আস্থা ভোট চায় বিজেপি, হিমাচলে টিকতে পারবে কংগ্রেস সরকার?

Himachal Pradesh Political Crisis: রাজ্যসভা ভোটে ‘ক্রস ভোটিং’-এর অভিযোগ ঘিরে উত্তেজনার মধ্যেই কংগ্রেস বিধায়কদের অপহরণের অভিযোগ তুলেছেন হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিংহ সুখু।

দিন কয়েক আগেই রাজনৈতিক ভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বিহার এবং তার পরেই পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ড। এবার পালা হিমাচলের। সম্ভবনা দানা পাকছিল অনেক দিন ধরেই ভিতরে ভিতরে। সেই আশঙ্কাকে সত্যি করেই বুধবার থেকে ফের নয়া নাটক শুরু হয়ে গিয়েছে হিমাচল প্রদেশে। আরও এক রাজ্যে ফস্কে যেতে চলেছে কংগ্রেসের ক্ষমতা। কংগ্রেসের ঘর ভাঙার সুযোগ নিয়ে বিজেপির হাতে চলে যেতে পারে আরও একটি রাজ্য। আর লোকসভা ভোটের আগে আগে এ ধরনের ঘটনা বেশ উদ্বেগের বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

এই প্রথম নয়, এমন নাটক মধ্যপ্রদেশ থেকে রাজস্থান, বহু রাজ্যেই ইতিমধ্যেই দেখেছে দেশবাসী। প্রায় একই ছবি দেখা গিয়েছিল মহারাষ্ট্র। সম্প্রতি শিবির বদলে নতুন করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল সমীকরণ। ঝাড়খণ্ডেও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বিজেপি। তবে কৌশল করে বিপদ এড়িয়েছিল ঝাড়খণ্ডে। শেষপর্যন্ত মহাগাঠবন্ধন জোট নিয়েই মসনদে বসেছিল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। ফের তেমনই অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখে এবার পার্বত্যভূমি হিমাচল। সেখানে ফের গদি হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস।

ইতিমধ্যেই মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়েছেন কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংয়ের ছেলে বিক্রমাদিত্য সিং। মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। ঘটনাচক্রে বিক্রমাদিত্যের মা প্রতিভা সিং কংগ্রেস সাংসদ ও হিমাচলের প্রদেশ কংগ্রেস সভানেত্রী। এমনিতেই দেশ জুড়ে কংগ্রেসের অবস্থা টলোমলো। যে কটি রাজ্যে এখনও কংগ্রেসের সরকার রয়েছে, সেই সব ক'টি রাজ্যে কার্যত ওঁৎ পেতে রয়েছে বিজেপি। একটা ফাঁক পেলেই বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়ে নেবে ভারতীয় জনতা পার্টি। আর সেই সুযোগটাই হিমাচলে করে দিয়েছে কংগ্রেসের গোষ্ঠী কোন্দল।

আরও পড়ুন: কংগ্রেসের সঙ্গে আসন ভাগ করবেন? ইন্ডিয়া জোটের অস্তিত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মমতার

মন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগে সুখুর বিরুদ্ধে বিক্রমাদিত্য অভিযোগ করেন, মুখ্যমন্ত্রী নাকি বিধায়কদের উপেক্ষা করেন। এমনকী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্রকেও অপমান করা হয়েছে বলে দাবি করেন বিক্রমাদিত্য। এদিকে এই সবের মাঝে আস্থা ভোটের দাবিতে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল শিবপ্রতাপ শুক্লার সঙ্গে দেখা করে এসিছেলন বিজেপির বিধায়করা। তাঁরা কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে আস্থা ভোটের দাবি জানান রাজ্যপালের কাছে। বুধবার হিমাচল প্রদেশের রাজ্যসভায় বাজেট অধিবেশন শুরু হতে না হতেই বিজেপি বিধায়কেরা স্লোগান দিতে শুরু করেন। এর পরেই ১৫ জন বিধায়ককে বহিষ্কার করেন স্পিকার কুলদীপ সিং পাথানিয়া। বহিষ্কৃত বিধায়কদের অন্যতম বিরোধী দলনেতা তথা হিমাচল প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর। এছাড়াও রণধীর শর্মা, বিপিনকুমার পারমার, হংস রাজ, বিনোদ কুমার-সহ আরও ১৪ জনকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযোগ, স্পিকারের কক্ষের ভিতরে ঢুকে স্লোগান দেন বেশ কয়েকজন বিজেপি বিধায়ক। আর তার পরেই বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয় ।

