দাদুর দেখানো পথেই ‘স্বপ্নের উড়ান’, নতুন যে ইতিহাস গড়ার পথে দার্জিলিংয়ের সাক্ষী

Darjeeling first female pilot : এই প্রথম দার্জিলিংয়ের মেয়ে পেলেন বাণিজ্যিক বিমান ওড়ানোর লাইসেন্স। পাহাড় তো বটেই এমনকী গোটা বাংলাই এখন উচ্ছ্বসিত সাক্ষীকে নিয়ে...

রাঁধা এবং চুল বাঁধার বাইরেও যে মেয়েদের পারার গণ্ডিটা বহুদূর বিস্তৃত সেই প্রমাণ অবশ্য নতুন করে দেওয়ার কিছুই নেই। আজ সে স্বয়ংসম্পূর্ণা। একা হাতেই সামলাচ্ছে ঘর এবং বাইরে। সমস্ত দুনিয়ায় আজ তাদের অনায়াস যাতায়াত। সমাজে ছেলেদের কাজ এবং মেয়েদের কাজ বলে যে আপাত ভেদাভেদটুকু বহুকাল ধরে প্রোথিত ছিল, মেয়েরাই তাকে উপড়ে ফেলেছে। নিজেদের কাজের দক্ষতায় প্রমাণ করেছে এই ভেদাভেদ কেবল ঠুলি মাত্র! মেয়েদের এই প্রমাণ করার লড়াইটা চলছে সর্বত্র। উত্তরে কাশ্মীর থেকে শুরু করে দক্ষিণে কন্যাকুমারী, কখনও সে খুন্তি হাতে নিতান্ত সাধারণ গৃহবধু, কখনও আবার মাতৃরূপেন সংস্থিতা, কখনও সে ডাক্তার, পুলিশ, উকিল, শিক্ষক, কখনও আবার মেঘের দেশে পাড়ি দেওয়া কোনও পাইলটও।

আজকের গল্পটা ঠিক এরকমই একজন মেঘ পরীর। পেঁজা তুলোর মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার স্বপ্নে যে সওয়ার। সাক্ষী প্রধান, এই নামটা এখন অবশ্য ফিরছে লোকের মুখে মুখে। দার্জিলিংয়ের প্রথম মহিলা পাইলট হয়ে ইতিহাস তৈরি করলেন জেলার ডিবি গিরি রোড এলাকার বাসিন্দা সাক্ষী। বয়স সবে মাত্র বছর তেইশ, এরই মধ্যে দেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি।

আরও পড়ুন - অকাল বৈধব্য, কোলে চার মাসের ছোট্ট মেয়ে! যেভাবে একাই লড়লেন ভারতের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার

আজকের এই স্বপ্নটা অবশ্য ছোটবেলা থেকেই সাক্ষীকে পথ দেখিয়েছে। টাকা পয়সা, ধন সম্পদের মতো স্বপ্নও যে প্রজন্মের সঙ্গে হাত বদল হয় তা প্রমাণ করলেন তিনি। মা দার্জিলিং মহারানি গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা, ফলে ছোট থেকেই বাড়ির পরিবেশের মধ্যে একটা শৃঙ্খলার অবয়ব ছিলই। যা অচিরেই লালিত হয়েছে সাক্ষীর মধ্যেও। অন্যদিকে, বাবা রুকেশমণি প্রধান পেশায় প্রিন্টিং জগতের লোক হলেও দাদু ছিলেন সেনাবাহিনীর পাইলট।ফলে, সাক্ষীর দাদুর বুনে দেওয়া সেই স্বপ্নের বীজকে লালন পালন করতে এগিয়ে এসেছে গোটা পরিবার। সাক্ষীর মধ্যে দিয়ে স্বপ্ন দেখেছে তারা, সাক্ষীও সেই স্বপ্নের মন রেখেছে নিঃসন্দেহে। মেঘের দেশের প্রথম মহিলা পাইলট হিসেবে লাইসেন্স ছিনিয়ে নিয়েছে সে ইতিমধ্যেই।

আর মাত্র দিন কয়েক, সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী মে মাস থেকেই পেশাগত জীবনে যোগ দেবেন সাক্ষী। ম্যালে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মনের ভিতরে মেঘের দেশে ওড়ার যে স্বপ্নটা এতদিন জ্বালিয়ে রেখেছিল সাক্ষী, সেটাই বাস্তবের মাটিতে উড়ান দেওয়া শুরু করবে এবার। দার্জিলিং মানেই সারা বছর জুড়ে একরাশ কুয়াশা। সেই কুয়াশা মেখে শৈশবে তাঁর স্কুলে যাওয়া। তার পর অচিরেই বড় হওয়া। অতঃপর আবার সেই কুয়াশাকে সঙ্গী করেই যে জীবনের সফর শুরু।

