সাইকেল: অমৃতা সরকার
Bengali Short Story: বীরুর দুই কাঁধ ধরে খাড়া করানোর চেষ্টা করতেই, হাউমাউ করে ওঠে অত বড় জোয়ান মদ্দাটা! কালী এতক্ষণ বোঝে নাই বীরু আসলে ফোঁপাচ্ছিল।
সন্ধ্যা ঝাপট মেরে ডুব দেয় কচুয়ার বিলে। খাটো দিনের বেলা,পানিকউড়ির ডানা ভালো মতো শুকানোর আগেই, তিস্তার ফেলে যাওয়া খাতে আন্ধার নামে। সারাদিনে টাকি, খোলসা মিলায়ে ছয় সাতটা মাছ মারতে পেরেছে কালী। অবশ্য মাছ বেশি পায় নাই বলে বিশেষ হেলদোল আছে, মনে হয় না। তার ভালো লাগে নেশা করতে। বিহানে খালপাড়ের হিমে সাদা হয়ে থাকা ঘাসে লেপ্টায়ে বসতে গিয়ে শিরশিরানি টের পায় সে। মাথার উপর রোদ চড়তে থাকলে পাছার কাপড় শুকায় আসে। এক দৃষ্টিতে ফাতনার দিকে তাকায়ে নেশা লাগে। এই সময় খিদাও চাগাড় দেয় না, বা দিলেও সে বোঝে না। খালের জলে বাতাস বিলি কাটে। খালপাড়ের বাঁশঝাড়, জিগা গাছ, জিগা গাছের গায়ে ঠেসান দেওয়া ধুন্ধুলের জাংলা খালের বুকে নড়াচড়া করে। জলের কয়েক হাত উপরে সাদা ধোঁয়ার আস্তর পড়ে, কালীর ভোঁতা কান ফালা ফালা করে দেয় উলুর আওয়াজ। হুঁশ আসে। ঝিমায় থাকা মাছগুলা হঠাৎ ডোঙায় খলবল করে ওঠে। পেটের মধ্যেও কী যেন খলবলায়। সকালের রান্না করা খেসারির ডাল আর ভাত টানে এখন তাকে। রান্না সে নিজেই করে। নিজেই খায়। খাওয়া হয়ে গেলে একটাই থালা অনেক সময় নিয়ে মাজে। এই সময় তার ভোঁতা কান বেশি বেশি শুনতে পায়। কুয়ার পেটের থেকে যে আওয়াজ উপরে উঠে আসে, শুনতে পায়। মুলিবাঁশের বেড়ার ছোট ছোট ফুটা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে অনেকদিন তেল না পাওয়া সাইকেলের চেন ঘোরার আওয়াজ, হাওয়াই পরা পায়ের, না পরা পায়ের আওয়াজ, কান না পেতেও এই সমস্ত আওয়াজ শোনার আওতায় চলে আসে। তাতে তার হাত থামে না। প্রত্যেকটা বিচি আলদা করতে চোখ সরু হয়। বিচি ফেলে পাতা ডাটি হাতের তালুতে নিয়ে আস্তে আস্তে ডলে। ডাটি ছেড়ে আসলে,পাতা গুঁড়া গুঁড়া পড়ে থাকে তালুর গরম ভাপে। কল্কের ভিতরে গিট্টি ভরে, অল্প অল্প করে পাতা হালকা করে চেপে দেয় যখন, বুক ধড়ফড় করে। রোজ এই এক কাজ করলেও রোজই তার এমন হয়। একদম শুরুর লম্বা টানটা দেওয়ার পর একটু হালকা লাগে। দুই কানের ভিতরের রাস্তা দিয়ে বাতাস বয়। দুই হাত পায়ের বিশ আঙুলে ঝিঁঝিঁ ডাকে। ধান কাটা চলে বুকের ভিতরে। প্রতি নিঃশ্বাসে একটা করে কাস্তের হ্যাচকা মাপ মতো টান। তারপর ধানের বোন্দা আছড়ানো চলে উলটানো কুয়ার রিঙে। খালি চোখ ছাড়া আর কিছু খোলা রাখা যায় না। নাকে, কানে যাতে ধান না ঢোকে তাই মুখ মাথা কাপড়ে চাপা থাকে। চোখ নিচু করে ধান ঝাড়ে কালী। ভর ওঠে যেন। ধানের ঢিব উঁচু হয়, তার হাত আর তার নিজের থাকে না। মজুরি দুই পয়সা কম দিলেও সে এই কাজে রাজি থাকে। কাজ ভালো পারে ,নাকি, মজুরি কমেও পোষায়, নাকি, কম কথা বলে, নাকি, ঘরের বাইরের সব কাজই চালিয়ে নেওয়া