"দলিত এখন একটা ফ্যাশন"! আম্বেদকরের আর প্রয়োজন কোথায়?
B R Ambedkar and Dalits: পাড়ার দোকানে ডিম কিনতে গেলে পাড়ার ছেলে ছোকরাদের জটলা থেকে ভেসে আসে, “এসব মণ্ডল ফণ্ডল ডি এম দিয়ে কি কোনও কাজের কাজ হয়?”
“দলিত এখন একটা ফ্যাশন”
গত বছর একটা গল্প পাঠের আসরে এই মন্তব্যটি করেন একজন শ্রোতা। দলিতসাহিত্য নিয়ে কাজ করি শুনলে বহু মানুষ বলে ফেলেন, “দলিত ব্যাপারটা এখন লোকে খুব খায়”। কেউ বলেন “ভিকটিম কার্ড খেলে এরা”। স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর তো কেটে গেল, এখনও কেন প্রয়োজন রিজার্ভেশনের, যখন আমরা চারদিকে দলিত দেখতে পাই না, কারণ বর্ণরিক্তরা মিলে মিশে গেছে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে। আমরা পাশাপাশি বসে কাজ করি, রাস্তায় চলি, দোকান বাজারে যাই, একই টেবিলে বসে খাই, ছোঁয়াছুয়িতে কোনও বাধানিষেধ নেই। তাহলে আর কেন আম্বেদকর প্রাসঙ্গিক? আমরা তাঁকে মনে রাখব স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচয়িতা হিসেবে? আম্বেদকর ১৯৩০ সালে গোলটেবিল বৈঠকের পর ১৯১৯ সালের সংবিধানে দলিত সংক্রান্ত কিছু সংশোধনী প্রণয়ন করেন যা স্বাধীন ভারতের সংবিধানেও প্রযোজ্য হয়। এই সংশোধনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, দলিতের সমনাগরিকত্ব এবং দলিতের সমনাগরিকত্বের মূল নীতি লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি প্রদান। সংবিধানে বলা রয়েছে, যে ভারতীয় নাগরিক একজন দলিতকে হোটেলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পথে ঘাটে, অলিতে গলিতে, জলে,স্থলে, অন্তরীক্ষের কোনও পরিবহনে কোনও না কোনওভাবে অচ্ছুৎ প্রতিপন্ন করবেন বা কোনও না কোনওভাবে অপরায়িত করবেন সেই ভারতীয় নাগরিককে জরিমানা সহ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ দলিতকে দেওয়া হলো রক্ষাকবচ যাতে সে মানুষের জীবন বাঁচতে পারে।
আম্বেদকরের এই রক্ষাকবচ দলিতকে খানিক বাতাস ধার দিল শ্বাস নেওয়ার জন্য। ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ মানতে বাধ্য হলো লেখাপড়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দলিতের প্রবেশাধিকার। কিন্তু মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া এক বিষয় নয়। মোটা দাগের ব্রাহ্মণ্যবাদ এই ছুঁচো গিলতে বাধ্য হলেও, নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদ দলিতকে অপরায়ণের আপাত সূক্ষ্ণ নানা ফিকির খুঁজেই নেয়। তাই এখন অপরীকরণের উপায়গুলি লুকনো ছুরির মতো সংক্ষিপ্ত ও ধারালো, রক্তক্ষরণ তাতে কমেনি কিছুমাত্র। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কর্মক্ষেত্রে একজন দলিত শিক্ষক হিসেবে যখন শুনতে হয়, কোটায় চাকরি পাওয়া, যখন প্রতি মুহূর্তে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের বাড়তি দায় এসে বর্তায়, বর্ণহিন্দু সহকর্মীরা যখন ঠাট্টার ছলে নিজেদের পৈতে এবং কৌলীন্যের গর্ব করেন, তখন একজন দলিত হিসেবে অপরায়িত হওয়ার যে উদ্বেগ-আতার-যন্ত্রণা হয় তার কি বিন্দুমাত্র বদল হয়েছে? উত্তর হলো, না। রোজকার জীবনে সহজেই ক্যাজুয়াল কাস্টিজম চর্চা করা হয়। দলিত পদবিধারী ডাক্তারের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বর্ণহিন্দুর অধিকারের মধ্যে পড়ে। পাড়ার দোকানে ডিম কিনতে গেলে পাড়ার ছেলে ছোকরাদের জটলা থেকে ভেসে আসে, “এসব মণ্ডল ফণ্ডল ডি এম দিয়ে কি কোনও কাজের কাজ হয়?”
আরও পড়ুন- কোনও পক্ষকে রেয়াত করেননি, হিন্দুত্বকে দূরে ঠেলে কেন বৌদ্ধধর্ম বেছেছিলেন আম্বেদকর?