গেরুয়া শিবিরের দাবি, রাজ্যসভার নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে কংগ্রেস সরকারে থাকার অধিকার হারিয়েছে। এদিকে হিমাচলে সুখবিন্দর সিং সুখুর সরকার বাঁচাতে শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। এর আগে হিমাচল বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর বিক্রমাদিত্য দাবি তুলেছিলেন যাতে তাঁর মাকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত হাইকমান্ড সুখুকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল। সুখুর ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হয়েছিলেন বিক্রমাদিত্য। তবে দু'জনের সম্পর্ক যে মধুর ছিল না, তা সামনে চলে এসেছে।

মঙ্গলবার রাজ্যসভা নির্বাচনে হিমাচলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক কংগ্রেস বিধায়ককে মঙ্গলবার ভোটদানের জন্য বিধানসভায় আনা হয় সুখুর উদ্যোগে। যদিও ভোটের ফল সামনে আসতেই হিমাচল দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি৷ ৬৮ আসনের বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী হর্ষ এবং কংগ্রেস প্রার্থী অভিষেক মনু সিঙভি দু'জনেই ৩৪টি করে ভোট পান। শেষে টাই ব্রেকারে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী। কংগ্রেসের ৬ বিধায়ক এবং ৩ নির্দলের ক্রস ভোটিংয়ের জেরে বিজেপি প্রার্থী জয়ী হন বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পর থেকেই সে রাজ্যে রাজনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে। হিমাচল প্রদেশের বিধানসভায় ৬৮ জন বিধায়কের মধ্যে মাত্র ২৫ জন বিজেপির। রাজ্যে কংগ্রেস বিধায়কের সংখ্যা ৪০। নির্দল বিধায়ক ৩ জন। যদি ওই ৩ নির্দল ও ৬ কংগ্রেস বিধায়ককে মুঠোয় রাখতে পারে বিজেপি তাহলে তারা পৌঁছে যাবে ৩৪-এ। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ৩৫ বিধায়ক। অর্থাৎ আর দু-একজন কংগ্রেস বিধায়ককে নিজেদের দিকে নিতে পারলেই হিমাচলেও ‘অপারেশন লোটাস’ সাফল্য পাবে। ফলে লোকসভা নির্বাচনের আগেই হিমাচলে কংগ্রেস সরকারের পতন হবে, তা নিয়ে একরকম নিশ্চিত পদ্মশিবির। 

 

রাজ্যসভা ভোটে ‘ক্রস ভোটিং’-এর অভিযোগ ঘিরে উত্তেজনার মধ্যেই কংগ্রেস বিধায়কদের অপহরণের অভিযোগ তুলেছেন হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিংহ সুখু। তিনি জানিয়েছেন, কংগ্রেসের পাঁচ-ছ’জন বিধায়ককে অপহরণ করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআরপিএফ এবং বিজেপি শাসিত হরিয়ানার পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেলে ৫টায় রাজ্যসভা ভোটের গণনা শুরু হলেও বিধানসভা ভবনে বিজেপি এবং কংগ্রেস বিধায়কদের মধ্যে তুমুল গন্ডগোলের জেরে তা সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে ভোট চলাকালীনই ‘খবর’ মিলেছিল কংগ্রেসের অন্তত ছ’জন বিধায়ক বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী সুখুও ক্রস ভোটিংয়ের কথা স্বীকার করে নেন। দলের রাজ্য সভাপতি এবং হিমাচলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুরের দাবি, ভোটের ফলাফলেই প্রমাণিত সুখবিন্দর সিং সুখুর সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে৷ ফলে অবিলম্বে আস্থা ভোট করে নিজেদের শক্তির পরীক্ষা দিক কংগ্রেসের সরকার।

