লোকসভা ভোটের সবচেয়ে বড় ঘুঁটি রামমন্দির? সমীক্ষায় ফাঁস বিজেপির যে অকল্পনীয় ছক
CSDS-Lokniti 2024 pre-poll survey: আজ থেকে নয়। প্রায় তিন দশক ধরে দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে অযোধ্যার রামমন্দির। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে হিন্দুত্ববাদীরা। তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন বিজেপি সরকার।
২০২৪ লোকসভা ভোটের বছর। সেই ভোটকে সামনে রেখে বহুদিন আগে থেকেই ঘুঁটি সাজিয়েছে বিজেপি। আর সেই ঘুঁটিতে ভর করেই কার্যত ভোটমুখী বাজেটকে লোকমুখী করার সামান্য চেষ্টাটুকুও করেনি সরকার। ভোটের আগে আগে ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি এসে একটু বিজেপিকে অস্থির করলেও গোড়া থেকেই আত্মবিশ্বাসী ঠেকেছে মোদি-শাহ জুটিকে। সিএএ-এনআরসি থেকে শুরু করে গোটা দ্বিতীয় দফা জুড়ে যে যে তাস সাজিয়েছে বিজেপি সরকার, তার সবচেয়ে বড় তাস বোধহয় ছিল রামজন্মভূমি।
ভোটের আগে থেকেই গোটা বছরটাকে সেভাবেই সাজিয়েছিল বিজেপি। এলাহি আয়োজনে অযোধ্যায় উদ্বোধন হয়েছে রামমন্দিরের। প্রায় একমাস জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, পুজোআচ্চা থেকে শুরু করে রামমন্দিরকে ঘিরে বিজেপি সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপকে মোদি সরকার কৌশলে ভোটের প্রচার হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কার্যত রামমন্দিরের গায়ের শৈল্পিক কাজের মতো মানুষের মাথায় খোদাই করে বসিয়ে দিতে চাওয়া হয়েছে হিন্দুত্ববাদের প্রবল ভাবকে।
আজ থেকে নয়। প্রায় তিন দশক ধরে দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে অযোধ্যার রামমন্দির। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে হিন্দুত্ববাদীরা। তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন বিজেপি সরকার। হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র রথের সামনের সারিতে সেদিন ছিলেন তরুণ মোদি। অটলবিহারীর সেই বিজেপি সরকারের সঙ্গে আজকের বিজেপির যতই তফাৎ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হোক না কেন, ভুললে চলবে না সেদিন বাবরি হামলার মুখ ছিলেন কিন্তু লালকৃষ্ণ আডবাণীরাই। আর সেই ব্যাটনই হাতে তুলে নিয়ে তাদের অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা।
আরও পড়ুন: ২০১৪: মোদিকে যেভাবে মসনদে বসিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর
সেই ৯০-এর দশকে রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ জুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তুলতে সফল হয়েছিল বিজেপি। বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে। যেখান থেকে কার্যত ফিনিক্সের মতো উত্থান হয়েছে বিজেপির। আজও এই উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বিজেপির জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি, অযোধ্যায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল রামলালার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় দাঁড়িয়ে উঠল পেল্লাই এক মন্দির। রামমন্দিরের প্রতিটি ইঁটে কাঠে পাথরে বিজেপি খোদাই করে রাখল তাদের দলের কৃতিত্ব। মানুষের মাথায় বসিয়ে দেওয়া গেল, রামমন্দির এবং হিন্দুর সামগ্রিক গৌরবকে পুনরুদ্ধারের নেপথ্যে রয়েছে দল বিজেপি।
