অচেতন সন্তানকে কোলে করে শুইয়েছিলেন চিতায়! দাদাসাহেব ফালকে নিজেই আস্ত চলচ্চিত্র
Dadasaheb Phalke: নিজের অজ্ঞান ছেলে বালচন্দ্রকে কোলে নিয়ে পরম মমতায় চিতায় শুইয়ে দিয়ে চোখের জলে শুটিং সারলেন ফালকে।
জাদুকর কেলফা নামে রাস্তায় রাস্তায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন মানুষটা। সবাই বলত এর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। যে ব্যাবসাতেই হাত লাগান, বেশিদিন চলে না। বাজারে ধারদেনা। সংসার চলে কী চলে না। জীবনের শুরুটা অবশ্য একেবারেই অন্যরকম ছিল ধুন্দিরাজ গোবিন্দের। মারাঠি শাস্ত্রী পরিবারে জন্ম। ছোট থেকেই জানেন বড় হয়ে পারিবারিক পুরুতগিরি করবেন। কিন্তু একটু বড় হতেই সব কিছু গুলিয়ে গেল। ম্যাজিক, আর্ট আর নাটকে অভিনয় গ্রাস করে নিল তাঁর গোটা মগ্ন চৈতন্যকে। পরিবারের সঙ্গে বোম্বেতে এসে ভর্তি হলেন জে জে স্কুল অফ আর্টে। আর সেখানেই প্রথমবার পরিচিত হলেন দুই আশ্চর্য ম্যাজিকের সঙ্গে। ফটোগ্রাফি আর ছাপাই পদ্ধতি। ঠিক করলেন ছাপাখানা খুলে প্রকাশক হবেন। সেই উদ্দেশ্যে ফাইন প্রিন্টিং শিখতে জার্মানিতেও পাড়ি দিলেন। জেনে নিলেন আধুনিক ছাপাছাপির খুঁটিনাটি। এই অবধি তাঁর জীবন এক গড়পড়তা খাটিয়ে মানুষের। অন্য দশজনের সঙ্গে তেমন ফারাক নেই তাতে। ১৯১০ সালে দেশে ফেরার পরেই ঘটল চরম অঘটন। আচমকা একদিন দেখলেন তিনি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। বোম্বের সেরা ডাক্তাররা ওষুধ দিলেন। কাজ হলো না। এদিকে ততদিনে তাঁর বিয়ে হয়ে সন্তানাদিও হয়েছে। সংসার আর চলে না। এক রাতে ফালকের চিৎকারে তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েরা ছুটে এসে দেখলেন তিনি দুই হাত তুলে নৃত্য করছেন। তাঁর দৃষ্টি ফিরে এসেছে। ম্যাজিক!
দৃষ্টি ফিরলেও ভাগ্য ফিরল না। এতদিন ঘরে বসে থাকার জন্য প্রিন্টিংয়ের সব কাজ বন্ধ। পেট চালাতে বাধ্য হয়ে পথে পথে ম্যাজিক দেখানো শুরু করলেন তিনি। নাম নিলেন ম্যাজিশিয়ান কেলফা। তাঁর নিজের পদবি ফালকে-কে জাস্ট উলটে দিয়ে। বড়দিনের সময় বোম্বের চৌপাটিতে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন নতুন বায়োস্কোপ লেগেছে। নাম, দ্য লাইফ অ্যান্ড প্যাশন অব জেসাস ক্রাইস্ট। গরিবের ঘোড়া রোগের মতো তাঁর ছিল সিনেমা দেখার রোগ। ফার্দিনান্দ জেকা পরিচালিত সেই ছবি ঘুরিয়ে দিল তাঁর জীবনের মোড়। আরে এও তো এক রকমের ম্যাজিক! ফালকে বুঝে গেছিলেন বাকি জীবন তাঁকে কী করতে হবে। ঠিক করলেন তিনিও সিনেমা বানাবেন। খ্রিস্টের মতো কৃষ্ণের জীবন নিয়ে। ফালকের পরিবারের সঙ্গে পুরাণের