অন্য বীরভূম, অন্য দুর্গা

পুজো এক আনন্দের কথা বলে। পুজো চলে যাওয়ার কথাও বলে। রাবীন্দ্রিক ট্র্যাডিশনের বীরভূম তার গ্রামবাংলার ‘গুড ওল্ড’ সাবেকিয়ানার ভেতরেই নির্মাণ করেছে এক অন্য বীরভূম। শারদোৎসবের গল্পে তাই অনেক টানাপড়েন। এখানে চলে আসে বনেদিয়ানা, পোড়ামাটির ভাস্কর্যের পাশে দৃপ্ত ঐতিহ্য, বনেদি ম্যানসন, কখনও ছোট্ট ছিমছাম এক গ্রামে প্রতিমায় আঙুল বোলানো বোলানো শিশুকন্যা, যুবতী, অথবা মানতের সুতোয় আরণ্যক আদিমতার কথা বলা প্রিস্টাইন কিছু ইতিহাস আর ইতিহাস। ২০২১-এর থিমের বাড়বাড়ন্তের বাইরে তেমনই কিছু গল্প শুনবেন, প্রিয় পাঠক?

হীরালিনী দুর্গাপুজো। প্রান্তিকের কাছেই সোনাঝুরি সংলগ্ন বনেরপুকুরডাঙা এবং তার ঐতিহ্যময়ী হীরালিনী। পুজো এখানে বনেদিয়ানা বা থিম ঘরানার বাইরে অন্য চেহারায়। প্রয়াত শিল্পী বাঁধন দাসের শুরু করা ঐতিহ্য রূপ পেয়েছে তাঁর ছাত্র ও ভগ্নিপতী আশিস ঘোষের হাতে। বাঁধন দাসের দিদি হীরা এবং পিতা নলিনী দাসের নাম থেকে ২০০১ সালে শুরু হওয়া এই হীরালিনী ২০০২ সাল থেকে শিল্পীর অকাল প্রয়াণের পর থেকে তাঁর উত্তরসূরিদের হাতেই। মাদলের রেজোনেন্স, পোড়ামাটি, বাঁশ, কাঠ, মাটি বা পিতলের উপাদানে নির্মিত অদ্ভুত হন্টিং এক দেবী মূর্তি, আরণ্যক উন্মাদনা, কালো চকচকে আদিবাসী নৃত্য– ‘একী বন্য, এ অরণ্য…’। এই জাদুবাস্তবের তাই কোনও তুলনা পাইনি সেভাবে। ২০২১ পেরিয়ে, অতিমারি পেরিয়ে এই উৎসব, এই মাদল, এই বাঙালিয়ানা অবিনশ্বর।

একটু বনেদিয়ানায় চলে আসি। সুরুল সরকারবাড়ি। পোড়ামাটির লক্ষ্মী জনার্দন পঞ্চরত্ন এবং তার লাগোয়া নাটমন্দির এবং চতুষ্কোণ রাজবাড়ি। বর্ধমানের নীলপুর থেকে সুরুলে আসা ঘোষ পরিবারের সরকার হওয়ার ইতিহাস এবং শ্রীনিবাস সরকারের লিগ্যাসি এখানে কথা বলে। জাহাজের পাল এবং নীল– মূলত এই দুই ব্যবসায় লাখপতি হওয়া শ্রীনিবাস সরকারের আমলে পোড়ামাটির মন্দির এবং সরকারবাড়ির দুর্গাপূজায় প্রতিপত্তিলাভের শুরুটা– বাদবাকিটা ইতিহাস। একচালা ডাকের সাজের প্রতিমার কাজ শুরু হয় রথের দিন। তিনশ বছরের পুরনো রাজবাড়ির সোনার অলঙ্কারে সাজানা দেবীর কারিগর মূলত পাঁচ পুরুষ ধরে আসা পাল বংশের মৃৎশিল্পীরা। রেড়ির তেলের প্রদীপে সাজা রাজবাড়ি পুজোর দিনগুলোতে একদমই ইতিহাস থেকে উঠে আসা জলন্ত ম্যাজিক। ভোগের চিঁড়ে, নাড়ু, মিষ্টি, ফল, উপর থেকে ছুড়ে দিয়ে নিচে লুফে নেওয়ার রাজকীয় প্যাশন, রীতি। কিছুটা দাপুটে জমিদার ধরনের দেখালেও আজকের লোপাট ইতিহাসের সময়ে এ দৃশ্য এক অদ্ভুত ইউনিকনেসের জন্ম দেয়, সন্দেহ নেই। একমাস আগে তৈরি হওয়া নির্ঘণ্ট অনুযায়ী সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানে শুরু হয় মঞ্চ সজ্জা। সপ্তমে, অষ্টমী, নবমী– বলিপ্রথা থেকে এখনও সরে আসেনি এই বর্ধিষ্ণু গ্রামটি। এবং অবশ্যই পাশাপাশি চলে আসা নাটমন্দিরে আয়োজিত যাত্রাপালা, সঙ্গে চিকের আড়াল থেকে মেয়েদের আলাপ, দূর থেকে দেখা ‘তিমির অবগুণ্ঠনে…’। বিশালাকার এক দালানবাড়ি, বেলজিয়ান গ্লাসের ঠনঠন ধ্বনি – যেন চিরপুরাতন এক ভিড়ের মাঝে এখনও দোতলার জানাল থেকে উঁকি মারা শতায়ু কোনও নারী, শ্রীনিবাসবাবুর একান্ত দৃপ্ত ছায়াময় হেটে যাওয়া। হালকা নীল এক প্রাসাদোপম ম্যানসনে যেন এই তো ইতিহাস, এই তো ‘কথা কও, কথা কও’-এর ক্লিশে। তাই দালাল বাড়ি, দে বাড়ি, দত্ত বাড়ি- বীরভূমের এমন আরও বহু জায়গায় এমনই ক্লিশের সেলিব্রেশন, অথচ টান এখনও একইরকম, ভাটা পড়ে না একরত্তিও।