দেখা যাচ্ছে, আম্বেদকরের দেওয়া রক্ষাকবচ দলিতের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত পরিসরে ঢোকার ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা সাহায্য করেছে। তাই ‘মণ্ডলফণ্ডল’রা আজকাল ডিএমের চেয়ারে বসতে পারেন, আমার মতো জাতে ‘চাঁড়াল’রা কনৌজি, বারিন্দ, রাঢ়ী, মৈথিল এবং আরও বিবিধ ‘সম্ভ্রান্ত’ ‘কা-বা-ব’দের (কায়েত-বামুন-বদ্যি) মাঝে অপাচ্য হাড্ডিসম হয়ে আকাডেমিক চর্চাও করতে পারছে খানিক। সাহিত্যের পরিসরে আমরা দেখি মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো ‘চণ্ডাল’ নিজের জীবন লিখছেন প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যের ধারাকে তোয়াক্কা না করেই। সেই লেখা সর্বভারতীয় স্তরে সুপরিচিত ও পুরস্কৃত হচ্ছে। খুব মজার ব্যাপার হলো যেদিন মনোরঞ্জন ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার তরফ থেকে সেই বছরের শ্রেষ্ঠ ‘নন-ফিকশন’ পুরস্কারটি পেলেন, তার নিজের রাজ্যের তথাকথিত ‘রুচিশীল’ সংবাদপত্রগুলির একটিরও প্রথম পাতায় ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়নি। এই নীরবতা দলিতের প্রতিস্পর্ধা নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশঙ্কা ও ঘৃণাকে সরব করে তোলে। এই ঘৃণা আসলে আম্বেদকরের প্রতি ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পুঞ্জীভূত অবচেতনে বয়ে চলা ঘৃণা, তার চেয়েও বেশি ঘৃণা আম্বদেকরের দেওয়া রক্ষাকবচকে। এই অবচেতনের আরও গভীরে গেলে আমরা দেখতে পাব সেই দু' হাজার বছর বয়সি ব্রাহ্মণ্যবাদীকে যে ‘সেলফ অ্যান্ড আদার’-এর গঠন মেনে নিজের চেয়ে আলাদা যা কিছু তার প্রতিই পোষণ করে চূড়ান্ত সন্দেহ, ঘৃণা এবং বিবমিষা। এই অপরায়নের পরিসরে গায়ের রঙ থেকে শুরু করে, গায়ের গন্ধ, নাক-চোখের গঠন, উচ্চারণ ভঙ্গিমা, খাদ্যরুচি, পোশাক , রঙের রুচি, পরিচ্ছন্নতাবোধ, আবেগের প্রকাশভঙ্গি সবকিছুই পড়ে। অপরায়িত হওয়ার ভয় একজন ‘চাঁড়াল’ কিশোরীর মনে সারাজীবনের জন্য গেঁথে যায় যখন তার মাস্টারমশাইয়ের তথাকথিত রাবীন্দ্রিক রুচিশীল স্ত্রী গল্পের ছলে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠেন, “নমঃশূদ্রদের গা থেকে, এমনকী ওদের বালিশ বিছানা থেকে কীরকম নোংরা, চিটচিটে একটা গা-গোলানো গন্ধ আসে না!”
আরও পড়ুন- গান্ধীকে পছন্দ করি না, কেন বলেছিলেন আম্বেদকর?
একবিংশ শতাব্দীর নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদ উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলির মতো মোটাদাগের অপরায়ন করবে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির দেখতে ‘ভদ্রলোক’ দলিতকে তার পাশে বসাবে, একই টিফিনবাক্স থেকে খাবার ভাগ করে খাবে, কিন্তু দলিতের প্রতিটি সামাজিক উন্নতিকে দেগে দেবে যোগ্যতাহীনতা, ধান্দাবাজি, ভিকটিম-কার্ড খেলা এবং আইডেন্টিটি-পলিটিক্সের খারাপ দিক হিসাবে। নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আম্বেদকরের রক্ষাকবচকে ভেঙে ফেলতে আগে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আগে ‘হান্ড্রেড পয়েন্ট রোস্টার’ না মেনে দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসন, সচেতনভাবে অসংরক্ষিত করে দিত; এখন তারা উচ্চশিক্ষায় গবেষণার ক্ষেত্রে ‘এন এফ এস’ (নান ফাউন্ড স্যুটেবল) নোটিশ দিয়ে উচ্চশিক্ষায় দলিতের প্রবেশাধিকার যতটা সম্ভব আটকাবার চেষ্টা করে।
আম্বেদকরের রক্ষাকবচের সবচেয়ে বড় সুফল দলিত পেয়েছে সরকারি ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদি পরিসরকে ব্যবহার করে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই গড়ে উঠেছে দলিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি। ভারতীয় দলিতের যে স্বর আজকে শোনা যায় তা এই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থারই সুফল। নয়া ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দলিতকে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত করার জন্য সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই ভেঙে দিতে তৎপর। এরা নব্য উদারপন্থার মুখোশ নিয়ে আসে। সেই উদারপন্থা যা আপাতভাবে ‘যোগ্যতর ভোগ্যা বসুন্ধরা’ স্লোগান দিয়ে তিন হাজার বছরের দলিতকে নিষ্পেষিত করার ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চায়। সরকারি শিক্ষা ও সরকারি চাকরির পরিসর সংকুচিত হয়ে আসা মানে অবশ্যই দলিতকে আম্বেদকরের দেওয়া রক্ষাকবচ থেকে বার করে নিয়ে আসা। তাই ভারতবর্ষে নয়া উদারপন্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের নয়া ক্যামোফ্লেজ কিনা তা নিয়ে একজন দলিত বারংবার প্রশ্ন করবে, এখানেই আম্বেদকরের প্রাসঙ্গিকতা। এই প্রশ্ন না থাকলে একজন ‘দলিত’ আদৌ দলিত কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায়।