অপরাধীর হাতেই রূপ পেল বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা গল্প, আগাথা ক্রিস্টি যে কারণে অমর
বিভিন্ন সাহিত্যিক এই মেয়েটাকে নিয়েই কত গবেষণা-গ্রন্থ, কত নাটকীয় উপন্যাস লিখে ফেলেছে! মেয়েটা জীবনে আর কোনওদিন সেই দিনগুলোর কথা তোলেনি।
এগারো বছর বয়সি এক কল্পনাপ্রবণ মেয়ে যখন বাবাকে মরে যেতে দেখে, আর দেখে ক্রমশ ঘনিয়ে আসা অর্থাভাবের কালো পরশ, অন্যতম ভরসা মায়ের জগতটা সাদা-কালোয় ঢেকে যেতে দেখে আর দেখে মাথা গোঁজার ঠাই অ্যাশফিল্ডের বাড়িখানা বেচে দেওয়ার সম্ভাব্য তোড়জোড়― সেই কল্পনাপ্রবণ মেয়ের তখন একমাত্র আশ্রয় বলতে মেগ, জো, বেথ বা অ্যামি ('লিটল ওম্যান' উপন্যাসের চরিত্রেরা), কিংবা ডোরা, ডিকি, অসওয়াল্ড বা অ্যালিস ('দ্য স্টোরি অফ দ্য ট্রেজার সিকার্স'-এর চরিত্ররা) কিংবা হয়তো মার্কিনি কোনও নাম না-জানা থ্রিলার সাহিত্য। মেয়েটা এভাবেই বেড়ে উঠছিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমের এক ছোট্ট টাউন টর্কিতে। আপাত-একলা, হয়তো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অস্তিত্বহীনভাবে বা স্বল্প অস্তিত্ব সঙ্গে নিয়ে।
বাবার মৃত্যুর বছরখানেক বাদে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করানো হলেও মেয়েটা ওই কঠোর নিয়মকানুনে মানিয়ে নিতে পারেনি। অথচ জীবন হয়তো এরকমই! এই মেয়েই যখন পরে বড় হল, বিয়ে করল আর্চিকে, তারপর ভালোয়-মন্দে বারোটা বছর বিবাহিত জীবন কাটিয়েও ফেলল, অথচ তারপরেও, আর্চি এক্সট্রাম্যারিটাল সম্পর্কে জড়ানো সত্ত্বেও তাকে সাংসারিক জীবনে ধরে রাখার সে কী আপ্রাণ চেষ্টা! একটা ফাঁপা শূন্য সংসার নামের খেলাঘর, সেখানে একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। দু'জনেই একটা লম্বা সময়ের বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, ঝঞ্ঝায় ভরা কর্মব্যস্ত জীবন কাটিয়েছে- মেয়েটি নিজের টাউনের রেড ক্রস হাসপাতালে, আর আর্চি সেই সুদূর ফ্রান্সে, যুদ্ধের খুব কাছাকাছি, তারপর যুদ্ধ-শেষে পাকাপাকিভাবে লন্ডনের কাছাকাছি বাসা বেঁধেছে দু'জনে, তারপরেও, হ্যাঁ, আর্চি মেয়েটির অগোচরে অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে এসেছে আর্চির এই ভিন্ন অভিমুখ, যেখানে নিজের স্ত্রীর প্রতি অবহেলা, স্ত্রীর ঘেরাটোপকে অবমাননা, একটাই বাড়ি, অথচ সেখানেও স্বস্তি না পাওয়া, ক্রমশ স্ত্রীকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া।
মেয়ে তাও চায়, আর্চি বিবাহিত জীবনে আটকে থাকুক। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, পুরুষদের প্রতাপ গোটা ইউরোপজুড়ে, মা শিখিয়েছে জীবনে যেই আসুক, তার প্রতি সর্বদা অনুগত থাকতে, তাকে সর্বদা খুশিতে রাখতে। তাই ছত্রিশ বছরে পৌঁছে সেই মেয়েই যখন দেখতে পায়, সবথেকে বিশ্বাসের মানুষটাই এরকম ভেক বদলে ফেলল রাতারাতি, তখন সেই মেয়েই যেন কোথাও গিয়ে এই এত বড় পৃথিবীতে আরও একলা, আরও সম্পর্কহীন হয়ে যেতে থাকে। একটু একটু করে।
