নিমেষে তছনছ হয়ে যায় জীবন! কেন এত শক্তিশালী হয় রেমালের মতো ঘূর্ণিঝড়?

Cyclone Remal: বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন, একটি অতিমাত্রায় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে যে পরিমাণ শক্তি থাকে, তা পৃথিবীর উৎপন্ন শক্তির প্রায় ১০০ গুণ!

বছর চারেক আগে মে মাসেই আমফানের তাণ্ডব দেখেছে দুই বাংলা, ওড়িশার মানুষজন। করোনা মহামারীর মাঝে দিন কয়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল জনজীবন। বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সাধের তিলোত্তমা কলকাতাও। বছর তিনেক আগে আরেক মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সাক্ষাৎ পেয়েছিল দুই বাংলার মানুষ। বছর এগারো আগে আয়লার স্মৃতি এখনও অনেকের কাছেই টাটকা। তছনছ হয়ে গিয়েছিল উপকূলবর্তী এলাকার মানুষজনের টিনের চাল, ঘর, বাড়ি, ভেসে গিয়েছিল গবাদি পশু। সেই মে মাসেই! এই মে-তেও আরেক ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল' চিন্তাগ্রস্থ করেছে উপকূলবর্তী এলাকার মানুষকে। ভবিষ্যতেও হয়তো কোনও এক মে মাসেই আমফানের থেকেও শক্তিশালী কোনও সাইক্লোনের সাক্ষী থাকবে বাংলার মানুষ। নাম যতই খটোমটো হোক না কেন- এর শক্তি কিন্তু সাংঘাতিক। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় এত শক্তি পায় কোথা থেকে? তার আগে দেখা যাক কীভাবে তৈরি হয় এই ঘূর্ণিঝড়?

ঘূর্ণিঝড় প্রকৃতির এক আশ্চর্য বিস্ময়। আজ থেকে বছর ৫০ আগে, যখন ইন্টারনেট ছিল না, রেডিওতে ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেলেই মানুষজন সহায়-সম্বল নিয়ে কোনওমতে বাঁচার চেষ্টা করত। এখন ঘূর্ণিঝড়ের আভাস পাওয়া মাত্রই মোবাইল নিয়ে প্রায় সকলেই বসে যান তার যাত্রাপথ দেখতে। কেমন ঘূর্ণিবাজির মতো পেঁজা তুলোর কুণ্ডলী যেন এগিয়ে আসছে, ধীর গতিতে। উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে আমরা তার গতিবিধির উপর এখন নজর রাখতে পারি প্রতি মুহূর্তে।

ঘূর্ণিঝড়ের নামের ভিতরেই একটা 'ঘূর্ণি' ঢুকে বসে আছে। ঘূর্ণিঝড়ের ছবিতেও আমরা একটা ঘূর্ণি দেখতে পাই। কীসের এই ঘূর্ণি? কোনদিকেই বা ঘোরে এই ঘূর্ণি? দেখা গেছে, দক্ষিণ গোলার্ধে এটি ঘোরে ঘড়ির কাঁটার দিকে, আর উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে। খুব সহজ একটা পরীক্ষা করেই আমরা এর সত্যতা যাচাই করতে পারি। ধরা যাক, কেরোসিন মাপার দু'লিটার ফানেলের নির্গম নলের মুখ বন্ধ করে, তাতে জল ভরে এবার নীচের নির্গম নলটাকে খুলে দেওয়া হলো। দেখা যাবে জল সোজাসুজি না পড়ে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে পাক খেতে খেতে নীচে পড়ছে। দক্ষিণ গোলার্ধে এই পরীক্ষাটি করলে জল ঘড়ির কাঁটার দিকে পাক খেতে খেতে নীচে পড়বে।

আরও পড়ুন- নারী-পুরুষের মিলনে জন্মাননি! খোদ ঈশ্বর প্রেরিত দূত মোদি! প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করেন?

এই ঘূর্ণিঝড়ের ভেতরে আপরিসীম শক্তি থাকে। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন, একটি অতিমাত্রায় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে যে পরিমাণ শক্তি থাকে, তা পৃথিবীর উৎপন্ন শক্তির প্রায় ১০০ গুণ! কিন্তু এত শক্তি আসে কোথা থেকে? সোজাসাপ্টা উত্তর, সমুদ্রের জল থেকে। সমুদ্রের জলের রূপ যতই নয়নাভিরাম হোক না কেন, এর ভিতরে যে এত প্রলয়ঙ্করী ক্ষমতা আছে, তা ঘূর্ণিঝড় বিনা বোঝা দায়। সমুদ্রের জল থেকে কীভাবে শক্তির জোগান হয়? পদ্ধতিটা বেশ মজার। গ্রীষ্মের শুরুতে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা যখন ২৬-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছয় সেই সময় সমুদ্রের জল থেকে ঘূর্ণিঝড় শক্তি সংগ্রহ করে। শীতকালে তাপমাত্রা যেহেতু কম থাকে, তাই এই সময় ঘূর্ণিঝড়ের হ্যাপা আমাদের পোহাতে হয় না।

