কালীপুজোয় রাজ‍্যে ধেয়ে আসবে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়! কতটা ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা

Cyclone Sitrang: শোনা যাচ্ছে, দীপাবলি-কালীপুজোর মধ্যেই ফের তছনছ হতে পারে দেশের পূর্ব উপকূল। কতটা ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়?

প্রতি বছরের মে মাস। ভয়ানক অশনি সংকেত নিয়ে কখনও ছুটে আসে আয়লা, কখনও আমফান, কখনও আবার ইয়াস, অশনি। মুহূর্তেই তছনছ হয় এক-একটি জনপদ। নিমেষেই শেষ হয় বসতি। ক্ষয়ক্ষতির সীমারেখা ছাড়িয়ে ব্যতিব্যস্ত হয় মানুষ। এবার মে মাস নয়, ২০২২-এ এসে সেই আতঙ্কের বহর ছড়িয়েছে অক্টোবরে। শোনা যাচ্ছে, দীপাবলি-কালীপুজোর মধ্যেই ফের তছনছ হতে পারে দেশের পূর্ব উপকূল। আছড়ে পড়তে পারে ঘূর্ণিঝড় সিত্রং। যার গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ২২০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার! ভয় ধরাচ্ছে এর সম্ভাব্য ল্যান্ডফল নিয়েও। অনুমান করা হচ্ছে, এই ঝড় লন্ডভন্ড করতে পারে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বাংলাদেশের মধ্যে যে-কোনও অংশ। সম্ভাবনা বেশি দুই বাংলার ক্ষেত্রে।

কীভাবে তৈরি হচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়
বঙ্গোপসাগরের শেষপ্রান্তে ইন্দোনেশিয়ার দিকে দু'টি নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। যা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এই নিম্নচাপের মধ্যে একটি গভীর নিম্নচাপ তারপর ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধারণ করতে পারে। যা ক্রমশ ভারত, বাংলাদেশের পূর্ব উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে।

কী করতে পারে এই ঘূর্ণিঝড়
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই ঘূর্ণিঝড় যদি প্রবল শক্তি-সহ উপকূলে আছড়ে পড়ে, তাহলে আম্ফানের পরে এমন শক্তির ঝড় আগে দেখেনি দেশ। শুধু ঝড় নয়, এর প্রভাবে সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত উঠতে পারে ঢেউ। যা ভাসিয়ে দিতে পারে একাধিক এলাকা।

আরও পড়ুন: দেড়শো বছর আগের সেই অক্টোবরে বাংলায় চলেছিল ধ্বংসলীলা! ফিরে দেখা সেই ভয়াবহ ইতিহাস

কতক্ষণ স্থায়ী হতে পারে এই দুর্যোগ
মূলত, অক্টোবরের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৭ থেকে ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এর প্রভাব পড়তে পারে। যদি আরও শক্তিশালী হয়ে এই ঝড় ২৫ তারিখের দিকে আছড়ে পড়ে, তাহলে অমাবস্যার কারণে আরও ভয়ংকর হতে পারে পরিস্থিতি। স্থলভাগে এর পুরোদমে স্থায়িত্ব থাকতে পারে ৩ থেকে ১০ মিনিট। তারপর বিপুল স্থান জুড়ে চলতে পারে তাণ্ডব। প্রসঙ্গত, শক্তিশালী ঝড়ের স্থায়িত্ব এইরকমই হয়, তাতেই ধ্বংস হয় অনেকটা।

আশার-আলো
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, গত মার্চে এমন এক সম্ভাবনার কথা দেখা গেলেও অবশেষে ঝড় আসেনি। অনেক সময় মাঝ সমুদ্রেই তলিয়ে যায় শক্তি। স্থলভাগে আসার আগেই বিলীন হয় সবটা। এই ক্ষেত্রেও যে তেমনটা হবে না, একথা বলা যায় না।

সতর্কতা
ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস মডেল থেকে শুরু করে দিল্লির মৌসম ভবন। এই নিম্নচাপের গতিবিধির উপর নজর রাখা শুরু করেছে। প্রতিমুহূর্তে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে সিত্রাংকে। ঝড়ের দিকে নজর দিচ্ছে রাজ্য, কেন্দ্রও। দুর্যোগ এলে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়েও তৎপরতা শুরু করছে প্রশাসন। খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হয়েছে প্রশাসনিক স্তরে।

সিত্রং শব্দের উৎপত্তি
থাইল্যান্ডের তরফে দেওয়া হয়েছে এই নাম। শ্রীলঙ্কার দেওয়া নাম অশনির পরে এবার সম্ভাব্য ঝড়ের নাম দেওয়ার পালা থাইল্যান্ডের। তাদের তরফে এই ঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে সিত্রং। ভিয়েতনামি ভাষায় এর অর্থ পাতা। আগের ঘূর্ণিঝড়ের নামের অর্থ ছিল বজ্র। প্রসঙ্গত, বঙ্গোপসাগরে এই সময় কোনও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে এর নাম হত ‘সিত্রং'। কারণ, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার অধীন জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগরতীরের মোট ১৩টি দেশ; বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব এমিরেটস, ইরান, সৌদি আরব ও ইয়েমেনকে ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী ঝড়ের নাম ঠিক করার কথা বলা হয়। সেই মোতাবেক এক একটি দেশ মোট তিনটি করে নাম-সহ শতাধিক নামের তালিকা ইতিমধ্যেই জমা দিয়েছে। যেখানে পরবর্তী ঝড়ের নাম যে থাইল্যান্ড থেকেই হবে এটি ওই তালিকায় স্পষ্ট। এর পরের ঝড়ের নাম হবে মন্দৌস, যা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। তারপরের ঝড়ের নাম হবে মোচা। যা দিয়েছে ইয়েমেন।

উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সাল থেকে ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী এই ঝড়ের নামকরণের রীতি রয়েছে। পরবর্তীকালে বিশ্বের দশকে এসে নামকরণের অধিকারী হিসেবে আরও কয়েকটি দেশ নথিভুক্ত হয়। যেখানে নানা বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে নাম দেওয়া হয় ঝড়ের। এই ক্ষেত্রেও সেই রীতি অনুযায়ী নাম দেওয়া হয়েছে।

ঝড়ের ইতিহাস
ঘূর্ণিঝড় বারবার ভয় ধরিয়েছে সাধারণ মানুষকে। একের পর এক নামে এসে ক্রমশ শেষ করেছে অনেক কিছু।

একাধিক ঝড়ের ইতিহাস থাকলেও এই রাজ্য সম্প্রতি বিপদের সম্মুখীন হয় আয়লা থেকে। ২০০৯ সাল। সেই মে মাস। আচমকা প্রবল, ঝড় বৃষ্টিতে তলিয়ে গেল উপকূলবর্তী জেলার বড় অংশ। ডুবল সুন্দরবন। গবাদি পশু থেকে সাধারণ মানুষ। বাম আমলে বিপদে পড়ল সবাই। ঘর ভাঙল, বাঁধ ভাঙল, জলে তলিয়ে গেল চারপাশ। আকাশপথে ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হল সরকারকেও।

২০১৯ সাল। মে মাস। ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় ফনি। বাংলায় এর প্রভাব খুব একটা না পড়লেও লন্ডভন্ড হয়েছিল ওড়িশার উপকূল।

এর সঙ্গে গাঁজা, বুলবুল ও ভয় ধরায় ওড়িশা, অন্ধ্র উপকূলে। বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ থেকে মানুষের মৃত্যু, বিপদে পড়ে বাংলাদেশও।

২০২০। মে। গড়ে ১৮৫ কিলোমিটারের বেশি ঘূর্ণিঝড় শেষ করেছিল বাংলার একাধিক জেলা। ফের তছনছ হয়েছিল সুন্দরবন। গড়ে ১৩৩ কিলোমিটার ঘণ্টায় বেগে এই ঝড়ের অভিঘাতে বিদ্যুৎহীন থেকেছিল গোটা কলকাতাও। গত ৪-৫ দশকে নাকি আমফানের মতো দুর্যোগ দেখেনি বাংলা।

২০২১। মে। ইয়াস। আম্ফানের পর ফের ভয় ধরিয়েছিল এই ঝড়। তবে মারাত্মক ক্ষতি হয়নি এর প্রভাবে। বাড়ি ভেঙেছে, জল ঢুকেছে ঠিকই তবে অতি ভয়ঙ্কর আম্ফানের পরে ইয়াস মারাত্মক কিছু করেনি। যদিও এর সপ্তাহখানেক আগেই পশ্চিম ভারতে চাপ বারের ঘূর্ণিঝড় তকত।

যদিও এবারের ঝড়ের অবস্থান অক্টোবরে। মে মাসে এমন দুর্যোগের সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। এই ঝড় ব্যতিক্রম।

কেন বারবার মে মাসে দুর্যোগ?
এর একাধিক কারণের কথা বলেন আবহবিদেরা। চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত একটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ডিজিটাল বিভাগে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "বর্ষার আগে এপ্রিল এবং মে মাসই ঘূর্ণিঝড়ের উপযুক্ত সময়। এর মধ্যে মে মাসে ঘূর্ণিঝড়  সবথেকে বেশি হয়। মে মাসে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। বেশ কয়েকটি কারণে উপরে এই ঘূর্ণিঝড় নির্ভর করে।''

ওই প্রতিবেদনে তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় তৈরিতে তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ। যা এই সময়ে থাকে।

এছাড়াও যে কারণে এর সৃষ্টি তা হলো, হাওয়া ওপরের দিকে উঠতে পারে এরকম অনুকূল পরিস্থিতি থাকলে তবেই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। কোনও ঘূর্ণাবর্ত থাকলেও তা ঘূর্ণিঝড় তৈরিতে সাহায্য করে।

ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণি তৈরি হতে সাহায্য করে শক্তি। সমুদ্রপৃষ্ঠে তৈরি হওয়া শক্তি। যা ওই নিম্নচাপকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা বলেই মত আবহবিদদের একাংশের।

More Articles