টি-টোয়েন্টির রমরমায় ক্রিকেটাররা এখন কর্পোরেট চাকুরে?
ক্রিকেটারদের এবার একশো ভাগ কর্পোরেট চাকুরে হয়ে ওঠার দিন শুরু হতে যাচ্ছে।
মঈন আলি। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার। ডানহাতি অফস্পিনে একাধিকবার ভারতীয় ব্যাটারদের ফ্যাসাদে ফেলেছেন। বাঁহাতে ব্যাট করেন, বড় বড় শট নিতে পারেন। এই ধরনের ক্রিকেটার টি টোয়েন্টিতে খুবই মূল্যবান। কিন্তু তিনি যদি একবিংশ শতাব্দীর ক্রিকেট ইতিহাসে জায়গা পান তাহলে তা ঝুড়ি ঝুড়ি উইকেট পাওয়া বা কাঁড়ি কাঁড়ি রানের জন্য হবে না। হবে মাঠের বাইরের কারণে।
আসলে নতুন বছরের গোড়াতেই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের উদ্যোগে সে-দেশে আরও একটা নতুন টি টোয়েন্টি লিগ শুরু হতে চলেছে। মনে করা হচ্ছে, আইপিএলের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিগ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে সেই লিগের, কারণ ওই লিগ আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজ মালিকদের আশীর্বাদধন্য। তাঁরাই ওই লিগের সবকটা ফ্র্যাঞ্চাইজেরও মালিক। এই সৌভাগ্য অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ বা পাকিস্তান সুপার লিগের হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার লিগের অন্যতম দল হলো জোহানেসবার্গ সুপার কিংস। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিক চেন্নাই সুপার কিংস। দলের অধিনায়ক ও কোচের দায়িত্বেও যথাক্রমে ফ্যাফ দু প্লেসি আর স্টিফেন ফ্লেমিং। মঈন সেই দলের খেলোয়াড় তালিকায় আছেন। এদিকে একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতেও শুরু হতে চলেছে নতুন টি টোয়েন্টি লিগ, সেটাও আইপিএল কর্তাদের স্নেহধন্য। ছ'টা দলের মধ্যে তিনটের মালিক মুম্বই ইন্ডিয়ানস, কলকাতা নাইট রাইডার্স আর দিল্লি ক্যাপিটালসের মালিকরা। এই লিগ আবার খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের দিক থেকে আইপিএলের পরেই থাকবে। মজা হলো, মঈনের নাম এই লিগের খেলোয়াড় তালিকাতেও রয়েছে। ১৮ অগাস্ট শারজা ওয়ারিয়র্স যে খেলোয়াড়দের নাম প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে মঈনের নাম। তিনি দুটো লিগেই খেলবেন কী করে? উত্তরটা এই মুহূর্তে চেন্নাই সুপার কিংস সিইও কাশী বিশ্বনাথনের কাছে নেই। তিনি বলেছেন, মঈনকে জিজ্ঞেস করেই জানতে হবে।১ মঈন আপাতত ইংল্যান্ডে দ্য হান্ড্রেড প্রতিযোগিতায় বার্মিংহাম ফিনিক্সের অধিনায়কত্ব করতে ব্যস্ত।
খবরে প্রকাশ, এই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকা আর আমিরশাহীর ক্রিকেট বোর্ডের মধ্যে মঈনকে নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে, দুই ফ্র্যাঞ্চাইজের মধ্যে নয়। অর্থাৎ, দুই দেশের বোর্ডই নিজেদের সর্বস্ব পণ করেছে এই লিগগুলোর উপর। কিন্তু সে আলোচনা থাক, কথা হল মঈন শেষ অবধি কোথায় খেলবেন সেই সিদ্ধান্ত নেবেন কে? বিশ্বনাথন যা-ই বলুন, সিদ্ধান্ত কিন্তু মঈনের হাতে নেই। যতদূর জানা যাচ্ছে, যেহেতু তাঁর সঙ্গে আগে চুক্তি করেছে শারজা ওয়ারিয়র্স, সেহেতু একমাত্র তারা ছেড়ে দিলেই তিনি জোহানেসবার্গ সুপার কিংসের হয়ে খেলতে পারবেন।
আরও পড়ুন: ওয়ান ডে, টেস্ট এখন অতীত, পুরোটাই টি-টোয়েন্টি! ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী আশঙ্কা করছেন কপিল দেব?