যায়, নাকি, এই সব কয়টা কারণেই তাকে ডাকাডাকি করে নমপাড়ার অনন্ত বিশ্বাস; অত কথা ভাবে না কালী। ভাবতে গেলে হালকা মাথা ভারি হয়ে যায়। ভাঁজ করে রাখা চোখও টান করতে হয়। তার চেয়ে নিজের ঘরের পিড়ায় বসে কালী পা ছেতরে দেয়। বিচাকলার জঙ্গলে তিনটা আগুনের ফুল অন্ধকারে ঝোলে। দোল খায়। এ নিচে যায় তো ও ওপরে আসে। কালী মন সরু করে দেখে। দেহও তার সরু হয়ে মিলায় যায় মুলি বাঁশের বেড়ায়।
“কাকি, বাড়িত আইছুন নাহি?” কালীর কান দুইটা কি মাথার দুই পাশ থেকে উড়াল দিল! কোন পিরিতের ভাস্তা ডাকাডাকি করে! ঠোঁট ফাঁক করার আগেই কথা ছিটকায়
“কুন নডির ঘরের নডি আইসস রে?”
“হুনেননি, ল্যাপ ক্যাতাডি রোইদ দেওন লাগবো, কাইল বাড়িত আয়েন নাইলে অইবো না কামডি”
“ক্যান অইবো না! তোর মা নডি মাগী মরসে নাহি?”
কোনও সাড়া শব্দ নাই, মিঠুন ঠিক করল ভিতরে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া এতক্ষণ জংলায় দাঁড়িয়ে থেকে মশার কামড়ে পা ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। সে আর বীরু মিলে কম করে দশটা বিড়ি ফুঁকে ফেলছে খালি এইটা ঠিক করতে যে কালীর ঘরে এখন যাওয়া ঠিক হবে কিনা। বীরুটার আজকে দুঃখের দিন, ক্লার্কশিপের পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে। পাশ করতে পারে নাই,তার উপর সুতপা ডিরেক্ট জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে অসম্ভব। বাড়িতে বলতেই পারবে না। বেকার ছেলের সঙ্গে এতদিন প্রেম করে তার অনেক সময় খরচা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস হাটবার, তাই মিঠুনকে সে পাকড়াও করতে পারে বোয়ালমারীর স্কুলের মাঠে। হাট করতে আসে নাই মিঠুন। বাপে তাকে হাট বাজার করতে দেয় না। সে খালি ডাবলুবিসিএসের জন্য বই উলটায়। প্রিলিমস পেয়ে গেছে আর মেইন্স নিয়ে বুক ডিবডিবানি যা ছিল সব শেষ। মণ্ডল কমিশনের বিল পাশ হয়ে গেছে গত আগস্ট মাসে। বন্ধুর দাগা খাওয়া মনে মলম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে তার। এখন বুড়ি মাল দিলে হয়। দিবে নাই না কেন! নিজের উঠানেই তো ফলায়। মাগনায় নেবে না মিঠুন। বীরুটাকে দুই ছিলিম টানিয়ে রসের কথা বার করতে হবে পেট থেকে। কাঁচা প্রেমের ব্যথাও বেশি। রগড়ও বেশি। মেয়েটার নাম শুনলেই বীরু এখন বিড়বিড় করে! খিস্তিই মারে মনে হয়। মেয়েফেয়ের চক্করে পড়ে ফেল মেরে লাভ কী হল? এই জন্যই মিঠুন পাখির চোখ ঠিক করে নিয়েছে আগেই। চাকরিটা পেয়ে গেলেই সে লাভ ম্যারেজ করবে। ফর্সা, সুন্দর, শিক্ষিত,বাপের এক বেটি খুঁজে পেয়েই যাবে। ট্যাঁকে চাকরি থাকলে সব হবে ভাই। তখন আর ফাঁকা বিছানায় পোস্টারের শ্রীদেবীর দিকে চায়ে চায়ে হাত মারতে হবে না। মিঠুনের মনের ভিতর টুংটুং করে সুখের দোতারা বাজে। কিন্তু মুখটা পচা কলার মতো করে রাখতেই হয়। যদিও অন্ধকারে থোড়াই দেখতে পাবে বাঞ্চোতটা। বোয়ালমারী স্কুলে এক ক্লাসে পড়ত। বাপ স্কুলের সেক্রেটারির বাড়ির খাস পুরুত, ব্যাটা খুব মটমটাতো। ক্রিকেটে আউট করলেই বালটা হাতে পৈতা জড়ায়ে অভিশাপ দেওয়ার থ্রেট দিত। ফুটবলে ল্যাংয়ের পর ল্যাং মারলেও রেফারি ফাউল দিত না বোকাচোদাটার বেলা। এখন নিজের সঙ্গেই এমন ফাউল হয়ে গেল। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় মিঠুনের। বেচারা বীরু।