আরও পড়ুন: মিথ্যে অপবাদের জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল এই প্রতিভাবান কবিকে
পনেরো বছর বয়সে মেয়ে টর্কির ওই ছোট টাউনটা থেকে বেরনোর সুযোগ পায়। ফ্রান্সে গিয়ে ভর্তি করানো হয় এক বোর্ডিং স্কুলে, স্বরের গায়কী যাতে মেয়েটির পরিণত হয় আর পিয়ানো যাতে মেয়েটির আঙুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায় অনায়াসে। (এর আগে একবার, যদিও খুব ছোট্ট বয়সে, গোটা পরিবারের সঙ্গে ফরাসি দেশে কিছু কাল কাটিয়ে এসেছিল। তখন সঙ্গে বাবা ছিল। তার প্রতাপ ছিল।) কিন্তু মেয়ের মধ্যে সেই ধৈর্যও নেই, সেই প্রতিভাও নেই। তাই কোনও কনসার্টে যে মেয়ে পিয়ানো বাজিয়ে বা অপেরাতে গান গেয়ে রুজিরোজগার শুরু করবে, সেই সম্ভাবনাতেও যবনিকা পড়ে গেল সেই সময়েই।
মেয়ে বছরদুয়েক বাদে আবার মায়ের কাছে ফেরত এল। মাও অসুস্থ, আর মেয়েরও মন নেই সামনের শীতকাল এই একঘেয়ে শহরে কাটানোর, তাই তারা সেই বছরের শীতটা কাটাতে মাসতিনেকের জন্য কায়রো চলে গেল। যে সময়টা এই মেয়েটার সময়কাল, সেই সময়টায় ধনী ব্রিটিশদের গন্তব্য ছিল কায়রো। কায়রো তখন অন্যরকম ছিল। এতটাই, যে রকমটা আমাদের এই শতকে কল্পনা করতে সমস্যা হবে। মিশরে গিয়ে সেই মেয়ে খুঁজে পেল এক অন্য জীবনের মানে। এমন এক জীবন, যা এতগুলো দিন ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে বা ফরাসি দেশেও অধরা ছিল। ওখানকার অমায়িক জীবনযাত্রা, হাউজ পার্টি, ডান্স পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং- মেয়েটাকে এক অন্য কিছুর সন্ধান দিল। নিজেকে মেলে ধরার, সামাজিক হওয়ার উপায় বাতলে দিল।
দেশে ফেরত এসেও এই জীবনযাত্রা মেয়ে ধরে রেখেছিল। লেখালেখি শুরু করেছিল। আঠারো বছর বয়সে লিখে ফেলল স্বপ্ন আর পাগলামো নিয়ে এক বড় গল্প, লিখে যেতে থাকল এমন সব গল্প, যাতে গন্ধ আছে স্পিরিচুয়ালিজমের, অকাল্টের। কিন্তু কপালে প্রকাশক জুটল না। অর্থাভাব তো ছিলই, কিন্তু মেয়েটার সেই কায়রো-ধর্মী জীবনযাপন এখানেও চলছিল পাশাপাশি। একবার এক ডান্স পার্টিতে আর্চির সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। জীবনটাও হয়তো বদলে গেল তখনই, কিংবা বদলাবে বলে ঠিক হয়ে গেল। আর্চি সদ্য তরুণ, আর্মিতে যোগ দিয়েছে। আর্চি আর মেয়েটার প্রেম চলতে থাকল, আর দেখতে দেখতে বাজতে শুরু করল যুদ্ধের দামামা। আর্চিকে যেতে হলো ফ্রান্সে। এদিকে মেয়ের মন মানে না ইংল্যান্ডে।
তা সেই উনিশশো চোদ্দর শীতে আর্চি টুক করে হলিডে লিভে দেশে ফেরত এসে মেয়েটাকে ক্রিস্টমাসের আগের দিন বিয়ে করে ফেলল। এরপর একটা লম্বা সময়, চার বছরের, বিরহ, মন খারাপ, আবার যুদ্ধের গন্ধ, হাসপাতালে প্রত্যেক দিন রক্তের মুখোমুখি হওয়া- মেয়েটার সঙ্গে আর্চির পরিপূর্ণ সাংসারিক জীবনের শুরু হল যুদ্ধের শেষে, আঠারো নাগাদ।