আপনাআপনি কখনই ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না, এর জন্য নিম্নচাপের প্রয়োজন হয়। নিম্নচাপ কী? ছোটবেলার ভূগোল বই মনে করলেই দেখা যাবে, বায়ুমণ্ডলের কোনও অংশে বায়ুর চাপ কমে গেলে, চারপাশের বায়ু সেখানে ছুটে আসে। জল ভর্তি ফানেলের নীচের নল খুলে দিলে তরল যেমন ঘুরতে ঘুরতে নামে, তেমন আর কী। অর্থাৎ বাতাসের ছুটে আসার মধ্যে একটা ঘূর্ণনের গন্ধ আছে। সেই ঘূর্ণনকে আরও শক্তিশালী ও ঘূর্ণিঝড় উপযোগী হতে হলে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই বাড়তি শক্তি পাবে কোথা থেকে? আবারও সোজাসুজি উত্তর, সমুদ্রের জল থেকে। কিন্তু কীভাবে? প্রক্রিয়াটি খুবই সরল ও মজাদার। আগে কলকাতা মেট্রোতে যখন এসি রেক ছিল না, অফিস টাইমে ভিড়ে ঠেলঠেলি করে ঘেমে নেয়ে যখন প্লাটফর্মে নামতেন, তখন প্লাটফর্মের ঠান্ডা হাওয়ায় জীবন জুড়িয়ে যেত। ছোটবেলার ভৌতবিজ্ঞান বইতে পড়া বাষ্পায়নের গল্প। ঘেমো শরীর শোকানোর জন্য যে তাপের দরকার, তা শরীর থেকেই গৃহীত হয় বলে ঠান্ডা অনুভূত হয়। জলকে বাস্পীভূত করা হলে জল তাপ গ্রহণ করে। উল্টোটাও তাহলে সত্যি, অর্থাৎ জলীয় বাষ্প যখন জলকণায় রূপান্তরিত হয় তখন সে তাপ উদগীরণ করে। একই ঘটনা ঘটে ঘূর্ণিঝড়ের বেলায়।

সমুদ্রের জল বাস্পীভূত হয়ে ওপরে উঠে আবার জলকণায় পরিণত হওয়ার সময় তাপ বর্জন করে। সেই তাপশক্তির ফলে বাতাস গতিশীল হয়ে পড়ে ও দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে। পদার্থবিদ্যার মৌলিক নিয়মানুসারে শক্তির সঙ্গে বেগের সম্পর্ক সমানুপাতিক। বাতাসের তাপমাত্রা বাড়লে, গ্যাসের অণুগুলির কম্পন বাড়বে। ফলে দু'টি অণুর মাঝে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল কমতে থাকে। সেইসঙ্গে অণুগুলির ছোটাছুটি বেড়ে যায়। বায়ুর ঘূর্ণন যখন আরও বাড়ে, তখন নীচের সমুদ্রের জল আরও দ্রুত বাস্পীভূত হতে থাকে। ফলে সেই বাষ্প উপরে উঠে আরও তাড়াতাড়ি তাপ বর্জন করতে থাকে। এটা একটা চক্রাকার প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি বাড়তে থাকে অনবরত।

খুব সাধারণ একটা পরীক্ষা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা সহজে বোঝা যায়। ভাতের হাঁড়িতে জল ভরে উনুনে বসালেই দেখা যাবে গরম জল আস্তে আস্তে উপরে উঠে যায় আর ঠান্ডা জল হাঁড়ির ধার বরাবর নীচে নেমে আসে। সেখান থেকে আবার গরম হয়ে উপর উঠে যায়। এভাবে অনবরত একটা পরিবহণ চলতে থাকে, তাপটুকু জলের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে থাকে। ঘূর্ণিঝড়েও একই ঘটনা ঘটতে থাকে। সমুদ্রের জল বাস্পে রূপান্তরিত হয়ে ওপরে উঠে জলকণায় রূপান্তরিত হয়, সঙ্গে কিছু তাপও উদগীরণ করে। ঘূর্ণিঝড়ের বাইরের দিকের বাতাস আবার নীচে নেমে আসে ও ঘূর্ণনের মাঝের অক্ষ বরাবর আবার উঠে যায়। পুরো প্রক্রিয়াটা একটা চক্রাকার পদ্ধতি, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে 'সাইক্লিক প্রসেস'। যতই প্রক্রিয়াটি ঘটে, ততই আরও ঘটার ইন্ধন জোগায়। ব্যাপারটা অনেকটা ইলেকট্রনিকসের 'পসিটিভ ফিডব্যাক আমপ্লিফায়ারের' মতো। প্রক্রিয়ার ফলাফল তার চালিকাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে। ফলস্বরূপ ঘূর্ণিঝড় তার অমিত শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসে।

