স্কোয়ার মিটার জায়গা জুড়ে তৈরি এই হোটেল।

পডে থাকার খরচ

ক্লাসিক পড আর মহিলাদের পডের খরচ ১২ ঘণ্টায় ৯৯৯ টাকা। ২৪ ঘণ্টার জন্য হলে তা দাঁড়াবে ১৯৯৯ টাকা। প্রাইভেট পডের খরচ ১২ ঘণ্টায় ১২৪৯ টাকা আর ২৪ ঘণ্টায় তা দাঁড়াবে ২৪৯৯ টাকা। বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য ১২ ঘণ্টায় ১৪৯৯ আর ২৪ ঘণ্টায় ২৯৯৯ টাকা। প্রত্যেক ক্ষেত্রে মূল ভাড়ার সঙ্গে জি. এস. টি. যুক্ত হবে।

গর্ব করে বলাই যায়, নতুন ভারতের আরও একটি নিদর্শন এই ক্যাপসুল হোটেল। মেক ইন ইন্ডিয়ার প্রজেক্টের আওতায় চালু হয়েছে এই হোটেল। ব্যবসার কাজে যারা দূরে যান তাদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা। তবে প্রশ্ন অনেক রয়েই যায়, সাধারণ মধ্যবিত্ত দিন আনা মানুষ যারা ওয়েটিং রুমে জায়গা না পেয়ে প্লাটফর্মে বসেন তারা কতটা এই সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।

More Articles