শেষ জীবনে সংসার ছেড়ে থাকতেন শ্মশানেই, কেন ৩৬-এই আত্মহত্যা করেন পান্নালাল ভট্টাচার্য?
Pannalal Bhattacharya: মোহনবাগানের চির-সমর্থক ছিলেন শ্যামাসঙ্গীত গায়ক। তাঁর ফুটবলের নেশা এতটাই বেশি ছিল যে, মোহনবাগান হেরে গেলে তিনি নাকি গানের রেকর্ডিং পর্যন্ত বাতিল করে দিতেন।
৫৫ বছর হয়ে গেল, তিনি পৃথিবীতে নেই। তবুও কালীপুজোতে এবং অন্যান্য যেকোনও জায়গায় শ্যামাসঙ্গীতের কথা উঠে আসলেই সবার আগে মনে পড়ে যে নাম, তিনি হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। শ্যামা সঙ্গীতের দুনিয়ায় কয়েকজন প্রথম সারির সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পান্নালাল। প্রভাব-প্রতিপত্তি যশ খ্যাতি সবই ছিল তাঁর ভাণ্ডারে। কিন্তু নিজের জীবদ্দশায় বারবার শ্মশানে যেতেন কিছু একটা খুঁজতে। একটা সময় পান্নালাল ভট্টাচার্য ছিলেন ঘোরতর সংসারী। সেখান থেকে হঠাৎ করেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কী হয়েছিল তাঁর? কী এমন খুঁজতে বারবার শ্মশানে যেতে হতো তাঁকে? কেনই বা অকাল বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন পান্নালাল?
১৯৩০ সালে হাওড়ার বালিতে জন্ম হয়েছিল পান্নালালের। ১১ ভাই-বোনদের মধ্যে সবথেকে ছোট ছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। পান্নালাল কখনও নিজের বাবাকে দেখতে পাননি। তিনি যখন তাঁর মায়ের গর্ভে সাত মাসে পড়েছেন, তখনই তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। ফলে পান্নালাল মানুষ হয়েছিলেন নিজের দাদাদের হাতেই। বিশেষত তাঁর মেজদাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয়। তাঁদের পরিবার প্রথম থেকেই ছিল শাক্ত পরিবার। ফলে পরিবারে ভক্তি রসের ধারা ছিল বহমান। তা পান্নালালের মধ্যেও বাহিত হয়। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন নিজেই একজন পুরোহিত। ফলে বাড়িতে পুজো অর্চনাও লেগেই থাকত।
দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করেছিলেন পান্নালালকে। আর ধনঞ্জয়ের স্ত্রী ছিলেন পান্নালালের কাছে তাঁর মায়ের মতো। পান্নালালের বয়স যখন ১৮ কী ১৯, সেই সময় বালিতে বারেন্দ্র পাড়ার মাঠে খেলতে খেলতে হঠাৎ করেই তাঁর চোখে একবার বল লেগে গিয়েছিল। এ সময় তাঁর চোখে গুরুতর চোট লাগে তাঁর। কলকাতা মেডিকেল কলেজে ৪৫০ টাকা দামের ২৫টি ইনজেকশন দেওয়ার পর পান্নালালের চোখ বেঁচে ওঠে, কিন্তু, চোখের মণি কিছুটা সরে গিয়েছিল। ধনঞ্জয় এবং তাঁর স্ত্রী পান্নার সেবা শুশ্রূষা করে তাঁকে তাঁর চোখ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে দাদা বৌদিদের আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন পান্নালাল।
তবে শুধুমাত্র ভক্তিরস না, পান্নালালের গলায় সুর ছিল দুর্ধর্ষ। বর্তমান যুগে রেডিওর বিষয়ে খুব একটা বেশি মানুষ জানেন না। এই প্রজন্মের মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন মানুষের কাছে রেডিও বিষয়টি কিছুটা কাজের। কিন্তু, দু'টি সময় রেকর্ডিং এবং রেডিও হঠাৎ করেই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গেই জীবন্ত হয়ে ওঠেন কিছু হারিয়ে যাওয়া শিল্পী। দুর্গাপুজোর আগে মহিষাসুরমর্দিনীর মাধ্যমে যেমনভাবে হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, তেমন করেই কালীপুজোর সময় হঠাৎ চর্চার মধ্যে উঠে আসেন পান্নালাল ভট্টাচার্য।
আরও পড়ুন- ব্রিটিশ ভারতে এক টুকরো বরফ ছিল লাখ টাকা! দেশে বরফ ব্যবসার ইতিহাসে জড়িয়ে ছিল ঠাকুরবাড়িও