বিয়ের আগে আগে খুব তো সময় পায়নি মেয়েটা আর্চিকে চিনতে পারার, বুঝতে পারার! তাই চার বছর পরে ভরপুর সংসারজীবনে ঢুকে পরে মেয়ের তখন মনে দিবা-রাত্রি আনন্দ আর আনন্দ নিজের বরকে নিয়ে, নিজেদের নতুন সকালগুলো নিয়ে, সেন্ট জন'স উডের ভাড়ায় নেওয়া ফ্ল্যাটবাড়িতে। এই যুদ্ধের মাঝেও নার্স ও তারপরে ডিসপেন্সার হিসাবে কাজ করেও মেয়েটা কিন্তু জীবনের প্রথম ডিটেকটিভ উপন্যাস একটা লিখে ফেলেছে। প্রথমে কিছু প্রকাশক বাতিল করলেও জন লেন নামের এক প্রকাশক উপন্যাসটা নিলেন, কিন্তু ফরমান দিলেন, ক্লাইম্যাক্সটায় রদবদল করতে।
লন্ডন শহরের সেন্ট জন'স উডের ভাড়া বাড়িতে সংসার জীবন শুরু করার বছর খানেক বাদে ওদের এক ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা জন্মাল। এরপরে মেয়েটার জীবনে অনেকগুলো খুশির দিন আনাগোনা করতে লাগল। পরপর খান তিন-চারেক উপন্যাস বের করলেন জন লেন, জনপ্রিয়তা বাড়ল, লন্ডন শহরে অনেকগুলো ভাড়ার বাড়িতে থাকার পরে আর্চি আর মেয়েটা মিলে লন্ডন থেকে তেইশ মাইলের মতো দূরত্বে সানিংডেলে একটা বাড়ি কিনল আর বাড়িটার নাম দিল 'স্টাইলস'। এসবের মাঝে মেয়েটার যে মা টর্কির অ্যাশফিল্ডের পুরনো বাড়িতে একলা জীবন কাটাচ্ছিলেন, তিনি হঠাৎ উনিশশো ছাব্বিশ নাগাদ চলে গেলেন। এই এত বড় পৃথিবীতে, এত ভিড়ের মাঝে মেয়েটাকে একলা রেখে। আর তাই হয়তো মেয়েটার সাইকোটিক ব্রেকডাউনের শুরুটা বলা যেতে পারে তখন থেকেই।
ছোটবেলায় বাবার মরে যাওয়া, কষ্ট ও আনন্দ মাখিয়ে বড় হওয়া, ব্রিটেনের একদম শেষ মাথার এক টাউন শহরে বেড়ে ওঠা, ফ্রান্সে যাওয়া গায়কী ও পিয়ানো শেখার উদ্দেশে, অথচ ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসা, কায়রোতে মায়ের সঙ্গে মাসতিনেকের বসবাস, ব্রিটেনে এসে সদ্য ফোর্সে নামলেখানো তরুণ আর্চির প্রেমে পড়া, হঠাৎ করে বিয়ে, হঠাৎ করে একটা লম্বা সময়ের যুদ্ধ। যুদ্ধের মধ্যে যুদ্ধবহুল জীবন কাটানো। চার বছর বাদে যুদ্ধ-শেষে লন্ডনের কাছাকাছি অঞ্চলে সংসারজীবন শুরু করা, রোজালিন্ডের জন্ম, প্রথম উপন্যাসের প্রকাশ, ক্রমশ বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি, অথচ ধীরে ধীরে খ্যাতিহীনভাবে সাধারণ এক ইউরোপীয় আর পাঁচটা মেয়ের মতো জীবন কাটানোর ইচ্ছে কোথাও যেন মেয়েটার মনে এক পশলা অন্ধকারের জন্ম দিয়ে চলছিল, ধীরে ধীরে, অনেক দিন ধরে।
উনিশশো ছাব্বিশের আগস্ট মাসে আর্চি মেয়েটার কাছে ডিভোর্সের প্রস্তাব পেশ করল। আর্চি যে প্রেমে হাবুডুবু তখন সহকর্মীর মেয়েতে! মেয়েটার একমাত্র ভরসা মা বছরের শুরুতেই ওকে ছেড়ে চলে গেছে। সানিংডেলের এত বড় বাড়িতে রোজালিন্ড আছে, ওর মেয়ে, বছরসাতেক বয়স, আর আছে কিছু গৃহকর্মী। জন লেনের বিভিন্ন ফর্দতে বিরক্ত হয়ে ততদিনে মেয়ে লেনের সঙ্গে প্রকাশনার সম্পর্ক পরিত্যাগ করেছে। আর উইলিয়াম কলিনের প্রকাশনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে আগামী কয়েক বছরের জন্য। নতুন লেখার চাপ, মায়ের চলে যাওয়া, খ্যাতি ধরে রাখার চাপ, বৈবাহিক জীবনে প্রতারণা, মেয়েকে বড় করার পথে সম্ভাব্য বাধার কথা ভেবে ভেবে মেয়েটা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। বাস্তব থেকে অবাস্তবের দিকে। তাসের ঘর প্রায় ভেঙে যেতে বসেছে তখন। আর্চি রাতবিরেতে উল্টোপাল্টা শোনাতে থাকে, আর্চির অন্য চেহারা প্রকাশ্যে আসতে থাকে। লন্ডন শহরে তখন সদ্য ধনী হয়ে ওঠা আর্চি বন্ধুমহলে বৈভব ধরে রাখতে সদা ব্যস্ত। সহকর্মীর তরুণী মেয়ে ন্যান্সি নীলের সঙ্গে কোনও রাখঢাক না রেখেই প্রেম।