৬৮ আসনের হিমাচল বিধানসভায় কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ৪০। এ ছাড়া তিন জন নির্দল বিধায়ক সুখু সরকারকে সমর্থন করছিলেন। অন্য দিকে, বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ২৫। কিন্তু রাজ্যসভা ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট, গরিষ্ঠতা সুখুর পক্ষে নেই। সাংসদ প্রতিভা সিংহ বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারের কার্যকলাপে কংগ্রেস বিধায়কদের একাংশের ক্ষোভ রয়েছে। রাজ্যসভা ভোটে তার প্রভাব পড়তে পারে।’’ কংগ্রেসের অন্দরের রাজনীতিতে প্রতিভা ‘সুখু বিরোধী’ হিসাবে পরিচিত। পাশাপাশি সুখুর বিরোধী অন্তত ছ’জন কংগ্রেস বিধায়ক কাংড়া অঞ্চলের বাসিন্দা। বিজেপি প্রার্থী হর্ষ কাংড়ারই প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা। প্রতিভা এবং তাঁর পুত্র তথা হিমাচলের মন্ত্রী বিক্রমাদিত্যের সঙ্গেও তাঁর ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে বলে সূত্রের খবর। তা ছাড়া, হিমাচলের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহের স্ত্রী পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দরের আত্মীয়। অমরিন্দর বর্তমানে বিজেপিতে। প্রতিভার পুত্র তথা সুখু সরকারের মন্ত্রী বিক্রমাদিত্য গত মাসে দলীয় অবস্থানের উল্টো রাস্তায় হেঁটে অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বিধায়কদলে ভাঙনের আঁচ পেয়ে ক্ষোভ প্রশমনের জন্য সনিয়া গান্ধীকে হিমাচলে প্রার্থী হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন সুখু। কিন্তু তা না মেনে, রাজস্থানে প্রার্থী হন প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রী। এরই মধ্যে জল্পনা ছড়ায়, কংগ্রেসের বিদ্রোহী নেতা বিক্রমাদিত্য সিংয়ের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। তবে নিন্দুকদের মুখো দুয়ো দিয়ে বিক্রমাদিত্য কার্যত সেই জল্পনায় জল ঢেলেছেন। 

আরও পড়ুন: চম্পাই সোরেন ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হেমন্তের, এত করেও ঝাড়খণ্ডে বিজেপিকে রুখতে পারবে JMM?

এই পরিস্থিতিতে যদি সত্যিই আস্থা ভোট হয়, এবং শেষপর্যন্ত কংগ্রেসকে হারতে হয় তাহলে যে তা হাত শিবিরের জন্য খুব বড় ধাক্কা হতে চলেছে লোকসভা নির্বাচনের আগে, তা বলাই বাহুল্য। বিপদ বুঝে সরকার বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কংগ্রেসও৷ বিদ্রোহী ছয় বিধায়কের বিধায়ক পদ খারিজের জন্যও তারা বিধানসভার স্পিকারের কাছে দাবি জানিয়েছে৷ ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি সামাল দিতে ভূপিন্দর সিং হুদা এবং ডি কে শিবকুমারের মতো শীর্ষ নেতাকে সে রাজ্যে পাঠিয়েছেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে অবশ্য বলেছেন, 'হিমাচলপ্রদেশে গণতন্ত্রকে খুন করেছে বিজেপি।'  তবে মুখে যা-ই বলুক না কেন, লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে যে বড়সড় বিপদের মুখে পড়তে চলেছে কংগ্রেস, তা কার্যত স্পষ্ট। এই মুহূর্তে দেশে মাত্র তিনটি রাজ্যে রয়েছে কংগ্রেসের সরকার। তার মধ্যে থেকে হিমাচলে কংগ্রেস সরকার এই মুহূর্তে বড়সড় প্রশ্নের মুখে। গেরুয়া-ঝড়ের মুখে সত্যিই কি হিমাচলে নিজের গড় বাঁচাতে পারবে কংগ্রেস, আপাতত সেদিকেই তাকিয়ে গোটা দেশের রাজনীতি।

More Articles