একটা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হওয়ার পর তার কেন্দ্রে ৩০-৪০ কিমি জায়গা জুড়ে একটা শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। আবহাওয়াবিদ্যার পরিভাষায় একে বলে ঘূর্ণিঝড়ের 'চোখ'। এই চোখকে কেন্দ্র করেই ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব নৃত্য করে। এটি যখন উপসাগর, সাগর বা মহাসাগরের উপর দিয়ে বয়ে যায় তখন বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি করে না, যখন উপকূলে আছড়ে পড়ে তখন টের পাওয়া যায় তার আসল শক্তি। নিজের চোখে যারা ঘূর্ণিঝড় প্রত্যক্ষ করেছেন, বিশেষত আমফানের সময়, দেখেছেন, প্রথমে বাতাস একদিক থেকে অন্যদিকে প্রচণ্ড বেগে বইতে শুরু করে। তারপর কিছুক্ষণ শান্ত থাকে। লোকজন বাইরে বেরিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখতে দেখতেই ঘূর্ণিঝড়ের চোখ এলাকাটিকে অতিক্রম করে অন্যদিক থেকে আবার প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করে।

আরও পড়ুন- ৫১ বছর আগে যে ঘূর্ণিঝড় জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশের

সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার পর সেটা যখন উপকূলে ধেয়ে আসে, সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। আমাদের চেনা ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢেউয়ের উচ্চতা হয় ২০-৩০ মিটার। বিশাল জলাঘাতে ধূলিস্যাত হয়ে যায় সাজানো উপকূল।

ঘূর্ণিঝড় আসলে প্রাকৃতিক এক ইঞ্জিন-যার মূল চালিকাশক্তি হলো সমুদ্রের জলের তাপ। যদি কোনওপ্রকারে এই তাপ সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া যায়, তবে ঘূর্ণিঝড় তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই-ই হয় যখন সেটি স্থলভাগে এসে পৌঁছয়। স্থলভাগে নীচে উষ্ণ জল নেই বলে সেখান থেকে জলীয়বাষ্প সহযোগে উপরে তাপ পাঠাবার রাস্তাও নেই। সেজন্য ঘূর্ণিঝড় স্থলভূমিতে আছড়ে পড়ার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ হতে শুরু করে, অবশেষে রূপান্তরিত হয় সাধারণ ঝড়বৃষ্টিতে।

আগে, ঘূর্ণিঝড়ের তো সব দুর্বোধ্য নাম দেওয়া হতো। ২০০৪-এর পর থেকে আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থা (আরএসএমসি) বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ চালু করে। আরএসএমসি সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়ে থাকে। তালিকা পেলে দীর্ঘ সময় যাচাইবাছাই করে ওয়ার্ল্ড মেটোরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) কাছে পাঠায়। সে সময় আটটি দেশ মিলে মোট ৬৪টি নাম প্রস্তাব করে। এদিকে এই নামগুলো থেকে নামকরণ করা শেষ হলে আবারও নতুন করে নামের প্রস্তাব করা হয়। শুরুর দিকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হতো মেয়েদের নামে। পরে এই অদ্ভুত বিভাজনের বিরুদ্ধে কথা ওঠে। তখন ঠিক করা হয়, একটা ঘূর্ণিঝড়ের নাম যদি মেয়েদের নামে হয়, পরেরটা হবে ছেলেদের নামে। ভারতের দেওয়া নামগুলি যথাক্রমে আকাশ, বায়ু, গতি প্রভৃতি। আবার বাংলাদেশের দেওয়া নামগুলি হলো অনিল, অগ্নি, নিশা, ফনী প্রভৃতি। আয়লার নামকরণ করেছিল মলদ্বীপ, আমফানের নাম দিয়েছিল থাইল্যান্ড, তারপর ইয়াসের নাম দিয়েছিল ওমান। আগের বছরের মোকার নামকরণ করেছে ইয়ামেন তাদের রাজধানীর এক বন্দরের নামে। আর এবারের 'রেমাল'-ও ওমানের দেওয়া, যার অর্থ বালি। যে নামই দেওয়া হোক না কেন, খেয়াল রাখা হয় কোনও ব্যক্তি, জাতি বা গোষ্ঠীর আবেগ বা সম্মানহানি যাতে না হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির কথা ভেবে, আর এর ক্ষয়ক্ষতির আন্দাজ করে বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেছেন এর ক্ষমতা খর্ব করার। আকাশে সিলভার আয়োডাইড ছড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়কে দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন। নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হওয়ায় নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের দ্বারা এই ঘূর্ণিঝড়কে দমানোর চিন্তাও করেছেন বিজ্ঞানীরা কিন্ত প্রকৃতির সঙ্গে সত্যিই পেরে ওঠা সম্ভব?

More Articles