আরও পড়ুন- তিরচিহ্ন: যশোধরা রায়চৌধুরী
কালীর উঠানে পাতা পোড়ার গন্ধ নাকে সুলসুল করে। এই দিকে খুব একটা মানুষের আনাগোনা থাকে না সন্ধ্যার পর। একা বিধবার জীবনে যে সব ফালতু উৎপাত থাকে, কালীর সেসব নাই। তার মদ্দা মদ্দা গড়ন আর ধরন এসব ঝামেলায় ফেলে না তাকে। আজকে এই দুই চ্যাংড়া কীসের গন্ধে এসেছে, জানে কালী। মেজাজ খারাপ থাকলে ভাগতে বলতো। এখন কিছুই বলতে ইচ্ছা করে না। কামলা-কাজের বাহানায় আসছে, আসুক। মর্জি হইলে যাবে কাল। বীরু অনেকক্ষণ ধরে ঝিম পাড়ে কল্কেটা হাতে নিয়ে। তারপর কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে এগিয়ে দেয় মিঠুনের দিকে। বীরেশ্বর চকোত্তি, এই গোটা চরের এক মাত্র বামুন বাড়ির এক মাত্র ছেলে, বক মধ্যে হংস যথা। চাকরিটা এমন করে ফসকাবে, ভাবে নাই। সুতপাও রাতারাতি এমন চোখ উলটাবে, ভাবে নাই। বাপের মতো পুরুতগিরি করতে হবে কিনা এই ভাবনা মাথায় কিলবিলালে, হাত নাড়িয়ে ভাবনা তাড়ায় বীরু, নাকের সামনের ধোঁয়াটা এতক্ষণ জমাট হয়ে ছিল, এখন তিন চারটা ভাগ হয়ে গুটলি পাকিয়ে যায়। বীরুর ঘিলুও কি এমন গুটলি পাকিয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু সে বরাবর জানত, সে আলাদা। তাদের বাড়ির একটা ধরন ধারন আছে, পয়সা থাকলেই হয় না যেসব। অনেক পুরুষের অভ্যাস। সব আচারবিচার মন দিয়ে মানে তারা। এই ছোটলোকদের ওঠবস করলেও তারা আলাদা। এই ভাবনাটায় একটা খুব গোপন উত্তেজনা আছে, সেটা কোথা থেকে আসে বীরু জানে না। কিন্তু আসে। কিন্তু এখন এই ছোটোলোক মিঠুনটার সামনে কেমন খাটো খাটো লাগে নিজেকে। কেমন কেলিয়ে পড়ে আছে গাধাটা। এক চিলতি চাঁদ বাঁশঝাড়ের শেষ ডগাটায় গেঁথে আছে। ময়লা আলোয় জংলাটাকে দেখা যাচ্ছে কবন্ধের মতো। জংলা পার করলেই বাঁধ শুরু। বাঁধের একদিকে তিস্তা নামে মাত্র। জলের দেখা পাওয়া যায় না এই সময়। নজর যায় যতদূর, বালি ছাড়া আর কিছুই নেই। শীতের আগে আগে শুধু পলতা পাতা বিছিয়ে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া। বুকের কাপড়ে টান পড়েছে নদীর । এদিক ঢাকে তো ওদিক ঊদোম হয়ে যায়। চরের মধ্যে কোথাও কোথাও জল আটকে আছে। বীরুর এই মুহূর্তে সব লাথিয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। মিঠুনের কাঁকালে মনে মনে সে একটা লাথি ঝাড়ে। বোকাচোদা এসেছে ওকে সান্ত্বনা দিতে! এক ছিলিমে পাতা টানলেই তার সমান হবে চাঁড়ালের বাচ্চা! সুতপার দিকে নজর ছিল না ওর! বন্ধুত্ব চোদাতে এসেছে!