যোগ, ম্যাজিক, নাটক, আর্ট, কলকবজার প্রতি তাঁর আকর্ষণ- সব কিছু মিলেমিশে এক হয়ে গেছিল এই বায়োস্কোপে। পরিবারে তাঁর স্ত্রী বাদে কেউই বিশেষ উৎসাহ দেখালেন না। একটা একেবারে নতুন মাধ্যম। ছাপাখানার চেনা পথ ছেড়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও অর্থই নেই। কিন্তু ফালকেরা কবে চেনা রাস্তার তোয়াক্কা করেছেন! বোম্বের একটা বইয়ের দোকান থেকে কিনলেন ব্রিটিশ পরিচালক সেসিল হেপওয়ার্থের লেখা এ বি সি অব সিনেমাটোগ্রাফি। ঠিক করলেন লন্ডনে যাবেন সেসিলের সঙ্গে দেখা করতে। তিলে তিলে গড়ে তোলা নিজের জীবনবিমার টাকা তুলে বিলেতের জাহাজে চেপে চললেন সিনেমা শিখতে। মাস দুয়েক বাদে যখন ফিরলেন, সঙ্গে একটা উইলিয়ামসন ক্যামেরা, একটা পারফোরেটর আর একটা প্রিন্টিং মেশিন। তখন কাঁচা ফিল্মের দু'পাশে ছ্যাঁদা থাকত না। পারফোটর দিয়ে নিজেদের করে নিতে হতো।
আরও পড়ুন- নড়ে উঠল পাতা, ধেয়ে এল ট্রেন! যেভাবে পর্দায় এল বিশ্বের প্রথম সিনেমা
বাড়ি ফিরে সহকারী হিসেবে পেলেন স্ত্রী সরস্বতীকে। ল্যাবের কাজে সাহায্য ছাড়াও নিজের সমস্ত গয়না বন্ধক রেখে টাকার জোগাড় হল সামান্য। সেই টাকাতেই স্টপ মোশান টেকনিকে ফালকে এক মটরবীজের ধাপে ধাপে গাছ হবার ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দিলেন অনেককে। ধীরে ধীরে ফালকের ছোট ছোট ছবি মহাজনদের দেখিয়ে তাদের বিশ্বাস করালেন ভারতেও সিনেমা তৈরি হতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণের ছবি তোলা অসম্ভব। ফালকে যে আকারে ছবিকে ভেবেছিলেন, তেমন টাকার জোগান ছিল না। কিন্তু ছবি বানাতেই হবে। একটা কথা শুরু থেকেই মাথায় ছিল ফালকের। দর্শক এমনিতেই একেবারে নতুন একটা মাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। তাই কনটেন্টে অন্তত তাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরোতে দেওয়া যাবে না। ফলে অপেক্ষাকৃত কম বাজেটের চেনা গল্প বেছে নিতে হলো তাঁকে। মহাভারতের কাহিনি। তাতে রাজা আছেন। রানি আছেন। রাজপুত্র আছেন। আর আছে ভারতের চিরন্তন ত্যাগের কথা। মুশকিল হলো সিনেমা শুরুর পরে। কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে তো দূরে থাক, পতিতারা অবধি সিনেমায় মুখ দেখাতে রাজি নয়। সব তৈরি। কিন্তু নারী চরিত্রের জন্য সিনেমা শুরু আটকে আছে।