মেয়েটার জীবনে আরেকটা ডিসেম্বর এল সেই বছরের শেষে। ৩ ডিসেম্বরের রাতে, প্রচণ্ড ঠান্ডা সেবার, মেয়ে একটু বেশি সন্ধে নাগাদ, কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিচুপি নিজের মরিস গাড়িতে চেপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পুলিশ পুলিশের কাজ শুরু করে দিল। হোম মিনিস্টার দেশজুড়ে ম্যানহান্টিং শুরু করালেন। কোনান ডয়েল ও ডরোথি সয়ারকেও এই ইনভেস্টিগেশনে যোগ দেওয়ানো হল। ডয়েল আবার করলেন কি, মেয়েটার একজোড়া দস্তানা নিয়ে প্রখ্যাত এক অকাল্টিস্টের কাছে চলে গেলেন, যদি অলৌকিক মেয়েটার সন্ধান দিতে পারে, এই ভেবে। ৪ ডিসেম্বর, মানে পরের দিন, মেয়েটার পরিত্যক্ত গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল স্যালিংডেল থেকে খানিক দূরে। গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্টের সম্মুখীন হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেল, অথচ গাড়ির ভেতর কেবল কয়েকটা পোশাক আর এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া লাইসেন্স। মেয়ের কোনও হদিশ নেই। বড় বড় পুরস্কারের ঘোষণা করা হল সরকারের তরফে। নাম করা সংবাদপত্রে স্পেকুলেশনের বন্যা বয়ে গেল। সাগর ডিঙিয়ে মার্কিন দেশেও দিনকয়েক পরে এই খবর প্রকাশিত হল। মেয়েটার আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা নিয়েও অনেক মন্তব্য বিনিময় হল। ব্রিটেনের গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত ঘিঞ্জি এলাকার ওপর দিয়ে এরোপ্লেন যাতায়াত করতে লাগল মেয়েটার সন্ধানে। প্রায় পনেরো হাজারেরও বেশি পুলিশ ফোর্স তোলপাড় করে যেতে লাগল এদিক-ওদিক, এগারো দিন ধরে।
এগারো দিনের মাথায়, ইয়র্কশায়ারের হ্যারোগেট থেকে একটা ফোন এল পুলিশ দপ্তরে। হ্যারোগেট আর লন্ডন শহরের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। ফোনে বলা হলো, একজন মহিলা আমাদের হোটেলে এসে উঠেছেন দিনকয়েক আগে, যাকে দেখতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই মেয়েটির মতো, যার খোঁজে তখন গোটা ব্রিটেনে হুলুস্থূলু চলছে। আর্চি তো পুলিশের দলের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে হ্যারোগেটে দৌঁড়ল! সেই মেয়ে নাকি এখানে খালি হাতেই এসে উঠেছিল। অথচ, হোটেলের সকলে এতদিন এই মেয়ের হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল দিকটাই দেখে এসেছে। পরিচিত কেউ একজন তার সন্ধান করছে শুনেও মেয়ে নিজের ঘর থেকে তখনই বেরিয়ে নিচে নেমে আসেনি। অনেকটা সময় নিয়ে পোশাক বদলেছে, তারপর নিচে ডাইনিং হলে এসে ঢুকেছে। আর্চি একটা টেবিলে বসেছিল, একটু লুকিয়ে। দেখল, মেয়ে এসে একটা কোনার দিকের টেবিলে বসল, বসে সেদিনের খবরের কাগজ পড়তে লাগল। প্রথম পাতাতেই মেয়েটার অন্তর্ধানের খবর। গত কয়েকদিন