“আমি তোকে আগেই সাবধান করসিলাম না? ওই মেয়েটা সুবিধার না, স্বার্থপর,” কালীর দিকে এক ঝলক দেখে গলা নামিয়ে বলে মিঠুন, “এই জাতটাই স্বার্থপর রে!”
“হু”
“আর এর জন্য তুই ফেল মারলি, আগে সাবধান করসিলাম”
দুইবার সাবধান বলে কী বোঝাতে চায় বালটা, “চুপ কর বোকাচোদা, তুই শালা রিজার্ভেশন কোটার মাল, বেশি কপচাবি না শালা,” একবারে না ছেড়ে ধোঁয়া তিন লপ্তে ছাড়ে বীরু, ধুনকিটা ডিরেক্ট মাথায় হিট করেছে।
খিস্তি, না কোটা, কোনটায় বেশি মাথাগরম করবে ঠিক করতে না পেরে মিঠুনের জিভ টাগড়ায় আটকে যায়, “ক ক কী বললি! তোর বাপ প্রিলি পাশ করসে আমার হয়ে?”
আওয়াজ না করে হাসে বীরু, মজা লাগে মিঠুনের তোতলামিতে, “চাঁড়ালের বাচ্চাদের জন্য কমিশন পাকা ব্যবস্থা করে দিসে, কম নম্বর পাইলেও পাশ!”
“আসনাই করার সময় মনে ছিল না? পাশ করো নাই নিজের জন্য, এখন জাত মারাচ্ছো? জাত ধুয়ে জল খাও গা যাও,” কল্কেটা এগিয়ে দেয় মিঠুন। হাত না বাড়িয়ে,মুখটা বাড়ায় বীরু, প্রত্যেকটা শব্দ পষ্ট করে মিঠুনের কান অবধি পৌঁছয় যাতে, “হ্যাঁ , আমার পা ধোয়া জল চাটবি, তারপর উদ্ধার পাবি, যতই সরকারি চাকরি বাগা আর ভদ্রলোক সাজ, চাঁড়াল চাঁড়ালই থাকবি, তোর আসল জায়গা হইল এইখানে,” আঙুল দিয়ে নিজের পা দেখায় বীরু।
“কী বললি শুয়োরের বাচ্চা!” কল্কেটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মিঠুন। চ্যাঙড়াগুলার কথা এতক্ষণ কালীর কানে কিছু গেছে, কিছু যায় নাই। সে গড়ানো কল্কেটা তুলে ঘুরে দাঁড়াতে যেটুক সময় খরচ করে তার মধ্যেই ঘটে কাণ্ডটা। মিঠুন প্রথমে বীরুর সাইকেলে একটা লাথি কষায়, তারপর বীরুকে। অন্ধকারে টিপ ঠিক না হওয়ায়, কিংবা, নেশার ঝোঁক বেশি থাকায়, মোক্ষম কিকটা মিস হয়ে যায়। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে থপ করে পড়ে যায় মিঠুন।
আরও পড়ুন- জিহাদের বিষয়-আশয়: অভিষেক ঝা
সন্ধ্যা থেকে কালী এই চ্যাংড়াদের ভ্যাজভ্যাজ শুনেছে। নেশাটারই কেমন ছানা কেটে গেছে। “আবালগুলা বাড়িত যা, কাইজ্যা করতে হইলে বাড়িত গিয়া কর।“ মিঠুন জানে, এই ধুন্ধা বেডির হোদবোধ কম কিন্তু একবার মটকা গরম হইলে, মুখ যা ছুটাবে বাপ ক্যান চোদ্দ পুরুষের কানে তালা লাগবে। তাছাড়া দুই পয়সার নেশা করতে আইসে এমন ক্যাজরা হবে কে জানত! সাইকেলের স্যান্ড তুলে সে আর এক মিনিটও দাঁড়ায় না।