সব সমস্যার সমাধান করল চৌপাটির রেস্তোরাঁর এক রাঁধুনি। নাম আন্না সালুঙ্কে। একদিন খেয়াল করে ফালকে দেখলেন, যুবকের হাবভাব, চেহারা, দেহের গঠন মেয়েলি। একে দিয়ে কাজ চলতে পারে। রান্না করে আন্না পেতেন মাসিক দশ টাকা। পনেরোর কড়ারে ফালকে তাঁকে অভিনয়ে রাজি করালেন। রানি তারামতীর চরিত্রে অভিনয়ের শিল্পী পাওয়া গেল। তখন কে জানতেন, এই সালুঙ্কেই একদিন লঙ্কা দহন ছবিতে একই সঙ্গে রাম ও সীতার অভিনয় করে এমন এক রেকর্ড স্থাপন করবেন, যা আজও অক্ষয়। ভারতের প্রথম ফিল্ম ডিভা সালুঙ্কে যে একজন পুরুষ ছিলেন, সে কথা অনেকেই আজ ভুলে গেছেন।
যা বলছিলাম, সিনেমার শুটিং শুরু হলো বোম্বের দাদর মেইন রোডের আশেপাশে। জনা তিরিশেক মানুষের টিম। রোজ দু'বেলা তাদের জন্য নিজের হাতে খাবার বানাতেন সরস্বতী, সবাই যাকে 'কাকী' বলে ডাকত। একদিন গোটা টিম নিয়ে তিনি পৌঁছলেন পাশের এক গ্রামে। গ্রামের লোকেদের তো আক্কেল গুড়ুম। একদল পুরুষ মানুষ সবার মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে বর্ম, হাতে তলোয়ার, বর্শা। মাঝেমধ্যে সেসব নেড়ে নেড়ে কী যেন করছে। আর অন্য একটা লোক মাথায় কপড় মুড়ে কীসের একটা হাতল ঘোরাচ্ছে। এ নিশ্চিত নতুন ধরনের ডাকাতদল। তারা গিয়ে গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে ডেকে আনল। তিনি ফৌজদারকে খবর দিলেন। ফৌজদার অতি সক্রিয়। প্রায় সবাইকেই বেঁধেছেঁদে বীরের মতো মোচে তা দিতে লাগলেন। বেচারা ফালকে ফৌজদারকে হাতেপায়ে ধরে সিনেমা তৈরির কলাকৌশল দেখিয়ে তবে রক্ষে পেলেন। তবে যে ক'দিন শুটিং হয়েছিল, প্রতিদিন সেই ফৌজদার সাহেব আগেই এসে বসে থাকতেন। অনেকসময় গাঁয়ের যাত্রা দেখার মতো অভিনেতাদের নানা আদেশ নির্দেশ দিতেন বলেও শোনা যায়। কী জ্বালা!
আরও পড়ুন- ডুবন্ত সুরাইয়াকে বাঁচিয়েছিলেন তিনিই, তবু দেব আনন্দকে খুন করতে চেয়েছিল পরিবার…
আর একটা ঘটনার কথা বলি। ফালকের নিজের ছেলে বালচন্দ্র অভিনয় করছিলেন রোহিতাশ্বর ভূমিকায়। একদিন খেলতে গিয়ে বালচন্দ্র পাথরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান আর ফেরে না। সবাই বললে এক্ষুনি তাকে বোম্বে নিয়ে যেতে। এদিকে সিনেমার খরচ বাড়ছে। বোম্বে নিয়ে গিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে যে সময়, তাতে বাজেটে কুলোবে না। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে ফালকে সিদ্ধান্ত নিলেন শুটিং ক্যানসেল হবে না। সেদিনের দৃশ্য ছিল শ্মশানের। রোহিতাশ্বকে শ্মশানে নিয়ে এসেছে তাঁর মা। শুইয়ে দিয়েছে চিতায়। নিজের অজ্ঞান ছেলে বালচন্দ্রকে কোলে নিয়ে পরম মমতায় চিতায় শুইয়ে দিয়ে চোখের জলে শুটিং সারলেন ফালকে।
১৯১৩ সালের ২১ এপ্রিল অলিম্পিয়া থিয়েটারে প্রিমিয়ার হল ফালকের প্রথম সিনেমা 'রাজা হরিশচন্দ্র'র। মাত্র পনেরো হাজার টাকায় বানানো চল্লিশ মিনিটের একটা ছবি ভারতের ইতিহাসকে বদলে দিল চিরকালের মতো।