যুগের পর যুগ কেটে গেলেও, পান্নালালের মতো শ্যামাসঙ্গীত গায়ক খুব কমই রয়েছেন। কিন্তু প্রথমেই যে তিনি শ্যামাসঙ্গীত গাইতে চেয়েছিলেন সেরকম কিন্তু নয়, বরং তিনি প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন বাংলা সিনেমার নেপথ্য গায়ক হতে। আধুনিক গান গাওয়ার ইচ্ছা প্রবল ছিল পান্নালালের। কিন্তু সেই সময় বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগে রাজপাট ছিল শচীন দেব বর্মন, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের হাতে। নতুন গায়কদের খুব একটা প্রয়োজনও ছিল না ইন্ডাস্ট্রিতে। ফলে আর বাংলা সিনেমার নেপথ্য গায়ক হয়ে ওঠা হল না পান্নালাল ভট্টাচার্যের।
কিন্তু পঞ্চাশের দশকে কে মল্লিক, ভবানী দাসের মতী কালজয়ী শ্যামাসঙ্গীত শিল্পীরা হারিয়ে যেতে শুরু করলে প্রয়োজন পড়তে থাকে নতুন শিল্পীদের। সেই সময় তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য পান্নালালের কণ্ঠে আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের সুর খুঁজে পান। নিজে নিয়ে গিয়ে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানিতে সুপারিশ করে ধনঞ্জয় বললেন, "আজ থেকে এখানে ভক্তিগীতির দায়িত্ব দিন পান্নাকে, ও কোম্পানির মুখ রাখবে।" পান্নালাল ভট্টাচার্য তাঁর দাদার কথা কোনওদিন ফেলতে পারতেন না। তাই বাংলা আধুনিক সিনেমার প্লেব্যাক করার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে তিনি অনায়াসে গলায় ধারণ করে নিলেন মায়ের গান। সেখান থেকেই শুরু হলো পান্নালাল ভট্টাচার্যের শ্যামাসঙ্গীতের ধারা।
পান্নালাল ফুটবল খেলার দারুণ ভক্ত ছিলেন। মোহনবাগানের চির-সমর্থক ছিলেন শ্যামাসঙ্গীত গায়ক। তাঁর ফুটবলের নেশা এতটাই বেশি ছিল যে, মোহনবাগান হেরে গেলে তিনি নাকি গানের রেকর্ডিং পর্যন্ত বাতিল করে দিতেন। দারুণ ঘুড়ি ওড়াতে পারতেন পান্নালাল। দাদার সঙ্গে মাছ ধরার কম্পিটিশনও করতেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। দাদাকে নিজের 'আইডল' হিসেবে মানতেন পান্নালাল। তাঁর মতো করে ধুতি পরা, তাঁর মতো করে হাতের লেখা, এমনকী তাঁর হাঁটাচলা এবং কথা বলাতেও দাদা ধনঞ্জয়ের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তিনি ভক্তিগীতিও নিজের দাদাকে দেখেই শিখেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, মেজদার থেকে ভালো ভক্তিগীতি এখানে কেউ গাইতে পারেন না। যে কোনও অনুষ্ঠানে গেলে তাঁর দাদার আগেই তিনি গান গেয়ে চলে আসতেন। তিনি মনে করতেন, যদি মেজদা থাকেন, তাহলে তিনি আর গান গাইতে পারবেন না। অন্যদিকে ধনঞ্জয় মনে করতেন, পান্নালাল তাঁর থেকে অনেক ভালো শ্যামাসঙ্গীত গায়ক, তাঁর মতো করে 'মা' কথাটা উচ্চারণ আর কেউ করতে পারতেন না।
তবে নিজেকে নিয়ে এবং নিজের গান নিয়ে কোনওদিন সন্তুষ্ট ছিলেন না পান্নালাল। সব সময় তিনি চাইতেন মা ভবতারিণীকে দেখতে। শোনা যায়, তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য নাকি বহুবার মা ভবতারিণীকে দেখেছেন। কিন্তু পান্নালাল কখনই তাঁর 'মা'কে দেখতে পাননি, এই নিয়ে তাঁর আক্ষেপ চিরকালের। পান্নালালের জীবনে অনেক ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটলেও কালীকে দেখতে পাননি। শোনা যায়, একদিন অনুষ্ঠান শেষে শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি আসার সময় বালি স্টেশনের কিছুটা আগে হঠাৎ করেই ট্রেনের মধ্যে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, মাকে তুঁতে বেনারসি পরানো হয়েছে! কেউ বিশ্বাস না করায়, পান্নালাল চ্যালেঞ্জ ঠুকে বলেছিলেন, তিনি নেমে দেখতে চান। তারপরে পান্নালালের কথায় যখন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্রের মতো শিল্পীরা মন্দিরে গিয়ে দেখেন তখন তাঁরা একেবারে হতবাক হয়ে যান। সকলেই দেখেন মা ভবতারিণীকে তুঁতে রঙের বেনারসি পরানো হয়েছে।