কার্তিকের রাতে আকাশে চাঁদ থাক বা না থাক, চরের বুক থেকে একটা ধোঁয়া ধোঁয়া আলো ফোটে। আধা কাটা ধান ক্ষেতে খটাস আর ইঁদুরের দৌড়াদৌড়িতে কাটা ধানের মোথাগুলা আরও মিইয়ে আসে মাটির সঙ্গে। ধান উঠে গেলে কলাই বোনা হবে। শিম, করলা পটলের মাচা বাঁধা হবে। সামনের দিনগুলায় কালীর কাজের অভাব নাই। ভাতের চিন্তা ছাড়া তার আর কোনও চিন্তাও নাই। পেটে-ভাতের চুক্তিতেই সে কামলা খাটে বেশিরভাগ দিন, রান্নার ঝামেলা বাঁচে। এই যে চ্যাংড়াগুলা কমিশন না কী একটা নিয়ে এত কাজিয়া করল, কমিশন কী ট্যাকাটুকা কিসু দিবে তার মতোন গরিব মানুষকে? গত বছর ব্লক অফিসে বিধবা ভাতার জন্য পরপর চারদিন গিয়ে বুঝে গেছে, সরকার ট্যাকা দিবে না। মাঝখান থেকে দিনের মজুরিগুলা মার যায়। কালী দেখে নাই এতক্ষণ,বীরু থপ করে বসেই আছে বারান্দায় খুঁটিতে ঠেসান মেরে। মাথাটা বুকের কাছে লটকাচ্ছে। নেশা বেশি করে ফেলছে ঠাকুরের ব্যাটা। বীরুর দুই কাঁধ ধরে খাড়া করানোর চেষ্টা করতেই, হাউমাউ করে ওঠে অত বড় জোয়ান মদ্দাটা! কালী এতক্ষণ বোঝে নাই বীরু আসলে ফোঁপাচ্ছিল। এক পলক মাথা আউলায় কালীর। ব্যাথা পাইসে নাকি ছ্যামড়া! নিমেষে টের পায় বীরুর তার বুক হাতড়াচ্ছে! তার মদ্দা শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে সে ঠেলা দিতে চায় বীরুকে। তার শুকিয়ে যাওয়া মাইয়ে মুখ ঘষতে থাকে বীরু। এবার কালী ঠেলা দেয় বীরুকে, জোরে, নিজের দিকে। শিরার মধ্যে পুরানা খেলার কায়দা কসরত ফস করে জ্বলে যায়। দুই পা দিয়ে বীরুর কোমড় আঁকড়ায় কালী। এরপর বীরুকে আর কিছু করতে হয় না। সে কেবল শুয়ে থাকে কালীর নিচে। আবছা জ্যোৎস্নায় বীরু কালীর হাঁ মুখটা দেখতে চায় না। চোখ না খুলে সে দাঁতে দাঁত চাপে। তবু দাঁতের ফাঁক দিয়ে, শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসে টুকরা টুকরা শব্দ, যা শুধু তার কানেই আসে, “সুতপাহহহহ… শাহহহলীহইইই , থোর মাহহহকে চুদি, থোর পুরা গুষ্টি চুদি”। চুলের মুঠি ধরে কালীকে উলটে ফেলে মুহূর্তে, “চাঁড়ালের বেটি, তুই আমাকে না করিস! কত জোর তোর মাজায় আজকে দেখবো”। সুতপার মাজার জোর বুঝে নিতে সে কালীর উপর দাপায়। দাপাতে দাপাতে মুখে গ্যাঁজলা তুলে নেতিয়ে পড়ে সে। কালী ঝটকা দিয়ে বীরুকে বুকের উপর থেকে ঠেলে দেয়, “তোর যত ত্যাজ মুখে! ঠাকুরের ব্যাডা!”