সিএসডিসি-লোকনীতির ভোটপূর্ব সমীক্ষায় সামনে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। রামমন্দির উদ্বোধনের মাস দুয়েক পরবর্তী সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই রামমন্দির কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ মানুষের মাথায় বসে রয়েছে বিরাট এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে। সেভাবেই তাস সাজিয়েছিল বিজেপি। গোটা দেশ যখন সেই রামমন্দিরের উদ্বোধনকে মন খুলে স্বাগত জানিয়েছে, একই ভাবে এ দেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মানুষের মনে এই রামমন্দির এক নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগিয়ে তুলতেও কিন্তু কম সাহায্য করেনি। কার্যত রামমন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে এক জাতীয় অনুষ্ঠানের মাপে তুলে ধরেছে বিজেপি। ক্রমে অযোধ্যার রামমন্দির ইস্যুকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে বিজেপি,যা ভোটাররা বুথ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে। স্বাভাবিক ভাবেই তা যে বিজেপিকে অতিরিক্ত কিছু ব্রাউনি পয়েন্ট দেবেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সিএসডিসি-লোকনীতির ভোটপূর্ব সমীক্ষায় মানুষকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, বিজেপি সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় বা পছন্দের পদক্ষেপ কোনটি, তখন উত্তরদাতাদের মধ্যে অন্তত ২২ শতাংশ রামমন্দির নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতারা মেনেছেন যে এই মন্দির নির্মাণ হিন্দুদের পরিচয়কে সুসংহত করতে সাহায্য় করবে। এবং এই বিশ্বাস যত না বেশি এ সমাজের মেয়েদের, তার চেয়ে বেশি ছেলেদের। অন্তত ৪৯ শতাংশ পুরুষ এর পক্ষে রায় দিয়েছেন। ৪৬ শতাংশ মহিলার ভোটও একই কথা। সমাজের সব ধরনের হিন্দুদের মধ্যেই এমন একটা ধারনা কাজ করছে বলে জানাচ্ছে সমীক্ষা। শহরের অন্তত ৫২ শতাংশ মানুষের জবাব থেকেছে রামমন্দিরের পক্ষে। গ্রামীণ উত্তরদাতা ছিল ৫০ শতাংশ। আরও একটা বিষয় চোখে পড়েছে, তা হল পূর্ব বা দক্ষিণ ভারতের তুলনায় এই রামমন্দির ও হিন্দুত্বের জাগরণের দিকে বেশি ঝুঁকে রয়েছে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মানুষই।
আরও পড়ুন: বিজেপিতে গেলেই ফাঁড়ামুক্তি! দেশের ২৩ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে যেভাবে বাঁচিয়েছে মোদি সরকার
অযোধ্যার রামমন্দিরের ইস্যুর মধ্যেই যে ধর্মীয় বিভাজনের একটা বীজ পোঁতা ছিল গোড়া থেকে, তাতে সন্দেহ নেই। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক প্রার্থনাস্থল বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেই জায়গায় প্রায় তিরিশ বছর পরে গড়ে উঠল হিন্দুদের রামমন্দির। এই রামমন্দির যে দেশের ধর্মীয় বিভাজন আরও চওড়া হয়ে উঠবে, তাতে একমত হয়েছেন অনেকেই। প্রতি পাঁচ জনেক মধ্যে দু'জনের বেশি মানুষ বিশ্বাস করেছেন, বিজেপির এই পদক্ষেপ ধর্মীয় বিভাজনকে স্পষ্ট করে তুলবে।
আসলে বৃহত্তর সমর্থন অর্জন করতে গেলে ক্ষুদ্র কোনও একটি অংশকে একটি ইস্যুতে পৃথক করে দেওয়া জরুরি। হিন্দুত্ববাদের জোয়ার তুলে দেশের সংখ্যালঘুকে কোণঠাসা করার ব্রহ্মাস্ত্র ছিল এই রামমন্দিরকে, যা বিজেপিকে সাহায্য করেছে বিরাট একটা জনসমর্থনকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে। যাকে আরও মজবুত করবে সিএএ-এনআরসি-র মতো বিজেপি সরকারের পদক্ষেপ। ২০২৪ লোকসভা ভোটে বিজেপির আত্মবিশ্বাসের নেপথ্যে আসলে রয়েছে সেই তাসই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর, অনেকেই বলেছেন, এই ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ফের মসনদে বসতে চলেছে বিজেপি সরকার। রামমন্দিরের নির্মাণ ও উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বহু দিন আগে থেকেই ২০২৪ লোকসভা ভোটের প্রচারের অর্ধেক কাজ সেরে রেখেছে বিজেপি। এখন ভোটের ফলাফল শুধু সময়ের অপেক্ষা, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।