ব্যাপারটা খেলোয়াড়দের দিক থেকে ভাবা যাক। দুটো লিগেই সই করার কারণ তো একটাই। যত দূর সম্ভব রোজগার করতে চাওয়া। ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের বাড়বাড়ন্ত খেলাটার পক্ষে ভালো বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের মতে খেলোয়াড়দের রোজগারের সুযোগ বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত ভালো। তাঁরা বলে থাকেন, ফুটবল তো বরাবরই ক্লাবভিত্তিক, ক্রিকেটে তা ঘটে যদি খেলোয়াড়দের রোজগার বাড়ে তাতে ক্ষতি কী?
মঈন সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ফুটবলে একজন খেলোয়াড় একটা ক্লাবের সঙ্গেই চুক্তিবদ্ধ হন। এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাবে যেতে গেলে ট্রান্সফার নিতে হয়। তার আলাদা নিয়মকানুন আছে, মরসুমের শুরুতে এবং মাঝে নির্দিষ্ট সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া আছে। উপরন্তু ট্রান্সফার হলে যে ক্লাব থেকে ফুটবলার যাচ্ছেন, তাদেরও দেনা পাওনা থাকে। ক্রিকেট কর্তারা সেসব ভেবেই দেখেননি, অথচ মহানন্দে টি টোয়েন্টি লিগ খোলা চলছে। একজন ক্রিকেটার নাকি যখন ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছে খেলবেন। নিজেদের স্বার্থে ঘা লাগলে কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজ যে সেই স্বাধীনতায় বাদ সাধতে পারে তা ভেবে দেখা হয়নি। মঈনকে কেন ছেড়ে দিতে রাজি হবে শারজা ওয়ারিয়র্স? তিনি তো নিখরচায় খেলতে রাজি হননি। এদিকে মঈনের জন্য ব্যাপারটা শাঁখের করাত। যতদূর সম্ভব রোজগারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দুটো লিগের দুটো দলে সই তো করে ফেলেছেন, এখন কোন দলে খেলবেন, সে সিদ্ধান্ত আর তাঁর হাতে নেই। যদি কেবল শারজা ওয়ারিয়র্সে খেলেন তাহলে শুধু যে রোজগারের দিক থেকে পরিকল্পনা সফল হবে না তা-ই নয়, দু'-দুটো ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিক পক্ষ (চেন্নাই সুপার কিংস, জোহানেসবার্গ সুপার কিংস) তাঁর ওপর চটবেন। ভবিষ্যতের জন্য সেটা ভালো না-ও হতে পারে। আর যদি শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার লিগে খেলেন, তা হলেও আমিরশাহীর লিগের চুক্তি হাতছাড়া হবে।
ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগশাসিত ক্রিকেট দুনিয়ায় যে সম্ভাবনা প্রবল, তা হলো, ক্রিকেটাররা স্বাধীন হওয়ার বদলে ক্রমশ একটা ফ্র্যাঞ্চাইজের অধীন হয়ে যাবেন। যেসব মালিকের একাধিক দেশের লিগে ফ্র্যাঞ্চাইজ রয়েছে, তাঁরাই গোটা বছর ক্রিকেটারদের উপর ছড়ি ঘোরাবেন– এ সম্ভাবনা প্রবল। তাঁরাই ঠিক করবেন, কোথায় কোথায় ক্রিকেটাররা খেলবেন, কোথায় খেলবেন না। এখন ট্রেন্ট বোল্টের মতো ক্রিকেটাররা নিজের দেশের বোর্ডের চুক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছেন২, কারণ চতুর্দিকে টি টোয়েন্টি লিগ। সেসব