আরও পড়ুন- পছন্দ ছিল না কালীর রুদ্ররূপ, রামকৃষ্ণকেও সহজভাবে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ
এমন আরও অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে পান্নালালের সঙ্গে। কিন্তু, আদর্শ গুরু না থাকার কারণে মায়ের কৃপা ধরে রাখতে পারেননি পান্নালাল। কালীপুজোর সময় দক্ষিণেশ্বরে অনুষ্ঠান করার পরে সেখানেই সারা রাত কাটাতেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। বারবার মাকে দেখার চেষ্টা করতেন, কিন্তু কখনই সফল হতে পারেননি। যতদিন গেছে এই তৃষ্ণা আরও বাড়তে শুরু করেছে পান্নালালের। ধনঞ্জয় শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন, তিনিও গেয়েছেন, তাহলে শুধু দাদাকে দেখা দেবেন কেন? এই প্রশ্ন তিনি বারবার করেছেন ভবতারিণীকে। একটা সময় পান্নালাল ছিলেন দারুণ সংসারী। নিজের হাতে কন্যাদের চুল বেঁধে দিতেন, নিজে পছন্দ করে স্ত্রীর জন্য শাড়ি নিয়ে আসতেন, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। সেই পান্নালাল আস্তে আস্তে সংসারের বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করলেন। দিনের বেশিরভাগ সময়টা শ্মশানে গিয়ে কাটাতেন। সেখানেই পড়ে থাকতেন, কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করতেন। বাড়িতে সময় দিতেন না। কালীকে দেখার একটা বায়না অত্যন্ত গভীরভাবে চেপে বসেছিল। শ্মশানে গিয়ে শিশুর মতো করে কাঁদতেন আর ভবতারিণীকে স্মরণ করতেন, কাছে যেতে চাইতেন। সংসারের বাঁধনে তাঁকে আর বাঁধা যেত না। 'মা'কে পেতেই হবে, এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি সংসার থেকে ধীরে ধীরে বিবাগী হতে আরম্ভ করলেন।
শেষে এল অভিশপ্ত সেই ১৯৬৬, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে দেবী দর্শন করতে না পারার অবসাদ এবং অতৃপ্তি নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। হয়তো তিনি তাঁর 'মা ভবতারিণী'কে বলতে চেয়েছিলেন, যদি তিনি তাঁর কাছে না আসেন, তাহলে তিনি নিজেই তাঁর কাছে যাবেন। হয়তো তাই নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলেন অকালে। যাওয়ার আগে তিনি রেখে দিয়ে গেলেন তাঁর শ্যামাসঙ্গীতের অপার ভাণ্ডার। জীবনকালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই তিনি ৩৬ টি আধুনিক, ১৮টি রেকর্ড, ৩টি বাংলা সিনেমার গান, এবং ৪০টি শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন। এছাড়াও শ্রী অভয় নামে তিনি লিখে এবং সুর করে দিয়ে গেছেন বেশ কিছু শ্যামাসঙ্গীত যা আজও প্রাসঙ্গিক করে রাখে এই কালজয়ী শ্যামাসঙ্গীত স্রষ্টাকে। 'আমার সাধ না মিটিল', 'তিলেক দাঁড়া ওরে শমন', 'ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে', এসব গানের মাধ্যমে বারবার ভবতারিণীকেই খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন পান্নালাল। নিজের জীবনের শেষ দিকে হয়তো তিনি মনে করেছিলেন, যদি ওপারে যেতে পারেন, তবেই নিজের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। তাইতো নিজের শেষ রেকর্ড করা গানে পান্নালাল বলছেন -
অপার সংসার, নাহি পারাপার।
ভরসা শ্রীপদ, সঙ্গের সম্পদ,
বিপদে তারিণী, করগো নিস্তার।
যে দেখে তরঙ্গ অগাধ বারি,
ভয়ে কাঁপে অঙ্গ, ডুবে বা মরি।
তার কৃপা করি, কিঙ্কর তোমারি,
দিয়ে চরণ-তরী, রাখ এইবার।।
বহিছে তুফান নাহিক বিরাম,
থর থর অঙ্গ কাঁপে অবিরাম।
পূরাও মনষ্কাম, জপি তারানাম,
তারা তব নাম সংসারের সার।।
কাল গেল কালী হ’ল না সাধন,
প্রসাদ বলে গেল বিফলে জীবন।
এ ভববন্ধন, কর বিমোচন,
মা বিনে তারিণী কারে দিব ভার।।