ধরেই এই খবর কাগজের প্রথম পাতায়। মেয়েটার মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। আর্চি কাছে গেল। মেয়ে আর্চিকে চিনতে পারল না। পরের দিন মেয়ে সেই হোটেল ছেড়ে নিজের বোনের কাছে গেল, লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমে। সেখানে গিয়ে নিজেকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখল, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল, ভিজিটরদের ফিরিয়ে দেওয়া হল। পরে, দু'জন ডাক্তার মেয়ের পরীক্ষা করে জানালো, মেয়েটার এহেতু আচরণের কারণ "an unquestionable genuine loss of memory"।
অনেকে স্পেকুলেট করতে লাগল অনেককিছু। পরবর্তী সময় এমন কথাও বলা হল, মেয়েটা নাকি নিজের বরবাবাজিকে চরকিপাক খাওনোর জন্যই এমনটা করেছিল, কিন্তু এত বড় পাবলিক মেলোড্রামার কথা সে শুরুতে ভাবেনি। এমনও বলা হলো, সাইকোটিক ব্রেকডাউনই এর পিছনের মূল কারণ। আম-নাগরিক চর্চা করতে লাগল এই বলে: মেয়েটার এসব নাকি পাবলিসিটি স্টান্ট নিজের উপন্যাসের কাটতি বাড়ানোর জন্য। অথবা, মেয়েটার নাকি আসল উদ্দেশ্য ছিল নিজের বরকে হত্যার দায়ে দায়ী করা। মাসখানেক বাদে আর্চির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলল মেয়েটা। তারপর তো এক নতুন জীবন, আর্কিওলজিস্ট ম্যাক্সের সঙ্গে মোলাকাত, নতুন আশ্রয় খুঁজে পাওয়া, যাকে কেন্দ্র করেই আগামী ভবিষ্যতে মেয়েটার জীবনে শাখাপ্রশাখার বিস্তার হবে অবাধে।
আর তারপর থেকে মেয়েটার বুড়ি হয়ে যাওয়া অবধি গল্পটা আমরা সকলেই জানি বা স্পেকুলেট করতে পারি। অনেক কম অন্ধকার, অনেক বেশি স্নিগ্ধ সকাল। একের পর এক উপন্যাস, ছোট গল্প লিখে যাওয়া, যেগুলোর বিকল্প এখনও গড়ে ওঠেনি। পাঠকদের ফেরত যেতেই হবে, যে-কোনও সন্ধিক্ষণে মেয়েটির সাহিত্যিক কাজকর্মে। পোয়ারো, মার্পল, টমি ও টাপেন্স, হার্লে কুইনের মতো চরিত্রের জন্ম তো এই অন্ধকারে ভরা মেয়েটাই দিয়েছিল। কিন্তু, এই মেয়ে কি বিশ্বাসযোগ্য? কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে ছিল উনিশশো ছাব্বিশের ডিসেম্বরের ওই ক'টা দিনে? আর্চির বক্তব্যই বা কতটা সঠিক? নাকি দু'জনেই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ? মেয়ে অনেককিছুর সম্মুখীন হয়েছিল অনেক অল্প বয়স থেকেই। আর্চিও যুদ্ধ দেখেছে খুব সামনে থেকে। বিভিন্ন সাহিত্যিক এই মেয়েটাকে নিয়েই কত গবেষণা-গ্রন্থ, কত নাটকীয় উপন্যাস লিখে ফেলেছে! মেয়েটা জীবনে আর কোনওদিন সেই দিনগুলোর কথা তোলেনি। একমাত্র অটোবায়োগ্রাফিতেও ওই বছরটার কোনও উল্লেখ নেই।
গিলিয়ান ফ্লিন তার উপন্যাস 'গন গার্ল' বোধকরি এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই লিখেছিলেন। এরকম তো কত লেখা হয়েছে, দেশ-বিদেশে, এরকম অনুপ্রেরণা কত মানুষকেই তো অহরহ জুগিয়ে চলেছেন বিশ্বের সবথেকে বেশি বিক্রি হওয়া ডিটেকটিভ উপন্যাসগুলোর জনক!
মেয়েটার ছোট্টবেলায় নাম ছিল আগাথা মেরি ক্লারিস্কা মিলার। আর আর্চির সঙ্গে উনিশশো চোদ্দতে বিয়ের পরে নামের সঙ্গে 'ক্রিস্টি' জুড়ে যায়।