লিগে খেলে অনেক বেশি রোজগার করার স্বাধীনতা রয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটই প্রধান হয়ে গেলে এবং একাধিক লিগের একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজ মাত্র কয়েকজন মালিকের হাতে এসে গেলে সে স্বাধীনতা আর থাকবে না। যে কোনও খোলা বাজারই শেষপর্যন্ত মনোপলিতে পরিণত হয় এবং কর্মীর স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো ঘোর ধনতান্ত্রিক দেশে দস্তুরমতো ক্রিকেটারদের সংগঠন আছে এবং সেগুলো দেশের ক্রিকেট বোর্ড স্বীকৃত। ফলে সংগঠনগুলো পারিশ্রমিকসমেত অনেক ব্যাপারেই দলবদ্ধ দরাদরি (collective bargaining) করতে পারে এবং করে থাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা এ-ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী বললেও ভুল হয় না। তাঁরা অনেক আগেই বোর্ডের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন দলবদ্ধভাবে। জাতীয় দলে খেলার চেয়ে টি টোয়েন্টি লিগে খেলে রোজগার করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্রিস গেল, ডোয়েন ব্রাভো, কায়রন পোলার্ডরা সেই জেহাদি গোষ্ঠীর ক্রিকেটার। ভারতে ওসবের নামগন্ধ নেই। একাধিকবার খেলোয়াড়দের সংগঠন ঘোষিত হয়েছে। রথী-মহারথীরা তাতে যোগও দিয়েছেন। কিন্তু বোর্ড সেগুলোকে স্বীকৃতি দেয়নি। যেহেতু এ-দেশের ক্রিকেট তারকাদের মতো লক্ষ্মী ছেলে আর কোথাও নেই, সেহেতু স্বীকৃতির জোরালো দাবি করা হয়নি; বিবাদ-বিসম্বাদও হয়নি। সংগঠনগুলো কবে তৈরি হলো, আর কবে উঠে গেল- তা তখনকার সদস্যরা নিজেরাও বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে ক্রিকেট মনোপলি ফ্র্যাঞ্চাইজের যুগে পৌঁছে গেলে অন্য অনেক দেশের ক্রিকেটাররা হয়তো একজোট হয়ে দাবিদাওয়া আদায় করতে পারবেন, এ-দেশের কয়েকজন বিরাট তারকা ছাড়া বাকিরা স্রেফ খাবি খাবেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররা এতদিন ছিলেন আধা-সরকারি সংস্থার পুরো সময়ের কর্মচারী, যাদের অবসরে অন্যত্র কাজ করে রোজগার করার স্বাধীনতা ছিল। এবার শতকরা একশো ভাগ কর্পোরেট চাকুরে হয়ে ওঠার দিন শুরু হতে যাচ্ছে। কর্পোরেট চাকুরে মানে যে আসলে সাদা কলারের ক্রীতদাস, সেকথাও তাঁরা টের পাবেন কয়েক বছরের মধ্যেই। ইতিমধ্যে আধা-সরকারি সংস্থাগুলো জাদুঘরে পরিণত হবে।
(মতামত লেখকের)
সূত্র:
১। https://www.newindianexpress.com/sport/cricket/2022/aug/21/concerns-over-moeen-alis-availability-as-csk-announce-players-for-csa-t20-league-2489912.html
২। https://www.hindustantimes.com/cricket/trent-boult-gives-up-central-contract-intensifies-a-debate-101660142729250.html
৩। https://www.thehindu.com/sport/football/napoli-boss-aurelio-de-laurentiis-african-cup-chelsea-koulibaly-respect-afcon-comments/article65725097.ece