দার্জিলিংয়ের বেথানি স্কুল থেকে পড়াশোনা শুরু সাক্ষীর। সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরে ২০১৬ সালে দার্জিলিংয়ের লরেটো কনভেন্ট স্কুল থেকে আইসিএসই পাস করেন তিনি। এরপর শিলিগুড়িতে দিল্লি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ছোট থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। সেই লক্ষ্যেই ২০১৯ সালে স্কাইবর্ন অ্যাভিয়েশন লিমিটেডের মাধ্যমে ইন্ডিগো ক্যাডেট পাইলট ট্রেনিং প্রোগ্রামে নির্বাচিত হন এবং দিল্লিতে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। পরে দিল্লিতে গ্রাউন্ড ট্রেনিংয়েও অংশ নেন তিনি। এরপর চলে যান আমেরিকার ফোনিক্সে।সেখানে তিনি এফএএ ও কমার্সিয়াল এয়ারক্রাফট পাইলট লাইসেন্স পান। ২০২০ সাল, মাল্টি ইঞ্জিন ও ইনস্ট্রুমেন্ট রেটিং প্রোগ্রামেও অংশ নিয়েছিলেন সাক্ষী। ২০২০ সালে দেশে ফিরেই উত্তরাখণ্ডের পন্থনগরে যান তিনি। ভারতে বাণিজ্যিক বিমান ওড়ানোর প্রশিক্ষণ নেওয়ার শুরুটা এভাবেই। পাশাপাশি আবুধাবিতে গিয়ে এ-৩২০ বিমান ওড়ানোর প্রশিক্ষণও নেন তিনি।

অবশেষে চলতি বছরের ১৫ মার্চ বিমান সংস্থা আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘স্নাতক’ ঘোষণার পরে সাক্ষীর হাতে তুলে দেওয়া হয় বাণিজ্যিক বিমান ওড়ানোর লাইসেন্সও। এই প্রথম দার্জিলিংয়ের কোনও মেয়ে বাণিজ্যিক বিমান ওড়ানোর লাইসেন্স পেলেন। আগামী মে মাস থেকে পেশাগত জীবনে যোগ দেবেন তিনি। বছর চব্বিশের সাক্ষীকে নিয়ে তাই উচ্ছ্বসিত গোটা পাহাড়। খুশি চেনা অচেনা জগতের বহু বহু শুভাকাঙ্খীরা।

আরও পড়ুন - রুটির দোকানের হেল্পার ছিলেন নন্দিনীর বাবা, মেয়ের কাঁধে ভর দিয়েই উড়ান দিচ্ছে পাইস হোটেল

আপাতত দিল্লিতে থাকছেন সাক্ষী। কর্মজীবনের পাকাপাকিভাবে পা দেওয়ার আগে বর্তমানে চেক সেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। সব মিলিয়ে ৯ টি চেক সেশন হয়। মোটামুটিভাবে ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে আমি জুনিয়র ফার্স্ট অফিসার পদে উন্নীত হবেন সাক্ষী। তখন থাকতে হবে বেঙ্গালুরুতে। এখন স্রেফ খানিকটা সময়ের অপেক্ষা, তার পরই একদল যাত্রী নিয়ে মেঘের দেশে পাড়ি দেওয়ার সফর শুরু। ছোটবেলা থেকে দেখা একরাশ স্বপ্ন ভেসে যাবে কুয়াশা আর অলিখিত হাওয়ার রাজ্যে।

সাক্ষীর মত আর ও হাজার হাজার মেয়ে আজ দেশের প্রতিটি কোণায় বসে স্বপ্ন দেখছে। না সবার স্বপ্ন পূরণে দাদুর বুনে যাওয়া গল্প থাকে না, সোনার চামচ থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন থাকে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অবিরাম লড়াইটা জারি থাকে। যে লড়াইয়ের প্রতিটা বাঁকেই থাকে ক্লান্তি, ঘাম এবং অশেষ প্রতিকূলতা। তবুও জয় আসে, বারবার জিতে যায় সাক্ষীর মতো তরুণীরা। আর এই জিতে যাওয়াটুকুই আগামীতে আরও অনেক অনেক সাক্ষীদের সাহস জুগিয়ে যায় অচিরেই।

More Articles