বাংলাদেশের ধামরাই গ্রামে হওয়া সুপ্রাচীন দুর্গাপূজার ধারাকে রাজনৈতিক এক দেশভাগে খুইয়ে এসেও আত্মিকভাবে ধরে রেখেছিলেন বসাক পরিবারের সদস্যরা। ধামরাই থেকে সিউড়িতে এসে তাঁদের পুজোর ঐতিহ্য অবিকলভাবে রেখে দেন তাঁরা। সামনে বেদি, পেছনে নাটমন্দির। পঞ্চমী থেকে শুরু হওয়া পুজো পুরোপুরিই বৈষ্ণব মতে হয়। তস্য এক গলির ভেতর সাক্ষাৎ এক বনেদি ইতিহাসের স্মারক বসাক বাড়ি এক অদ্ভুত আমন্ত্রনের জন্ম দেয়। পরিবারের আত্মীয়তা, স্থাপত্য, অষ্টধাতুর মূর্তির শোভা, নাটমন্দিরের সুপ্রাচীনতা– শান্ত হয়ে আসে মন, মনন। সদর পেরিয়ে ঘোর ভাঙে, এতক্ষণ টাইমট্রাভেল ছিল না তো? গ্রহের বাইরে, সময়ের বাইরে, যুগোপযোগিতার বাইরে?

নিটোল এক গ্রামের গল্প। ‘রূপকথা নয় সে নয়’। বীরভূমের মহম্মদবাজার থানা লাগোয়া ছোট্ট গ্রাম রঘুনাথপুরে একান্ত নিভৃত প্রতিমা-পরিবার। এই সূত্রধর পদবীর পরিবারের নিজস্ব প্রাচীন প্রতিমা ছাড়াও চলে আসে এঁদের পারিবারিক ইতিহাস। সমগ্র পরিবারটিই প্রতিমাশিল্পী। দুই ভাই, জা, ছোট একটি আট-নয় বছরের মেয়ে। প্রতিমায় হাত লাগায় সবাই। কথায় উঠে আসে পারিবারিক ট্রাজেডির গল্প। সম্প্রতি চলে যাওয়া পরিবারের এক নারীর মুখ, যাকে কেন্দ্র করে, যার স্মৃতিতে সজল আরেক নারী। পুজোর অন্যরকম দিনগুলোর মাদকতা তাই গ্রাস করে নেয় নিজস্ব বিয়োগব্যথায়। তবু, রঘুনাথপুরের সূত্রধররা এক অন্য গ্রাম-চিত্রের জন্ম দেয়। অসুরের মুখে, সিংহের কেশরে, দেবীর চোখে রঙ মাখায় শিশুকন্যা। আদরে হাত বোলায় তার ‘মা’-য়ের বসনে, গাঢ় কালো চুলে– কবিতার জন্ম হয়, সাক্ষাৎ কবিতার জন্ম হয়।

তেমনই এক কবিতার কথা দিয়ে শেষ করি বীরভূম লাগোয়া পূর্ব বর্ধমানের দুটি প্রাচীন ছবি দিয়ে। গুসকরার প্যালাডিয়ান ম্যানসনে ঘেরা চোঙদারদের ৩০০ বছরের পুরনো পুজো সাবেকি। চার দিনই হোম-যজ্ঞ, দশমীতে বিসর্জনের বদলে ঘট প্রতিষ্ঠা, বন্দুক চালিয়ে সন্ধিপুজো, সপ্তমী থেকে দশমী প্রদীপ জ্বেলে রাখার রেওয়াজ এবং সম্পূর্ণভাবে শাক্ত মতের পরম্পরা চোঙদারদের অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। রাজবাড়িতে বারান্দায় পলেস্তারা খসা, বয়স, বড় বেশি বয়সের ছাপ। শোভাবাজারের আদল। পায়রার উড়ে যাওয়া। সুবিশাল ছাদে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি। ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন, সারাজীবন…’।

ইছাই ঘোষের জঙ্গল তথা গড় জঙ্গল। অবিভক্ত বাংলার প্রথম দুর্গাপূজা?  কথন নাকি বাস্তব? সেই বিতর্কে না গিয়ে চলে আসি শ্যামারূপার ট্র্যাডিশনে। দেবী একাধারে শ্যামা, অন্যদিকে দুর্গা। অদ্ভুত আরণ্যক পরিবেশ, অষ্টমীর সন্ধিপুজোর প্রাক্কালে তোপধ্বনি এবং শেষমেশ প্রাচীন এক গর্ভগৃহে সবার অলক্ষ্যেই সন্ধিপুজো– শাল, পিয়াল, পলাশ, মহুয়া- আদিম মহাদ্রুম। শ্যামারূপার জৌলুসহীন প্রাচীন ইতিহাস তাই ভিড়ের তোয়াক্কা না করা এক অনিবার্য বাঁক, যার গাম্ভীর্যকে, টোনকে থিম পুজোরা ছুঁতেও হয়তো পারবে না কোনওদিন।

More Articles