শেষ রাতের হিমে চরের বুক নরম হয়ে আসে। জারের সময় আসতে আরও কয় হপ্তা বাকি অথচ তেলকুচা পাতার চকচকে কালচে সবুজে সাদা পরত। জলের হদিস না পেয়ে পানাফুলগুলা খালের বাইরেও ফুটে আছে। কঠিন জান এগুলার। পায়খানা করতে করতে কালী চারদিকে নজর চালায়। পরেশ মণ্ডলের গলা অই দূর থেকে কানে আসে। তার গরুর দড়ি চুরি করসে কে বা! গোয়ালের বেড়া ভাইঙ্গে বার হয়ে, গরুটা সনাতনের বেগুন খেতে মুখ দিসে। এই কাজিয়া চলবে বেলা অবধি। কাজিয়া শুনতে খারাপ লাগে না কালীর কিন্তু আজকে সময় নাই। বিশ্বাসদের বাড়ি কামে যাইতে হবে। রান্ধতে হবে না। ওরা খাইতে দেয় ভালো, শেষবার ওদের বাড়ি যে পলতার ঝোল খাইছিল কালী, উফ ওই দিয়েই একথাল গরম ভাত সাপ্টায়ে খায়ে নেওয়া যায়। পায়খানা করে পেটটা হালকা হয়। কালীর খিদা পায় চনচন করে। পলতা পাতার ঝোল ভাত খাওয়ার হাউস জিভে আর মনে ঘোরাতে ঘোরাতে কালী বিশ্বাসদের বাড়ির পথ ধরে। বাঁহাতে পুরান কবরখানার রাস্তা নেমে গেছে নদীর দিকে। মুসলাদের বস্তি ছিল এখানে, ওপার থেকে ভাটিয়াদের এপারে আসার আগে। ওদের বাস উঠানোর পর, কবরখানাটা ডেউয়াগাছের জঙ্গল হয়ে আছে। পাখিতে খায়ে যত বিছন ছড়াইছে তাতে কবরখানা পুরাই ডেউয়া গাছে ঢাকা পড়ে গেছে। আগের থেকে না জানা থাকলে আর ধরার উপায় নাই ঝোপের নিচে সার সার কবর, একটা আরেকটার সাথে মিশে আছে। মাটি হয়ে যাওয়া মড়াগুলোর নাতিপুতি কেউ এখন রংপুর, কেউ বা ঢাকায়।
ডানদিকের পাকা রাস্তা থেকে নেমে আল দিয়ে খেত পাথালি হাঁটা দিলে মিনিট বিশেক লাগে অনন্ত বিশ্বাসের বাড়ি। এই বিহানবেলায় আলের উপর সাত আটটা মেয়েছেলে ব্যাটাছেলে জড়ো হইচে! এত লোক কামলা খটতে আসচে নাকি! তাইলে কি ধান কাটার জন্য ডাকসে ওরা কালীকে, নাকি ভিতর বাড়ির কাজ! ঠিকমতো না জাইনে আসা ভুল হইসে। খেতের কাম হইলে বাড়ি থেকে মুড়ি আনতে হইত সঙ্গে, ভিতর বাড়ির কাম না হইলে দুপুরে ভাতের দায় নিজের। জটলার কাছাকাছি এসে কালী সামনে তাকায়। জটলার মানুষের তুলে রাখা আঙ্গুল বরাবর, ধান মাঠের মধ্যিখানে খাপছাড়া কয়েকটা ঘোড়ানিম গাছ দেখা যায়। চোখের উপর হাত দিয়ে সকালের রোদটা আড়াল করলে দেখা যায় একটা প্রমাণ সাইজের মানুষ দোল খাচ্ছে ঘোড়ানিমের সব চেয়ে নিচের ডালটায়। যদিও এতদূর থেকে এক আঙুল পরিমাণই মনে হয়। সূর্যের আলো পড়ে গাছটার গায়ের সাদা হিমের আস্তর ঝিকাচ্ছে। খেত পার হয়ে গেলে, সব ভালো করে দেখা যেত আরও । তিন চারটা শিশিরের মোটা দানা মিলে মিশে একটা লাইনে নেমে আসছে ঘোড়ানিমের গা বেয়ে। ঘোড়ানিমের সবটা ফুল এখনো ঝরে শেষ হয় নাই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লাশের চুলে আটকে আছে কয়েকটা, ঝড়তি পড়তি এক দু'টা লেপটে আছে ঝুলন্ত বাঁ পায়ের আঙুলে লেগে থাকা পায়খানার সঙ্গে। এত সব দেখতে হলে সামনে আসতে হতো। জটলা ততক্ষণে বেড়ে গেছে আয়তনে। নড়াচড়া করছে । পুলিশ না পৌঁছনো অবধি ভিড় হালকা হবে না। ফাঁড়ি থেকে আসতে ঘণ্টা খানেকের কম না। ততক্ষণ অব্ধি কেউ লাশের কাছে এগোবে না। কালী দাঁড়িয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করে, ঘোড়ানিমের গায়ে তো কোনও সাইকেল ঠেস দেওয়া নাই । সাইকেলটা কোথায় রাখল বীরু?